সৃষ্টির আদিম পেশা কৃষি। আর কৃষির সৃষ্টি নারীর হাত দিয়ে। প্রাগৈতিহাসিক কালের কোনো একসময় মাটিতে বীজের অঙ্কুরোদ্গম দেখে নারী আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। আর সেটাই ছিল কৃষির সূচনা। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ফসলের বীজ বপন করেছিল নারী। অরণ্যজীবী যাযাবর মানব সম্প্রদায়কে কৃষিকাজের মাধ্যমে স্থিতি এনে দিয়েছিল নারী। আদিমকালে খাদ্য সংগ্রহ করা হতো মূলত দুভাবে। প্রথমত আহরণ, দ্বিতীয়ত শিকার। মূলত ৮০ ভাগ খাবার সংগ্রহ করা হতো আহরণের মাধ্যমে, বাকি ২০ ভাগ খাবার সংগ্রহ করা হতো শিকার হতে। বনজঙ্গল থেকে ফলমূল, খাবার আহরণের পুরো কাজটি করত নারী। অন্যদিকে শিকারের কাজটি করত পুরুষরা। নারীও শিকারে অংশগ্রহণ করত এবং পুরুষদের শিকারে সহায়তা করত। একই সঙ্গে শিকার ও খাদ্য আহরণের অভিজ্ঞতা থাকায় বীজ থেকে ফসল উৎপাদন এবং বন্যপ্রাণীকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করার কাজটি নারী সহজে আয়ত্তে এনেছিল।
বাংলাদেশের কৃষিতে নারীর অবদান কী তা বোঝার জন্য খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই। আমরা একটি গ্রামীণ পরিবারের দিকে তাকালে বিষয়টি সহজে অনুধাবন করতে পারব। ভোরের কর্মব্যস্ততা দিয়ে শুরু হয় গ্রামীণ নারীর প্রাত্যহিক কার্যক্রম, যা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। একজন গ্রামীণ নারী খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরবাড়ি-উঠোন ঝাড়ু দেন, গোয়াল ঘর পরিষ্কার করে, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুকে খাবার দেয়, আর সব ময়লা-আবর্জনা জড়ো করে বাড়ির সন্নিকটে কোনো একটি গর্তে। আবার অন্যান্য গৃহস্থালি বর্জ্যও সেখানে ফেলেন, যেগুলো পরবর্তী সময়ে জৈবসারে পরিণত হয়, যা কৃষকরা তাদের জমিতে ব্যবহার করেন। কৃষিতে এ জৈবসার ব্যবহারের বিষয়টি নারী কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রযুক্তি।
সামাজিক কারণে বসতবাড়ির মাঝে গ্রামীণ নারীরা বেশি সক্রিয়, তাই তাদের কৃষি কার্যক্রম সমাজের কাছে দৃষ্টিগোচর নয়। প্রতিটি গ্রামীণ বাড়িতে নারীরা বসতবাড়ির আঙিনায় শাকসবজি ও ফল-ফুলের গাছ লাগিয়ে থাকে। ঘরের চালে পুঁইশাক, লাউ কিংবা মিষ্টিকুমড়া, বাড়ির আঙিনায় বরবটি বা শিম, উঠোনে দু-চারটি মরিচগাছ, ঘরের পেছনে কচু কিংবা মেঠেআলু এ ধরনের নানা শাকসবজি আমরা গ্রামীণ বাড়িতে দেখতে পাই। বসতবাড়ির কোনায় কিংবা পুকুরপাড়ে থাকে বাঁশঝাড়। শুধু কি তাই, রয়েছে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, পেঁপে, কলা, সুপারি, নারকেলসহ নানা ধরনের ফলের গাছ। বাড়ির সন্নিকটে থাকে দু-চারটি ফুলের গাছ আর অদূরে লাগানো হয় কড়ই, নিমসহ নানা ধরনের কাঠের গাছ। মূলত প্রয়োজন থেকে গ্রামীণ নারীরা এ চাষাবাদ করে থাকে। কিন্তু বসতবাড়ির কোথায় কোন ফসল লাগানো হবে, গ্রামীণ নারীরা তার যে নকশাটি এঁকেছে তা থেকে অকপটে বলা যায়, আজকের কৃষি বনায়ন বা সামাজিক বনায়নের যে ধারণা তাও এসেছে নারীদের কাছ থেকে।
উৎপাদিত ফল-ফসলকে অনিষ্টকারী পোকামাকড় ও রোগজীবাণু থেকে রক্ষা করতে হবে। কীভাবে করা যায় তার ধারণাও এসেছে গ্রামীণ নারীর উন্নত চিন্তাভাবনা থেকে। আমরা দেখি, শিমগাছে জাব পোকার আক্রমণ দেখা দিলে নারীরা ঘরের চুলা থেকে ছাই নিয়ে তা গাছে ছিটিয়ে দেন। ফলে পোকামাকড়ের আক্রমণ কমে আসে। আবার শস্যদানা ও ফসলের বীজ সংরক্ষণের সময় এগুলোর সঙ্গে বিষকাটালী কিংবা নিমপাতা রেখে দেন। ফলে এতে পোকামাকড়ের আক্রমণ হয় না। এ দুটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিও গ্রামীণ নারীদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি। আমরা লক্ষ করি, নারীরা ভালো জাতের ফলের বীজ থেকে চারা করে থাকে। কাঁঠালের ক্ষেত্রে এটি বেশি লক্ষ করা যায়, যা গ্রামীণ নারীদের উদ্ভিদ প্রজনন সম্পর্কে তাদের দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা দেয়।
কৃষিকাজে শ্রম বিভাজন দৃশ্যমান। ফসলের প্রাক-বপন প্রক্রিয়া হতে শুরু করে ফসল সংরক্ষণ পর্যন্ত সর্বত্র নারীর ভূমিকা বিদ্যমান। ধানের বীজ সংরক্ষণ, রোদে শুকানো, বীজতলা তৈরি, ফসল সংগ্রহোত্তর যাবতীয় কার্যক্রম মাড়াই, ঝাড়াই, বাছাই, সেদ্ধ করা, সংরক্ষণ, খড় শুকানো প্রভৃতি সব কাজই গ্রামীণ নারীরা করে থাকে। ধান উৎপাদন থেকে গোলায় তোলা পর্যন্ত ২৪ ধাপের মধ্যে ১৮টিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বিদ্যমান। সার্বিক কৃষির ২১টি কাজের মধ্যে ১৭টিই করে থাকে নারীরা। এতসবের পরও কৃষক বলতে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক দৃশ্যপটে একজন পুরুষের ছবিই ভেসে উঠে। বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পেছনে অদৃশ্যমান অংশটি হলো কৃষিতে গ্রামীণ নারীর অবদান।
গ্রামীণ নারীর সব কাজকে কেবল গৃহস্থালি কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাহাড়ি অঞ্চলে জুমচাষ, চা বাগানে চাষবাসও করে থাকে নারীরা। উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ, পোনা উৎপাদন, জেলে পল্লীতে শুঁটকি ও নোনামাছ প্রক্রিয়াজাত, জাল বোনার কাজটিও নারীরা করে থাকে। এছাড়া গ্রামীণ নারীরা বসতবাড়ির পুকুরের মাছের খাবার দেয়া, পাহারা দেয়া, বড়শি দিয়ে মাছ ধরে পারিবারিক চাহিদা মেটানোর কাজ করে থাকে। বসতবাড়িতে হাঁস-মুরগি, কোয়েল, কবুতর পালন, গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া প্রতিপালনের কাজটিও গ্রামীণ নারীরা করে থাকে। যা থেকে পরিবারের সদস্যদের পুষ্টিচাহিদা নিশ্চিত হয়। আবার এ থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ মেটান, ভবিষ্যতের সঞ্চয় করেন। আবার ‘মুষ্টি চাল’ সঞ্চয়ের মাধ্যমে পরিবারের ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবতে হয় গ্রামীণ নারীকে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিম বিক্রি কিংবা দুধ বিক্রির টাকা পুরুষরা নিয়ে নেয় এবং নারীদের বঞ্চিত করে। স্বামী পরিবারের ভরণপোষণ করে বলে এ অর্থ তার প্রাপ্য হিসেবে ধরে নেয়া হয়। পরিবারের এ অর্থ উপার্জনের পেছনে নারীর শ্রম-সময়কে অস্বীকার করা হয়, অবহেলা করা হয়।
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। কৃষিই বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। সময়ের আবর্তনে শিল্প-কারখানার বিকাশ ঘটলেও গ্রামীণ জীবিকা ও অর্থনীতি কৃষিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে কৃষিতে যে নীরব বিপ্লব ঘটেছে তা হলো নারীদের ব্যাপক হারে কৃষিতে অংশগ্রহণ। শুধু যে অংশগ্রহণের হার বেড়েছে তা কিন্তু নয়। নারীরা আজ কৃষিকাজের পরোক্ষ ভূমিকায় নেই, অংশ নিচ্ছে চাষাবাদের শুরু থেকে ফসল সংরক্ষণ এবং বিপণনকাজেও। আর এ পরিবর্তিত ভূমিকায় নারীর সরব উপস্থিতি খুব সহজে বা স্বেচ্ছায় হয়নি। অনেকগুলো পরিপ্রেক্ষিত ও কার্যকারণের ধারাবাহিকতায়, যেমন ভূমিহীনতা, অলাভজনক কৃষি, পুরুষ সদস্যদের শহরমুখী বা ভিন দেশে অভিবাসন ইত্যাদি কারণে বিগত বছরে নারী ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছে, হাল ধরেছে গ্রামীণ কৃষির। তাই বলা চলে, কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী।
মজুরি বিবেচনায় দেশের কৃষিতে নারীর দুই ধরনের অংশগ্রহণ বিদ্যমান। প্রথমটি হলো, সম্পূর্ণ অবৈতনিক কিংবা মজুরিবিহীন পারিবারিক নারী কৃষি শ্রমিক। অন্যটি স্বল্প মজুরিভিত্তিক নারী কৃষি শ্রমিক বা দিনমজুর। আমরা ওপরে গ্রামীণ নারীর প্রাত্যহিক কৃষিকাজের যে বিবরণ তুলে ধরেছি তা সম্পূর্ণভাবেই মজুরিবিহীন ও অবৈতনিক। এসব কাজকে নারীর প্রাত্যহিক পারিবারিক কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। যেখানে মজুরি নেই, সেখানে স্বীকৃতির বিষয়টি অবান্তর। আর দ্বিতীয়টি হলো বৈষম্যমূলক মজুরি ব্যবস্থা। কৃষিজমিতে ফসল উৎপাদন, সংগ্রহ কিংবা সংগ্রহোত্তর কার্যক্রমে নারী-পুরুষ একই কাজ করলেও পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারীর পারিশ্রমিক কম। গত বছর কৃষিতে একজন পুরুষ শ্রমিকের গড় মজুরি ছিল ৪১৮ টাকা, সেখানে নারী পেয়েছে ৩১৬ টাকা। বড় জেলা শহরগুলোয় নারীদের পারিশ্রমিক একটু বেশি। কিন্তু বাকি জেলায় তা ২০০-২২০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাধারণত নারীরা বাড়ি থেকে দূরে কাজে যেতে চায় না, তারা বাড়ির আশপাশে চাতালকল কিংবা কৃষিজমিতে কাজ করে থাকে। এ অসহায়ত্বকে পুঁজি করে মালিক পক্ষ তাদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে থাকে। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মানুষ যারা কাজ করছে, কাজ করছে না কিন্তু কাজ খুঁজছে— জনগোষ্ঠীর এমন অংশকে শ্রমশক্তি হিসেবে ধরা হয়। শ্রমশক্তির সংজ্ঞানুযায়ী, ২৯ শতাংশ নারী কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাকিরা নিশ্চিতভাবে নানা অবৈতনিক পারিবারিক কাজে নিয়োজিত থাকার পরও শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে অদৃশ্য থাকছে। সিএসআরএলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ নারী গৃহকর্মে সরাসরি অবদান রাখছে। এদের অনেকে কিষাণী, তবে তা শ্রমশক্তির বিবেচনায় ‘অদৃশ্য’। (বাকি অংশ আগামীকাল)
আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ: অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়