সরকার চলতি বোরো মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহের নীতিমালা ঘোষণা করেছে। ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে দেশীয় উৎপাদন থেকে পাঁচ লাখ টন ধান এবং ১২ লাখ টন চাল কিনবে সরকার। ধানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে কেজিপ্রতি ৩২ টাকা, যা গত মৌসুমের চেয়ে কেজিতে ২ টাকা বেশি। আর ১২ লাখ টন চালের মধ্যে ১১ লাখ টন সিদ্ধ চালের দাম নির্ধারণ হয়েছে কেজিপ্রতি ৪৫ টাকা, যা গত বোরো মৌসুমের তুলনায় কেজিতে ১ টাকা বেশি। বাকি এক লাখ টন আতপ চাল কেনা হবে কেজিপ্রতি ৪৪ টাকায়। ৭ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এ সংগ্রহ অভিযান চলবে। ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এফপিএমসির সদস্য শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুস শহীদ, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বেগম রোকেয়া সুলতানা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সরকারের চলতি বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযানে নির্ধারিত দাম খোলা বাজারে কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
চলতি শতকের প্রথম দশকের প্রথম দিকে আমি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করি। এ দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দেশীয় উৎপাদন থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহে, বিশেষ করে ধান-চাল সংগ্রহে পণ্যের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। এখানে তিনটি গোষ্ঠীর অনেকটা পরস্পরবিরোধী দাবি বিবেচনায় নিতে হয়। উৎপাদক তথা ধানচাষীদের দাবি ধানের উচ্চ মূল্য নির্ধারণ, যাতে উৎপাদন ব্যয় মেটানোর পরও তাদের ভালো লাভ থাকে। ভোক্তারা স্বাভাবিকভাবেই চান বাজারে চালের দাম কম হোক, যাতে বাজার থেকে পণ্যটি সংগ্রহের জন্য তাদের অধিক পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে না হয়। সরকারকে চাল সরবরাহের দায়িত্বে থাকা চালকল মালিকরা একদিকে চালের উচ্চ মূল্য দাবি করেন এবং অন্যদিকে সরকারের কাছে তদবির করেন ধানের কম দাম নির্ধারণে, যাতে তারা কম দামে ধান কিনে রূপান্তরিত চাল সরকার নির্ধারিত মূল্যে সরবরাহ এবং খোলা বাজারে উচ্চ মূল্যে চাল বিক্রি করে ভালো লাভ করতে পারেন। তিন গোষ্ঠীর দাবি বিবেচনায় নিয়ে এফপিএমসি তথা সরকারকে ধান-চালের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করতে হয়। সরকারি ভাষ্য মোতাবেক, ধানচাষীদের ধান উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে কিছুটা লাভ যোগ করে ধানের দাম এবং চালকল মালিকদের চাল তৈরি ব্যয়ের সঙ্গে কিছুটা লাভ যোগ করে চালের দাম নির্ধারণ করা হয়। ভোক্তাদের দাবি এফপিএমসির সিদ্ধান্তকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে।
দেশীয় উৎপাদন থেকে সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে রয়েছে—এক. ধানচাষীদের স্বার্থ রক্ষা: সরকার চায় ধান কাটা ও মাড়াই মৌসুমে বাজারে পণ্যটির দাম স্থিতিশীল থাকুক, যাতে ধানচাষীরা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ধানচাষীরা মৌসুমের শুরুতে ধানের ন্যায্যমূল্য পান। দুই. খাদ্যনিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলা: কাটা ও মাড়াই মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহের মাধ্যমে সরকারি গুদামে চালের নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলা সরকারের একটি উদ্দেশ্য। সরকারি খাদ্যগুদামে যথেষ্ট পরিমাণে ধান-চাল মজুদ থাকলে তা চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়াতে নিরুৎসাহিত করে। তিন. খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি পরিচালনা: সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, বাজারে চালের দাম বাড়লে সরকারি মজুদ থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস), টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারী ও হতদরিদ্র মানুষের মাঝে হ্রাসকৃত মূল্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল বিক্রি করে পণ্যটির দাম স্থিতিশীল রাখা। চার. সরকারের লক্ষ্যমুখী কর্মসূচি পরিচালনা: সরকার খাদ্যশস্যের (চাল, গম) সরকারি মজুদ থেকে লক্ষ্যমুখী খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে। এসব কর্মসূচির মধ্যে দুস্থ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন (ভিজিডি), দুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য সহায়তা (ভিজিএফ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দেশে খোলা বাজারে চালের দাম নির্ধারণে যেসব ফ্যাক্টর ভূমিকা রাখে সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো—ক. দেশীয় উৎপাদন, খ. আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম এবং গ. বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের ভূমিকা। এ তিন বিষয়ের ওপর কিছুটা আলোকপাত করা যাক। দেশ চাল উৎপাদনে প্রশংসনীয় অগ্রগতি সাধন করলেও এখন পর্যন্ত স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেনি। এর মূল কারণ হলো দেশে চাল উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মোতাবেক ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে চাল উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি হার ছিল ১ শতাংশ। এদিকে ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১ দশমিক ৩৭ ও ১ দশমিক ৩ শতাংশ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ ও ২০২৩)। এর অর্থ দাঁড়ায়, চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। এতে চাহিদার তুলনায় চালের ঘাটতি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই চাহিদা পূরণে প্রায় প্রতি বছর আমাদের চাল আমদানি করতে হচ্ছে। দুই. আন্তর্জাতিক বাজার থেকে উচ্চ মূল্যে আমদানি করা চাল দেশের বাজারে চালের মূল্যকে উসকিয়ে দেয়। গত মৌসুমে বোরোর আশানুরূপ উৎপাদন এবং ফেব্রুয়ারিতে সমাপ্ত আমন মৌসুমে ভালো উৎপাদনের আশায় সরকার চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাস সরকারি ও বেসরকারি খাতে কোনো চাল আমদানির অনুমতি দেয়নি। অবশেষে আশা ভঙ্গ হলে অর্থাৎ প্রত্যাশা অনুযায়ী আমন চাল উৎপাদন না হওয়ায় মার্চের শেষ দিকে এসে সরকার বেসরকারি খাতকে চাল আমদানির অনুমতি দেয়। এদিকে চাল সংকটের সুযোগ নিয়ে চালকল মালিক ও চাল ব্যসায়ীরা বাড়িয়ে দেন চালের দাম, যার খেসারত দিতে হয় চালের ভোক্তাদের। দেরিতে চাল আমদানির সিদ্ধান্তে ভোক্তারা ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকার। ফেব্রুয়ারির শুরুতে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দামে বৃদ্ধি ঘটে। বিশ্বের বৃহত্তম চাল রফতানিকারক দেশ ভারতে ৫ শতাংশ ভাঙা (খুদযুক্ত) মোটা চালের রফতানি মূল্য প্রতি টন ৫২৬ ডলার থেকে বেড়ে ৫৩৭-৫৪৭ ডলারে দাঁড়ায়। থাইল্যান্ডে প্রতি টনে দাম বাড়ে সর্বনিম্ন ১১ ডলার। ভিয়েতনাম থেকে ৫ শতাংশ ভাঙা চালের রফতানি মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ৬৫৩ ডলারে দাঁড়ায়। তিন. দেশে চালের বাজার অনেকটাই চালকল মালিকদের নিয়ন্ত্রণে। তারা ধান কাটা-মাড়াই মৌসুমে সরকার নির্ধারিত দামে কেনা বিপুল পরিমাণ ধান কিনে মজুদ করেন। সরকারকে চাল সরবরাহের দায়িত্ব কেবল চালকল মালিকদের ওপর ন্যস্ত থাকায় তারা কাটা-মাড়াই মৌসুমে কেনা ধানের কিছুটা চালে রূপান্তর করে তা সরকারকে সরবরাহ করে লাভবান হন। বাজারে চাল সরবরাহের দায়িত্বে থেকে তারা মৌসুমে কেনা ধান চালে রূপান্তর করে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন এবং উচ্চ দামে চাল বিক্রি করে প্রচুর লাভ করেন। মুক্ত বাজার অর্থনীতির অজুহাতে সরকার হাত গুটিয়ে বসে থেকে ভোক্তাদের দুঃখ-কষ্ট দেখে।
