বাংলা ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মোগল শাসনাধীন ছিল। মোগল সম্রাট শায়েস্তা খাঁ দুই দফায় মোট ২২ বছর বাংলা শাসন করেছেন। প্রথমে ১৬৬৪-৭৮ পর্যন্ত এবং পরে ১৬৭৯-৮৮ সাল পর্যন্ত। বাংলার সুবাদার হিসেবে তার কার্যকালের মেয়াদ দীর্ঘতম। শায়েস্তা খাঁ এ দীর্ঘ ২২ বছরের শাসনে বাংলাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। শায়েস্তা খাঁর আসল নাম ছিল মির্জা আবু তালিব। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার রাজত্বকালের ২১তম বছরে ‘শায়েস্তা খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। নানা পদোন্নতি পেয়ে বাংলার বেশকিছু প্রদেশের সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে আওরঙ্গজেব উত্তরাধিকার যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শায়েস্তা খাঁকে মর্যাদাপূর্ণ আমির-উল-উমারা (আমির বা অভিজাতদের প্রধান) উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তাই বলাই যায়, বাংলা তার যোগ্য শাসক পেয়েছিল সে সময়।
মিরজুমলার
মৃত্যুর পর যখন শায়েস্তা খাঁ ক্ষমতায় আসেন
তখন সাময়িকভাবে স্থলাভিষিক্ত কর্মকর্তাদের শাসনকালে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা
দিয়েছিল। তাই শায়েস্তা খাঁ ক্ষমতায় এসেই তার ছয় পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে বাংলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে কাজ শুরু করেন।
সমসাময়িক ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ারের বিবরণী থেকে শায়েস্তা খাঁর আমলে বাংলার প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য ও দ্রব্যমূল্যের সুলভ্যতা সম্পর্কে জানা যায়। বাংলার কৃষি উৎপাদন এ সময়ে অনেক বেড়েছিল এবং তিনি কৃষকদের দ্বৈত কর আরোপ থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি কৃষিপণ্য বাজারজাত করার জন্য ব্যবসায়ীদের উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। ফলে খুব সহজেই তার সময়ে খাদ্যশস্যের ব্যাপক কমে গিয়েছিল। এছাড়া প্রশাসনিক নতুন অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন তিনি। তবে শায়েস্তা খাঁর নাম শুনতেই আমাদের সবার আগে যে কথাটি মনে পড়ে- ‘১ টাকায় আট মণ চাল’।
ছবি: মাসফিকুর সোহান
বাংলার
ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে লালবাগ কেল্লা অন্যতম। এখানেও শায়েস্তা খানের অবদান
আছে। আগে এটি ঔরঙ্গাবাদ কেল্লা নামে পরিচিত ছিল। এটি ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা
নদীর তীরে অবস্থিত একটি অসমাপ্ত মোগল দুর্গ। কেল্লার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৬৭৮
সালে মোগল সুবেদার মুহাম্মদ আজম শাহ কর্তৃক। পর শায়েস্তা খাঁ তার আমলে পুনরায় এর নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন ১৬৮০ সালে।
বেশ অনেকটাই কাজ হয়েছিল তবে সমাপ্ত করেননি সম্রাট। কিন্তু এ কেল্লাকে ঘিরে আছে একটি মজার ইতিহাস। লালবাগ কেল্লার দুটি গেটের মধ্যে পশ্চিম পাশে যে
গেটটি আছে তা যুগ যুগ ধরেই বন্ধ। মূলত সম্রাটের শাসনকালে ১ টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যাওয়ার
ঘটনাকে স্মরণীয় করার জন্যই তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে
দুর্গের পশ্চিম তোরণ-দ্বার বন্ধ করে দেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। এ নিয়ে সেখানে লিখিত প্রমাণও আছে। বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে
যে সুবাদারের আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যাবে তিনি ব্যতীত
আর কেউ যেন এ তোরণ-দ্বার না খোলেন।
তাহলে
কি লালবাগের পশ্চিম তোরণ আর কখনই খোলা হয়নি?
হ্যাঁ, হয়েছিল। তবে তার পেছনে রয়েছে বাংলার আরেক দক্ষ নবাব সুজাউদ্দিন খানের (১৭২৭-৩৯)
এক সফল শাসনকাল। ১৭২৭ সাল, বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খান মৃত্যুবরণ করেন এবং তার
জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলা শাসনের ক্ষমতা পেয়েছিলেন। শায়েস্তা খাঁর শাসনকালে কৃষি উন্নতির বিষয় আমরা কম-বেশি সবাই
জানি। তবে আবারো যে বাংলায় ১ টাকায় আট মণ চাল পাওয়া গিয়েছিল
সেই ইতিহাস খুব কম মানুষই জানে। সে সময় বেশির ভাগ দ্রব্যের
দামই ছিল হাতের নাগালে এবং মানুষ চাল কিনতে পারত টাকায় আট মণ। ১৭৪০ সালে নবাব সুজাউদ্দিনের
পুত্র সরফরাজ খানের সময় পুনরায় খোলা হয়েছিল লালবাগের পশ্চিম
তোরণ।
এরপর
বাংলায় আরো শত শাসক এসেছেন। রাজধানীসহ পুরো বাংলাকে শাসন করেছেন। কখনো লুটপাট, আবার
উন্নয়নসাধনও করেছেন। কিন্তু টাকায় আট মণ চাল আর কোনো শাসক দিতে পারেননি। সেই
থেকে আজও বন্ধ হয়ে রয়েছে লালবাগের পশ্চিম তোরণ।