সরকার পরিবর্তনের পর থেকে টানা কয়েকদিন পুঁজিবাজারের প্রধান সূচক ছিল ঊর্ধ্বমুখী। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল, দীর্ঘকাল পতনের বৃত্তে আটকে থাকা পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে নতুন সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন নেতৃত্বের হাত ধরে। কিন্তু দেশের শেয়ারবাজার এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি! গত আড়াই মাসে এক হাজারের বেশি পয়েন্ট হারিয়েছে পুঁজিবাজার। রোববার দেশের পুঁজিবাজারে প্রায় ৩ শতাংশ দরপতন হয়েছে এবং দিন শেষে ডিএসইএক্স সূচক ৪ হাজার ৯৬৫ পয়েন্টে দাঁড়ায়। গতকালও ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে।
দেশে কভিডের সময় পুঁজিবাজার ৩ হাজার ৬০০ পয়েন্টে নেমে এসেছিল। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা যায়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স ৭ হাজার ৩০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। তবে এর পর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট, ডলার সংকট এমন নানা কারণে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে পুঁজিবাজার। সময়ের পরিক্রমায় কখনো ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেলেও তা দীর্ঘমেয়াদে বজায় রাখা সম্ভব হয়নি।
টানা দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এতে বিনিয়োগ অনেকটাই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। আবার বাড়তি সুদহারের কারণেও পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ সরে যাচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, একসময় পুঁজিবাজার কারসাজির কারণে জাঙ্ক শেয়ারে বিপুল বিনিয়োগ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। এসব শেয়ারের দাম কমায় বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তারা। আবার বিপুল অর্থ হাতে নিয়ে মাঠে নামা কারসাজি চক্রও তাদের টাকা তুলে নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানা যায়। এসবের সমন্বিত প্রভাবে বাজারে তারল্য প্রবাহ কমেছে। অন্যদিকে জাঙ্ক শেয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেকে মার্জিন ঋণ নিয়েছেন। এ অবস্থায় শেয়ারের দাম কমার কারণে মার্জিন ঋণ নেয়া বিনিয়োগকারীরা বেশি আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ফোর্স সেলও হচ্ছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে তাদের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে শেয়ার বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে পুঁজিবাজারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পুঁজিবাজারে করতে সুশাসন বহাল করা যেমন জরুরি তেমনি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো জরুরি হবে। এজন্য পুঁজিবাজারের দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করার পাশাপাশি বিএসইসিকে তৎপর হতে হবে।
বিএসইসির মতে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে টানা দরপতন অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক। সংস্থাটি এরই মধ্যে দরপতনের কারণ তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। দরপতনের কারণ, বাজার অস্থিতিশীল করতে গুজব ছড়ানো ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, অন্যান্য বিষয় খতিয়ে দেখা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করতে কমিটিকে ১০ কর্মদিবস সময় দেয়া হয়েছে। আমরা আশ্বস্ত হতে চাই যে শিগগিরই এ কমিটি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বাস্তবমুখী কিছু সুপারিশ প্রদান করবে এবং বিএসইসি তা আমলে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করবে।
অভ্যুত্থানের মুখে বিগত সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর সময় পেরিয়েছে মোটে আড়াই মাস। এখনো দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। আগে থেকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশের আর্থিক খাতের ওপর গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসে ভাটা পড়েছে। উপরন্তু রাজস্ব আয় কম হওয়ার কারণে সরকারকে ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে অর্থ ধার করে চলতে হচ্ছে, যা সুদের হারকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের পরিবর্তে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বন্ডের দিকে ঝুঁকছেন, যা পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতি রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে সরকারের আন্তরিকতা থাকা জরুরি এবং সরকারের আন্তরিকতার অভাব আছে বলে মনে হয় না। তবে পুঁজিবাজার সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা সমাধানে করণীয় কী হবে সেটি সবসময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠিক করে এসেছে। বর্তমানেও এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। সব অংশীজনের সঙ্গে মিলে পুঁজিবাজারের অবস্থার উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
সরকার এরই মধ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে টাস্কফোর্স গঠনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে শেয়ারবাজারের বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দ্রুত সুফল পাবেন। অতীতের দুরবস্থা ও শেয়ার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সরকার তাদের বিষয়টি বিবেচনা করে সুবিধা দেবে বলে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বিগত সরকারের ১৫ বছর মেয়াদে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো পুঁজিবাজারেও অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। অসংখ্য দুর্বল ও প্রায় অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করে পুঁজিবাজারের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল মৌলভিত্তির, জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ফ্লোর প্রাইস আরোপ, সার্কিট ব্রেকারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমায় বেঁধে দেয়া ইত্যাদি নানা কৃত্রিম ব্যবস্থায় বাজারের এ অবস্থা ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। বিএসইসি গঠিত পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭টি। আশা করা যায়, বাজারের স্বার্থে যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারের অবস্থার উন্নতি হবে।