প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, মোট ধানচাষীর ৮০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক এবং ২০ শতাংশ বড় ও মাঝারি। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা ধারদেনা করে ফসল ফলান। তাদের সংসারে নানা অভাব-অনটন লেগেই থাকে। ফলে ধান কাটার পরপরই বহু কষ্টে ফলানো ফসল বিক্রি করতে বাজারে নিতে হয়। ধান কাটা ও মাড়াই মৌসুম শেষ হওয়ার অল্পদিনের মধ্যে তারা চালের ক্রেতা বনে যান। তথ্য বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩২ শতাংশ শহরাঞ্চলে বসবাসকারী, গ্রামাঞ্চলে ভূমিহীন শ্রমিক, মজুর, ধান কাটার মৌসুম শেষে চাল ক্রেতায় পরিণত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীসহ ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ চাল কিনে খায়।
সরকারি ভাষ্য মোতাবেক, চাষীদের ধান উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে কিছুটা লাভ যোগ করে ধানের দাম এবং চালকল মালিকদের চাল তৈরির ব্যয়ের সঙ্গে কিছুটা লাভ যোগ করে চালের দাম নির্ধারণ করা হয়। তবে ধানচাষীদের দাবি, সরকার নির্ধারিত ধানের দামে তাদের লাভ তো হয়ই না, বরং অনেক সময় উৎপাদন খরচও ওঠে না। প্রতি আমন ও বোরো মৌসুমে সরকারি সংগ্রহ অভিযানে ধান ও চালের দাম কিছুটা বাড়ানো হয়। এমন ব্যবস্থা একদিকে যেমন ধানচাষীদের সমস্যার সমাধান দিতে পারে না, তেমনি অন্যদিকে দেশের ৮০ শতাংশ চাল ক্রেতার দুঃখ-কষ্ট বাড়ায় বৈ কমায় না। এমন ব্যবস্থায় লাভবান হন চালকল মালিক, মজুদদার ও চাল ব্যবসায়ীরা।
সরকারি সংগ্রহ অভিযানে নির্ধারিত চালের দামের সঙ্গে খোলাবাজারে চালের দামের একটি নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। সরকারি সংগ্রহ অভিযানে নির্ধারিত চালের দামের তুলনায় খোলাবাজারে চালের দাম কিছুটা বেশি থাকে। ধান কাটা-মাড়াইয়ের ভরা মৌসুমেও এমন অবস্থার উদ্ভব হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বোরো চাল সংগ্রহ অভিযানে প্রতি কেজি চালের দাম নির্ধারণ হয়েছিল ৪৪ টাকা। বাজারে এর প্রভাব পড়ে। ধান কাটা-মাড়াইয়ের ভরা মৌসুমেই বাজারে মোটা চালের দাম কেজিতে ৫০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। সারা বছর ধরে চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করে। চলতি বোরো মৌসুমে বোরো চাল সংগ্রহ অভিযানে মোটা চালের মূল্য নির্ধারণ হয়েছে প্রতি কেজি ৪৫ টাকা, যা গত মৌসুমের চেয়ে কেজিতে ১ টাকা বেশি। এর অর্থ দাঁড়ায়, চলতি বছর চালের বাজারে অস্থিরতা আরো বাড়বে। মোটা চালের দাম কেজিতে ৫০ টাকার ওপরে থাকবে। এটি মাঝারি ও সরু চালের দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব রাখবে।
ওপরের বর্ণনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, চলতি বোরো মৌসুমে সংগ্রহ অভিযানে ধান ও চালের মূল্যবৃদ্ধি খোলাবাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধিকে উসকে দেবে, যা চালের সাধারণ ভোক্তাদের আর্থিক ক্ষতি ও দুঃখ-কষ্ট বাড়াবে। তাই সংগ্রহ অভিযানে ধান ও চালের গতানুগতিক মূল্যবৃদ্ধির পরিবর্তে দৃষ্টি দিতে হবে ধানের উৎপাদন ব্যয় হ্রাসে। এটা ঠিক, স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারই ধান ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভর্তুকি/প্রণোদনা দিয়ে আসছে। তবে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তায় ধান তথা ধান থেকে তৈরি চালের ভূমিকা বিবেচনায় নিয়ে ধান উৎপাদনে অবকাঠামোগত সুবিধা, বিশেষ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছানো গেলে এবং কৃষি উপকরণ, যেমন উন্নতমানের বীজ, সার, আধুনিক হার্ভেস্টিং মেশিনারি ইত্যাদি ধানচাষীদের অতি অল্প মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করা গেলে তারা কম খরচে ধান উৎপাদন করে তা কম দামে বিক্রি করতে পারবেন। এতে পণ্যটির উৎপাদক তথা ধানচাষী ও ভোক্তা উভয়েই উপকৃত হবেন।
মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব