শারমিন আহমদ, লেখক, গবেষক, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা। ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী। তিনি ১৯৯০ সালে ওয়াশিংটন ডিসির জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেলোশিপ ও উইমেন্স স্টাডিজ স্কলারস অ্যাওয়ার্ডসহ উইমেন্স স্টাডিজে মাস্টার অব আর্টস ডিগ্রি লাভ করেন। তার গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের মধ্যে রয়েছে তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা এবং ৩ নভেম্বর: জেল হত্যার পূর্বাপর। মুক্তিযুদ্ধে তার বাবা তাজউদ্দীনের ভূমিকা এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে মা জোহরা তাজউদ্দীনের ভূমিকাসহ ভবিষ্যতে রাজনীতিতে তাদের থাকা না-থাকাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম
অনেকেই জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকে স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ঘটনা হিসেবে গণ্য করেন। ২০২৪-এর এই অভ্যুত্থান নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানটা আসলে খুবই অনিবার্য একটা ঘটনা ছিল। আজ না হয় কাল এটা হওয়ারই কথা ছিল। দেখুন সব বাড়াবাড়িরই একটা আল্টিমেট পরিণতি থাকে। গণতন্ত্রহীনতাও একটা রাজনৈতিক বাড়াবাড়ি, আর এটারও পরিণতি আছে, যা আমাদের সবার সামনে আজ দৃশ্যমান। নানা অন্যায়-অবিচারে জর্জরিত বাংলাদেশ কিন্তু কারোরই কাম্য নয়। সব ক্ষমতা শেখ মুজিবের পরিবার দ্বারা চালিত হচ্ছিল। তারাই কিন্তু প্রতিবিপ্লবীর ভূমিকাটা গ্রহণ করেছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার কথা বলি, তারা চেতনার কথা বলেন। কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ধারণ করেননি। নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে দেশ কিছুটা এগোলেও গণতন্ত্র কিন্তু প্রতিষ্ঠা পায়নি। বিশেষ করে গত ১৬ বছরে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি, সীমাহীন দুর্নীতি আর বোধহীনভাবে অর্থলুটের বিষয়গুলো ক্ষমতার মসনদে থাকা দলটিকে জনবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এ কারণে এমন বিস্ফোরণটা অনিবার্য ছিল। আমাদের ছাত্রদের যে আন্দোলন ছিল—প্রথমে সেটা ছিল কোটাবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা যে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিল—এ ভাষাটা বোঝা আমাদের জন্য জরুরি। আমি মনে করি, এ গণ-অভ্যুত্থান মূলত মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর বেদনার বহিঃপ্রকাশ।
৫ আগস্ট-পরবর্তী গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংস্কার একটা বড় প্রত্যাশা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও এ রকম দাবি ও প্রত্যাশা ছিল। আপনার বাবা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তখনকার সংস্কার আর এখনকার সংস্কারের আলোচনার মধ্যে মিল-অমিলের ব্যাপারটা যদি একটু বলতেন।
যখন কোনো সরকার বিপ্লবী ধারার মধ্য দিয়ে এসে সরকার গঠন করে। তখন যেকোনো ধরনের সংস্কারই কিন্তু বিপ্লবী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে এবং বিপ্লবী চেতনার ধারক ও বাহক হয়েই সমাধা করতে হবে। যে বিপ্লবী চেতনা আমার বাবা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ধারণ করতেন। উদাহরণ হিসেবে জাতীয় মিলিশিয়া বোর্ড গঠনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মন্ত্রিপরিষদেও তা অনুমোদিত হয়েছিল। বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন কৃষক পরিবারের। তারা ছিলেন প্রমাণিত যোদ্ধা, এজন্য তাদেরকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বিশ্বের সেরা প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে তাদের সুপ্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হবে যাতে তারা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা তিনি শোনেননি। জাতি হিসেবে এটা আমাদের দুর্ভাগ্য, শেখ সাহেব মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস উপস্থিত ছিলেন না। ফিরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদেরই ভয় পাওয়া শুরু করলেন। ওটা কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বললেন, অস্ত্র সারেন্ডার করে বাড়ি ফিরে যাও। তখন ১ লাখ ১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার বাবা শুধু মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন না, ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীও। ১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারেও মুক্তিযোদ্ধাদের ওই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলেন তিনি। কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে দেখলাম, শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করছে, তা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বাড়তে লাগল।
আজকের এ প্রজন্মকে বলব, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন—বিপ্লবের চেতনা কীভাবে প্রতিবিপ্লবীদের হাতে চলে যায়। তার পুনরাবৃত্তি আমরা আর দেখতে চাই না। ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিট যেন নষ্ট না হয়। বৈপ্লবিক সংস্কারকাজ হাতে নেয়া না হলে আমরা বর্তমান সরকারকে বিপ্লবী সরকার বলতে পারি না। বর্তমানে প্রশাসনের নেয়া সংস্কার পরিকল্পনায় কিন্তু আমি এ বিপ্লবী চেতনার ধারক-বাহকের উপস্থিতি দেখছি না। আর এ কারণেই এ সংস্কার নিয়ে আমার আসলে একটা শঙ্কা কাজ করছে। শঙ্কাটা হলো তারা আদতে কতটা সফল হবে? তারা যদি সংস্কারটা করতে চায় তবে জনতা তাদের পাশে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
তাজউদ্দীন আহমদের ন্যাশনাল মিলিশিয়া গঠনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো কেন, তা যদি ব্যাখ্যা করতেন?
সব মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র সমর্পণ করতে বলা হলেও মুজিব বাহিনীর লোকজন কিন্তু অস্ত্র সমর্পণ করেনি। শেখ সাহেব তার অনুগত লোকদের বলে দিলেন যেন তারা অস্ত্র জমা না দেয়। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর মধ্যে বৈষম্যের শুরু হলো। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকের একটি ভিডিও ইন্টারভিউর কথা আমি বলব। সেখানে তিনি বলেছিলেন, মুজিব ভাই তাদের মানা করেছিলেন অস্ত্র জমা দেয়ার ব্যাপারে। মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হলো অস্ত্র জমা দিতে, অথচ যারা প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ করেননি তাদেরকে বলা হলো অস্ত্র রেখে দিতে। এটা আমাদের জাতির ইতিহাসে একটা ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের দিয়েই পরবর্তী সময়ে রক্ষীবাহিনী বানানো হলো। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাকে যখন শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, “আমরা রক্ষীবাহিনী গঠন করতে যাচ্ছি”। তখন আমি তাকে বলেছিলাম, “মি. মুজিব, এটা করা উচিত হবে না। ইউর এক্সিলেন্সি, এটা কিন্তু ভালো হবে না!”।
কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা নিয়েই রক্ষীবাহিনী গঠন করা হলো। এটা কিন্তু দেশের স্বার্থে ছিল না। তাদের মতের বিরুদ্ধে যারা যাবে তাদের শায়েস্তা করার জন্যই এ বাহিনী গঠন হয়েছিল। রক্ষীবাহিনী থেকেই ধাপে ধাপে বাকশালে গিয়ে পৌঁছেছিল।
স্বাধীনতার ঘোষণা আর ঘোষক নিয়ে বিতর্ক চলমান। ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন। তারা শেখ সাহেবকে বেশ চাপাচাপি করলেও কোনো লিখিত ঘোষণা বা অডিও রেকর্ড নিতে পারেননি। তাহলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে কীভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন শেখ মুজিব?
