‘বিশ্বটাকে দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’—সংকল্প কবিতায় কাজী নজরুল ইসলামের বিশ্বকে দেখতে চাওয়ার পরিমার্জিত রূপই যেন বর্তমান সময়ের স্মার্টফোন। প্রযুক্তির নিত্যনতুন ছোঁয়ায় বদলে গেছে আমাদের জীবন। ল্যান্ডফোনের দিনগুলো থেকে সেলফোনের নানা রকম সংস্করণ পার হয়ে হালের স্মার্টফোন হয়ে গেছে সবার নিত্যদিনের অনুষঙ্গ। শুরুর দিকে আলাদা কলমের ব্যবহার থাকলেও এখন পুরোপুরি টাচ স্ক্রিনের ওপর নির্ভর করেই স্মার্টফোন ব্যবহার হচ্ছে।
প্রযুক্তির বিস্তারে কম্পিউটারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে মোবাইল ফোন। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের এমন আভাসের প্রতিফলনই যেন ঘটেছে স্মার্টফোনের একচ্ছত্র আধিপত্যের ক্ষেত্রে। অনেক তরুণই এখন ল্যাপটপ না কিনে স্মার্টফোনের দিকে ঝুঁকছে। এভাবে স্মার্টফোনের বাজার বর্ধনশীল হওয়ায় বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিপণ্য উৎপন্নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আপডেটেড ফিচারসমৃদ্ধ স্মার্টফোন বাজারে আনছে। তরুণরাও বুঁদ হয়ে থাকছে স্মার্টফোনগুলোর ফিচার ও অ্যাপগুলোর মধ্যে। এভাবে স্মার্টফোন তরুণদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে তরুণদের মধ্যে স্মার্টফোনের প্রভাব নিয়ে। তরুণরা কি শুধু অ্যাপ ব্যবহার আর সেলফি নিয়েই মেতে আছে, না স্মার্টফোন কাজে লাগিয়ে নিজেদের জীবন বদলে দিতে পারছে? প্রযুক্তির সম্ভাবনার এ যুগে স্মার্টফোন নিঃসন্দেহে তরুণদের জন্য জীবন গড়ার হাতিয়ার হতে পারে। অনেক তরুণই এখন প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গড়ছে। আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং থেকে শুরু করে অ্যাপ ডেভেলপ ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ শিখছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে হাই-টেক পার্ক স্থাপনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। ফলে স্মার্টফোনসংশ্লিষ্ট খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ছে।
তরুণরা সারা দিন স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে থাকে, এ অভিযোগ এখন বেশ জোরেশোরে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীনসহ নানা দেশে স্মার্টফোন ব্যবহার করে তরুণরা সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার গড়লেও আমাদের দেশে স্মার্টফোনের অপব্যবহার বেশি হচ্ছে এমন অভিযোগের সারি দীর্ঘ। বিশেষ করে অধিকাংশ তরুণের হাতেই স্মার্টফোন থাকায় এর অপব্যবহারের নজির পাওয়া যায়।
স্মার্টফোন কি এজন্য প্রযুক্তির সর্বশেষ সংযোজন হয়ে আমাদের জীবনে এসেছে? এর যে অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে তা কি অস্বীকার করা যাবে? কিন্তু সেটি কাজে লাগানো যাচ্ছে কি? বর্তমান সময়ে ফোরজি ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে গেছে। এছাড়া ওয়াইফাইয়ের ব্যবহার বাড়ছে। সব মিলিয়ে স্মার্টফোন এখন বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির প্রবেশদ্বারে রূপান্তর হয়েছে। এখন স্মার্টফোনেই মাইক্রোসফট অফিস অ্যাপ্লিকেশনের কাজগুলো করা যায়। ফলে হাতের কাছে কম্পিউটার বা ল্যাপটপ না থাকলেও স্মার্টফোনে জরুরি কাজ সেরে নেয়া সম্ভব হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার অসহ্যকর জ্যামে বসে অনেক তরুণ অফিসের কাজ স্মার্টফোনে গুছিয়ে নিতে পারে। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন স্মার্টফোনে বাংলা লেখাও সহজ হয়ে গেছে। ফলে অফিসের কাজে স্মার্টফোন দারুণ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
স্মার্টফোনের মাধ্যমে ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি বেশ সহজ হয়ে গেছে। উন্নত মানের ক্যামেরা থাকায় ক্ষেত্রবিশেষে আলাদা করে ডিএসএলআরের প্রয়োজনও পড়ছে না। বিশেষ করে সাম্প্রতিক নতুন সংযোজন সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতার জন্য স্মার্টফোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এমনকি পেশাগত সাংবাদিকতার কাজেও স্মার্টফোনের অবদান অনস্বীকার্য।
তরুণদের শিক্ষাজীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে স্মার্টফোন। বিশেষ করে অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে স্মার্টফোন করোনাকালে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান সময়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার ক্ষেত্রেও স্মার্টফোনের বিস্তারকে অস্বীকার করা যাবে না।
তরুণ উদ্যোক্তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করছে স্মার্টফোন। বিশেষ করে আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখা থেকে শুরু করে যেকোনো তথ্য পেতে স্মার্টফোন সহায়ক ভূমিকা রাখছে। সব মিলিয়ে স্মার্টফোন তরুণদের জীবনকে সহজ করলেও এর দুর্বিষহ ব্যবহারও লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন প্রাইভেসি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাইটগুলোয় যে কেউ একাধিক আইডি খুলে গুজব ছড়াতে পারে। শুধু ভিউয়ের লোভে যেকোনো দুর্ঘটনার সময় বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধার না করে ফেসবুক লাইভে চলে আসছে। ইউটিউবে অশ্রাব্য শিরোনামে কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে। ফেসবুক কমেন্টের ক্ষেত্রে ভিন্নমতের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এখন নিত্যদিনের বিষয়। এভাবে সময় অপচয়ের হাতিয়ার হিসেবে ফেসবুকের অবাধ ব্যবহার শুরুর দিকে সাইবার ক্যাফের দিনগুলোয় ছিল না। একদিকে স্মার্টফোনের ফলে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্যোক্তা যেমন তৈরি হচ্ছে, ঠিক তেমনি এর অপব্যবহারও হচ্ছে। অন্যদিকে মেধাকে অপকর্মে ব্যয় করে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের তথ্য হাতিয়ে নেয়া হয়। সম্প্রতি টেলিগ্রামের একটি গ্রুপের মাধ্যমে নারীদের ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ছড়ানো হচ্ছিল, এ অভিযোগে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন জুয়ার সাইট ও অশ্লীল ভিডিও এখন সহজলভ্য হয়ে উঠছে। এজন্য সমাজবিজ্ঞানীরা সন্তানের বয়স ১৮ হওয়ার আগে স্মার্টফোন না দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
স্মার্টফোনের নেশা তরুণদের এমনভাবে গ্রাস করেছে যে কানে হেডফোন গুঁজে দিন পার করা এখন তথাকথিত ফ্যাশন বলে গণ্য হচ্ছে। এখন আর সিডি কেনার প্রয়োজন হয় না, এমনকি এফএম রেডিওতে পছন্দের গান শোনার অনুরোধ করতে হয় না। হাতের স্মার্টফোনেই ইউটিউব সহজলভ্য হয়ে গেছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে, দীর্ঘক্ষণ কানে হেডফোন গুঁজে রাখায় তরুণদের শ্রবণশক্তি কমে যাচ্ছে। রাতের বেলা একসময় বইপ্রেমী তরুণরা বই পড়ে ঘুমের দেশে হারিয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে স্মার্টফোন সে জায়গা দখল করেছে। এখন ফেসবুক চালাতে চালাতে অত্যধিক রাত জেগে ঘুমিয়ে পড়ে এ সময়ের অধিকাংশ তরুণ। ফলে অনিদ্রা ও সকালবেলা দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার বাজে অভ্যাস তরুণদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষা ও কর্মজীবনে। বলা যায় স্মার্টফোন তরুণদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। অফিস বা ব্যবসায় মনোযোগও প্রভাবিত করছে স্মার্টফোনের অতিব্যবহার।
ইদানীং মেটাভার্স বা মানুষের ইন্দ্রিয়সীমার মধ্যে দৃশ্যমান নতুন এক জগতের কথা বলা হচ্ছে। স্মার্টফোনকে দেখা হচ্ছে এ জগতের প্রবেশদ্বার হিসেবে। থ্রিজি নেটওয়ার্ক আসার আগে ভিডিও কল সবার জন্য সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু এখন দূর থেকেও প্রিয়জনকে স্ক্রিনের মাধ্যমে স্পর্শ করার এক অপার্থিব অনুভূতি পাওয়া যায় স্মার্টফোনের মাধ্যমে। এভাবেই স্মার্টফোন বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রা। কিন্তু প্রযুক্তির এ অনুষঙ্গকে সমৃদ্ধি ও কল্যাণের পথে ধাবিত করার ক্ষেত্রে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এ চ্যালেঞ্জকে উপেক্ষা করার কিছু নেই, বরং স্মার্টফোনের গঠনমূলক ব্যবহারের মাধ্যমে যন্ত্রটিকে একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা পূরণে নেতৃত্বের হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। আর এর দায়িত্ব তরুণ প্রজন্মকেই নিতে হবে। তরুণদের হাত ধরেই স্মার্টফোন হয়ে উঠতে পারে সম্ভাবনার প্রতীক। আমরা তারুণ্যের জয়গানে সে প্রত্যাশাই করি।
তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক