সময়ের ভাবনা

শিশুর চোখে চশমা : প্রতিকারে করণীয়

কিছুদিন আগে আমার পাঁচ বছরের মেয়েকে চোখের ডাক্তার দেখাই। চোখে বালি পড়ে চুলকাচ্ছিল বলে ডাক্তারের কাছে নেয়া। ডাক্তার বলল, ‘একটি ড্রপ দিলে চুলকানো সমস্যা চলে যাবে। তবে চোখ ঠিক আছে কিনা তা একটু পরীক্ষা করে দেখতে চাই’। পরীক্ষা শেষে ডাক্তার বলল, ‘চোখে সমস্যা আছে, চশমা পরতে হবে। চশমা না পড়লে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যা হবে’।

কিছুদিন আগে আমার পাঁচ বছরের মেয়েকে চোখের ডাক্তার দেখাই। চোখে বালি পড়ে চুলকাচ্ছিল বলে ডাক্তারের কাছে নেয়া। ডাক্তার বলল, একটি ড্রপ দিলে চুলকানো সমস্যা চলে যাবে। তবে চোখ ঠিক আছে কিনা তা একটু পরীক্ষা করে দেখতে চাই। পরীক্ষা শেষে ডাক্তার বলল, চোখে সমস্যা আছে, চশমা পরতে হবে। চশমা না পড়লে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যা হবে

এত অল্প বয়সে চশমা পরতে হবে শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে তো স্মার্টফোনে তেমন একটা সময় কাটায় না, ভিডিও গেমস খেলে না, বাসায় টিভি নেই বলে কার্টুন দেখার সুযোগ নেই, নিয়মিত শাকসবজি খায়, আমাদের জানা মতে চোখে কোনোদিন আঘাত পায়নি, তার পরও কেন চোখে সমস্যা। ডাক্তারকে জিজ্ঞাসারলে তিনি বলেন, কোনো কোনো শিশু চোখে সমস্যা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে, আপনার মেয়ের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে

আমার ধারণা, আমাদের দেশে বহু মা-বাবাই জানেন না যে তাদের শিশুর চোখে সমস্যা রয়েছে। কিন্তু যখন সমস্যা ধরা পড়ছে, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে যায়, চোখের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। অথচ চার বছর বয়সে যদি ডাক্তার দেখানো যেত তাহলে অনেক সমস্যা এড়ানো যেত। বেশির ভাগ মা-বাবাই মনে করেন, শিশু তো দেখতে পাচ্ছে, খেলাধুলা-চলাফেরাসহ সবকিছুই করছে, তাহলে ডাক্তার দেখাতে হবে কেন?

আমি চক্ষু বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু যেহেতু প্যারেন্টিং বিষয় নিয়ে লেখালেখি করি, তাই এ বিষয়ে আমার কৌতূহল তৈরি হলো। আমার মনে প্রশ্ন জাগলছোট শিশুদের চোখে চশমা পরার হার এভাবে বেড়ে যাচ্ছে কেন? আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে তো এত চশমা পরতে হয়নি। তাহলে কি এটা মহামারী পর্যায়ে চলে যাচ্ছে?

বিস্তারিত জানার জন্য পরিচিত চক্ষু ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বললাম। ইন্টারনেটে বেশকিছু প্রবন্ধ পড়লাম। তারপর যা বুঝলাম, তা সহজ ভাষায় আপনাদের কাছে তুলে ধরলাম। আশা করি, অভিভাবকরা এ লেখা থেকে সচেতন হতে পারবেন, ছোট শিশুর চোখের ভবিষ্য বিপর্যয় থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবেন।

বর্তমানে শিশুদের মোটাদাগে তিন ধরনের চোখের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। প্রথমটি জন্মগত, দ্বিতীয়টি ভিটামিন’-এর অভাবে রাতকানা রোগ, তৃতীয়টি দূরের জিনিস না দেখা বা ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যা বা মায়োপিয়া। ডাক্তারদের মতে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে লেজি আই বা অলস চোখ, যদিও অনেক ক্ষেত্রে এটা বংশগত সমস্যা।

জন্মের পর শিশুর দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। প্রতিনিয়ত দেখার ফলে চোখের লেন্স দিয়ে আলো রেটিনায় গিয়ে পড়লে আলোকসংবেদী কোষগুলো উদ্দীপ্ত হয়, পরিপূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু কোনো কারণে (জন্মগত ছানি বা ট্যারা, ঘোলা লেন্স, চোখের পাতার গঠনগত সমস্যা ইত্যাদি কারণে) রেটিনায় আলো প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলে তখন ওই চোখের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এটাই লেজি আই বা অলস চোখ।

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে দূরের জিনিস দেখতে না পাওয়া বা ঝাপসা দেখা। এ সমস্যাই এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। করোনা মহামারীর পর এ সমস্যা বেড়ে গেছে। বলা যায়, এক মহামারী অতিক্রম করে আরেকটি মহামারীর দিকে যাচ্ছি আমরা।

প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এ ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর একটি কারণ হচ্ছে, এ প্রজন্মের শিশুরা দূরের জিনিস দেখে না অথবা দেখার সুযোগ পায় না। সারাক্ষণ ঘরে বন্দি থাকার কারণে চার দেয়ালের বাইরে গিয়ে আকাশ অথবা দূরদিগন্ত দেখার সুযোগ পায় না। এছাড়া কম্পিউটার-ট্যাব-মোবাইল স্ক্রিন বেশিক্ষণ সময় কাটানোর ফলে একটা সময় আসে শিশু দূরের বস্তু বা জিনিস দেখতে পায় না। কারণ দূরের জিনিস না দেখতে দেখতে শিশুর চোখের ফোকাল দূরত্ব একসময় সীমিত হয়ে যায়।

একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে মোবাইল-টিভি-কম্পিউটার স্ক্রিন- সবকিছু মিলিয়ে এখন শিশুদের চোখে বেশি চাপ পড়ছে। খোলা মাঠে খেলতে না পারা, সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় না যাওয়া, কাছে বা দূরের সবুজের দিকে না তাকানো ইত্যাদি কারণেও চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ভিটামিন বি১২-এর ঘাটতিজনিত কারণেও দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে পারে।

প্রথম দিকে অভিভাবকরা শিশুর চোখের সমস্যা ধরতে পারে না। শিশুরাও কখনো বলেনি যে চোখে কম দেখতে পাচ্ছে বা ঝাপসা দেখছে। শিশুর বয়স এতই কম থাকে যে শিশু এ সমস্যা বুঝতে পারে না। স্কুলে ভর্তির পর শিশু যখন বোর্ডের লেখা দেখতে পায় না, তখন অভিভাবকরা ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারেন শিশুর চোখে সমস্যা। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে যায়।

অথচ এ সমস্যা যদি চার বছরের মধ্যে শনাক্ত করা যায়, তাহলে দ্রুত সারিয়ে তোলা সম্ভব। লেজি আই বা অলস চোখ সমস্যা ছয় বছরের মধ্যে চিকিৎসা করাতে পারলে ভালো, তারপর যত দিন যায় চিকিৎসা তত জটিল হতে থাকে। নয় বছর পেরিয়ে গেলে তেমন ফল পাওয়া যায় না। জন্মগত ছানি থাকলে তা অবশ্যই নয় বছরের মধ্যে অপারেশন করাতে হবে।

তাই যেকোনোভাবেই হোক, চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই এ চোখের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা দরকার। প্রাথমিকভাবে এ দায়িত্ব অভিভাবকদেরই নিতে হবে। শিশু যদি দূরের জিনিস দেখতে না পায় বা ঝাপসা দেখে, চোখের কালো মণি ধূসর বা সাদা দেখায়, খুব কাছ থেকে টেলিভিশন দেখার চেষ্টা করে, ঘন ঘন চোখে হাত দেয়া অথবা চোখ পিটপিট করা, স্কুলে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা বুঝতে না পারে অথবা শিশু যদি মাথাব্যথার কথা বলে, তাহলে অতিদ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে।

আরো ভালো হয়, যদি জন্মের পর শিশুকে একজন চক্ষু ডাক্তার দিয়ে দেখিয়ে নিতে পারেন। চোখে ছানি অথবা অন্য কোনো সমস্যা থাকলে তিনি সহজেই তা বুঝতে পারবেন। সমস্যা থাকুক আর না-ই থাকুক, চার বছরের মধ্যে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে গিয়ে চোখের পরীক্ষা করাবেন।

চোখে যদি সমস্যা ধরা পড়ে তাহলে ডাক্তারের নির্দেশনা অনুসারে নির্দিষ্ট পাওয়ারে চশমা পরতে হবে। রাস্তার ধারে যেনতেন দোকান থেকে চশমা নেয়া যাবে না। দোকান সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তবেই চশমার লেন্স লাগাবেন। ডাক্তারদের অভিযোগ করেন, অভিভাবকরা শিশুদের চশমা পরাতে চান না অথবা শিশু ঠিকমতো চশমা পরছে কিনা এ ব্যাপারে গাফেল থাকেন। আসলে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের শৈথিল্য বা গাফিলতি করার সুযোগ নেই। কারণ আপনার গাফিলতি শিশুর ভবিষ্য নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।

প্রাইমারি স্কুলগুলো সরকারি ব্যবস্থায় চোখ পরীক্ষার (চোখ স্ক্রিনিং) ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উন্নত বিশ্বে স্কুলে ভর্তির পরই শিশুদের চোখের পরীক্ষা করা হয়। আমাদের দেশেও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও সীমিত পরিসরে শিশুদের চোখ পরীক্ষা করছেন। তবে তা বাস্তব প্রয়োজনের তুলনায় একবারেই নগণ্য। প্রতিটি স্কুলেই শিশুদের চোখ পরীক্ষার জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষকদের যদি এ কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, তাহলে তা হবে মাইলফলক একটি পদক্ষেপ।

আরো কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যদি গ্রহণ করা যায়, তাহলে ক্ষীণদৃষ্টির হাত থেকে অনেক শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব। ছোট শিশুদের রঙিন শাকসবজি ও ছোট মা খাওয়াতে হবে। শিশুকে কাছের জিনিস ও দূরের জিনিস দুটোই দেখতে দিতে হবে। প্রয়োজনে ছাদে গিয়ে সূর্যের আলোয় দূরের জিনিস দেখাতে হবে। ঘুম থেকে উঠে সবুজ গাছের পাতা বা ঘাস দেখাতে পারেন অথবা দূরের জিনিস দেখান। শিশুকে যদি সূর্যের আলোয় বেশি সময় খেলাধুলার সুযোগ দেয়া যায়, এ সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।

তবে সবার আগে প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা। সরকারেরও উচিত এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া, যাতে এ সমস্যা মহামারীর দিকে না যায়।

শ্যামল আতিক: প্যারেন্টিং গবেষক, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন

আরও