২৫ মার্চ রাত সাড়ে ৭টা কি ৮টার দিকে বাবা মাকে বলে গেলেন যে স্বাধীনতার ঘোষণা তৈরি হয়ে গেছে। আমি গিয়ে মুজিব ভাইয়ের সই আর ঘোষণাটার রেকর্ড নিয়ে আসব। চিঠি ও রেকর্ড ছাত্রদের কাছে দিয়ে আমরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাব। একটা ছাত্রের দায়িত্ব ছিল স্বাধীনতার ঘোষণাসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নথি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া, যাতে সারা বিশ্ববাসীকে তা জানিয়ে দেয়া যায়।
পনের মিনিটের মধ্যে বাবা ফেরত আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই ১৫ মিনিট শেষ হতে সোয়া ৯টা বেজে গিয়েছিল। সবাই তখন একটা ভয়াবহ ক্র্যাকডাউনের আশঙ্কা করছিলেন। খুব কম সময়ের মধ্যে চলে আসার কথা থাকলেও তিনি আসতে অনেক সময় নিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করাতে মাকে বললেন, ‘মুজিব ভাই সাইন করেনি, উনি আত্মসমর্পণ করবেন। উনি বলেন, এই রেকর্ড আর ঘোষণাপত্র নাকি রেকর্ডেড এভিডেন্স হয়ে থাকবে। নানাভাবে বুঝিয়ে আমি উনাকে রাজি করাতে পারিনি।’ মুজিব কাকু বলতে লাগলেন, আমি যাব না, তোমরা যা করার করো। ওদিকে মিসেস মুজিবকে স্যুটকেস গোছাতে দেখা গিয়েছিল। বাবা তখন বলেছিলেন, ‘সমস্ত বিপ্লবের ইতিহাসে দেখা গেছে বিপ্লবী নেতারা চেইন অব কমান্ড রাখে। আপনি কি দলকে বলে যাচ্ছেন, আপনার পরে কে নেতৃত্ব দেবে? কীভাবে সবকিছু পরিচালিত হবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন? আপনি আমাদের সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে আসেন। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করব।’ বাবা এটাও বলেছিলেন, ‘যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়ে কোনো নেতার আত্মসমর্পণের ইতিহাস নেই।’
বাসায় ফিরে এসে বাবা খুব আপসেট ছিলেন। ওদিকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও ৩২ নম্বরে যান। তিনিও শেখ সাহেবকে কনভিন্স করতে ব্যর্থ হন। তিনি তখন চেয়ারে বসে চুরুট টানছিলেন আর সবাইকে বলছিলেন বাসা থেকে চলে যেতে। তাকে রাজি করাতে না পেরে আমাদের বাসায় ফেরত আসেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। বাবা তখন লনে পায়চারি করছিলেন। তিনি বাবাকে বলেন, শেখ সাহেব তো বাড়ি থেকে যাবেন না কিন্তু আপনাকে যেতে হবে।
আপনার বাবাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বেশ কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করেছিল মুজিব বাহিনী। এ ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন?
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের আগেও বাবাকে তো কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। একটার কথা বলি—শেখ মনির উপস্থিতিতে মুজিব বাহিনীর কোর সদস্যদের এক গোপন মিটিংয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে বাবাকে হত্যা করবে। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে বাবাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করেন এমন একজন কৌশলে হত্যার দায়িত্ব নিজে নিয়ে নেন। নির্দেশনা অনুযায়ী পিস্তল নিয়ে কক্ষে ঢুকে তিনি আত্মসমর্পণ করে ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত বলেন। জাতীয় ঐক্য রক্ষা করতে এবং নেতৃত্বের এ সংঘাত যেন মানুষের মনে বিরূপতা তৈরি না করে সেজন্য বাবা এ ঘটনা বাইরে কারো কাছে আলোচনা না করতে আদেশ দিয়ে দেন। এর পরও তো কয়েকবার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল।
৩ নভেম্বর ‘জাতীয় চার নেতার’ জেল হত্যার পেছনে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে মূল হোতা মনে করা হয়। এ ব্যাপারে আপনার কী বক্তব্য?
যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও খন্দকার মোশতাক মুক্তিকামী সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি বিভিন্ন মাধ্যমে আগেই টের পেয়েছিলেন। তিনি মোশতাককে নজরদারি করতে কামাল সিদ্দিকীকে তার ব্যক্তিগত সহকারী নিয়োগ করা হয়। সে সহকারী মোশতাকের আমেরিকা প্রীতি বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারটা বাবাকে অবহিত করেন। পরবর্তী সময়ে এটাসহ নানা অভিযোগে কিন্তু তার মন্ত্রিত্ব চলে যায়। এ ঘটনা একটা শত্রুতার সূত্রপাত ঘটায়, যা বাবাসহ জাতীয় চার নেতার হত্যার কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সত্য।
আমরা জানি যে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন ব্লক ও গ্রুপের সঙ্গে রিকনসিলিয়েশন বা আপসরফার কথা উঠেছিল। ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী আওয়ামী লীগের সঙ্গে কীভাবে রিকনসিলিয়েশন হতে পারে বলে মনে করেন?
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের রিকনসিলিয়েশনের পেছনে ছিল জাতীয় স্বার্থ। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্টতার জন্য আমার বাবা দল-মতের বাইরে গিয়ে চিন্তা করেছেন। তার ফোকাস ছিল শুধু জাতীয় উন্নয়ন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এ সময় প্রতিশোধপরায়ণ হওয়ার অর্থ জাতির মধ্যে বিভেদ তৈরি করা, আর এ বিভেদ বহিঃশত্রুর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রাজাকার পরিবারের যারা অন্যায়-অপরাধে জড়িত ছিল না তাদের প্রতি সদয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় যা যা প্রয়োজন সবকিছু করার মাধ্যমেই বাবা রিকনসিলিয়েশন খুঁজেছেন। এবার আসি আওয়ামী লীগের রিকনসিলিয়েশন ব্যাপার নিয়ে। এটা আসলে শুরু হতে হবে তাদের আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে। তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিকতা এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। অপরাধমূলক কাজে যারা জড়িত ছিল তাদের চিহ্নিত করে দল থেকে সরিয়ে বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমে রিকনসিলিয়েশন হতে পারে। যারা জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে তাদেরকে দলের নেতৃত্ব দেয়ার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে হতে পারে। অপরাধীর বিচার না করে কোনোভাবেই কোনো রিকনসিলিয়েশন সম্ভব না।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ বিবেচনায় আপনার রাজনীতিতে আসার কোনো ইচ্ছা আছে কি?
আমার সহজ আর সাবলীল উত্তর হলো, আমি রাজনীতিতে আসতে চাই না। কারণ আমাদের এ আদর্শের রাজনীতিটা সবসময়ই অন্যের পথে সব সময়ই বাধা সৃষ্টি করে। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বশূন্য আওয়ামী লীগকে আমার মা নিজ সন্তানের মতো গড়ে তুলেছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়েছেন। অথচ পরবর্তী সময়ে আবদুর রাজ্জাকরা আমার মায়ের ভূমিকাকে অস্বীকার করল। তারা হাসিনা (শেখ হাসিনা) আপাকে নিয়ে এল। এ কথা মনে হলেই ওয়াজেদ মিয়ার (শেখ হাসিনার স্বামী) একটা উক্তি মনে পড়ে। ১৯৮০ সালে একদিন তিনি আম্মাকে বলেছিলেন, ‘আপনারা ওকে (হাসিনাকে) রাজনীতিতে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? ও তো রাজনীতির কিছু বোঝে না, সবকিছু নষ্ট করে দেবে।’
আমার মা জোহরা তাজউদ্দীন পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতৃত্বকে নিয়ে সারা বাংলায় আওয়ামী লীগ দলটির পুনর্গঠনে কাজ করেন। যখনই দলে একটু স্বস্তি এল তখন স্বল্পসংখ্যক স্বার্থান্ধ ব্যক্তি পারিবারিক আবেগের কথা ছড়িয়ে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করায়। অনেকে আমার মাকে হাসিনার আগমনের বিরোধিতা করতে বলেছেন। মায়ের উত্তর ছিল, এ দল আমার সন্তানের মতো, মা হিসেবে আমি একে বিভক্ত হতে দিতে পারি না।
আপনার পরিবারের এক সদস্য তো কয়েকটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
এখানে কিছু বিষয় পরিষ্কার করে দেয়া জরুরি। হাসিনা আপা সোহেলের (সোহেল তাজ) পদত্যাগের পর আমাকে ও রিমিকে (সিমিন হোসেন) বহুবার সরকারে লোভনীয় পদ-পদবিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি যাইনি। কাউকে না পেয়ে আমার ছোট বোনের ওপর বেশি চাপ দেয়া হয়েছিল। হাসিনা আপা, রেহানা আপা আমাদের বাসায় চলে এসেছিলেন এবং রিমিকে নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এছাড়া কাপাসিয়াবাসীর কাছ থেকেও দাবি ছিল, সোহেল পদত্যাগের পর অনেক মন্দ লোক নির্বাচনী দৌড়ে নেমে গিয়েছিল। এলাকাবাসীর প্রতিনিধিদের নিয়ে সংলাপ করার পর জনমানুষের ইচ্ছার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হয়েছিল রিমি।