অভিমত

গ্রামীণ কৃষির বিকাশে এজেন্ট ব্যাংকিং

এখনো দেশের সিংহভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। এ সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের একশ্রেণীর লোভী জনপ্রতিনিধি, ঘুষখোর আমলা, ব্যাংক কর্মচারী গরিব অসহায় মানুষের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বলয় ভাতার টাকা আত্মসাৎ করে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত করছেন। গ্রাহকের স্বাক্ষর ও টিপসই জাল করে ব্যাংক থেকে সম্পূর্ণ

এখনো দেশের সিংহভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের একশ্রেণীর লোভী জনপ্রতিনিধি, ঘুষখোর আমলা, ব্যাংক কর্মচারী গরিব অসহায় মানুষের বিভিন্ন সামাজিক  নিরাপত্তা বলয় ভাতার টাকা আত্মসাৎ করে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত করছেন। গ্রাহকের স্বাক্ষর টিপসই জাল করে ব্যাংক থেকে  সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আত্মমর্যাদাহীন ওইসব জনপ্রতিনিধি উপকারভোগীদের টাকা তুলে নিয়ে তাদের বঞ্চিত করছেন। সারা দেশে অহরহই ঘটছিল এই ঘৃণিত গরিব ঠকানোর কার্যক্রম। ভিজিএফ কর্মসূচির গম চুরি নিয়ে একসময় সারা দেশে সমালোচনার ঝড় উঠলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা গরিব মানুষের পাঁচ কেজি গমের লোভ সামলাতে পারে না, তাদের জনপ্রতিনিধি নয়ভিক্ষা করে খাওয়া উচিত।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চরম সত্য কথাটিই উচ্চারণ করেছেন। এজন্য  তাকে  আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। শুধু আমরা নই, গরিব অসহায় ভিজিএফ কার্ডধারী মানুষগুলো চিরদিন মনে রাখবে তার এই সাহসী উচ্চারণ। তার দীর্ঘায়ু কামনা করে প্রার্থনা করবে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে। 

এসব দুর্নীতি বন্ধের উদ্দেশ্যে এবং মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি এজেন্ট ব্যাংকিং চালু ব্যাংকিং জগতে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় হিসাব খুলেছেন মোট ৮২ লাখ গ্রাহক। আর সদ্যসমাপ্ত ২০২১ সালের একই সময়ে  গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় কোটি ৩০ লাখ। মাত্র এক বছর সময়ের ব্যবধানে ৫০ লাখ নতুন গ্রাহক সৃষ্টি সহজ কাজ নয়। এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আট বছরে সারা দেশের গ্রামগঞ্জ  হাটবাজারে সাড়ে ১৩ হাজার এজেন্ট ১৮ হাজার আউটলেট সেবা দিচ্ছে। ২০০২ সালের মার্চ-এপ্রিলে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতা আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সে সময় প্রথম দিকে ব্যাংকের শাখাগুলো বন্ধ থাকলেও এজেন্ট ব্যাংকগুলো খোলা ছিল। চালু ছিল আর্থিক দেনদেন। ওই মহাদুর্যোগকালে বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকগুলো  দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে  সক্ষম হয়। এতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর মানুষের আস্থা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় বিশ্বাস। ফলে করোনাকালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সেবায় ভালো প্রবৃদ্ধি হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এজেন্ট ব্যাংকগুলোর সেবা দিত ২৪টি ব্যাংক। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯টিতে। ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারেও  সেবা দেয়া হচ্ছে। 

বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকগুলো আমানত গ্রহণ, ঋণ বিতরণ  বিদেশ থেকে প্রবাসীদের  পাঠানো রেমিট্যান্স সুবিধাভোগীদের দিচ্ছে। পাশাপাশি স্কুল ব্যাংকিং সেবাসহ সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতাও বিতরণ করছে এজেন্ট ব্যাংকগুলো। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবা ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি নারীদের ব্যাংকিং গ্রাহক হওয়ার প্রবণতা বাাড়ছে। ফলে দেশে মোট ব্যাংক হিসাবের মধ্যে এখন প্রায় ২৫ শতাংশ নারী গ্রাহকের। আবার এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মোট গ্রাহকের মধ্যে ৬০ লাখ ৪২ হাজার ৯৪৬ জন বা ৪৭ শতাংশই নারী। জানা যায়, এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর ভাতা বিতরণের সুবাদেই নারী গ্রাহকের সংখ্যা বেশি বেড়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংক এশিয়া পর্যন্ত পায় ৫০ লাখ জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে এসেছে, যার মধ্যে ৬৩ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক নারী। এদের মধ্যে অনেকেই নিজেরা উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। 

দেশের অর্থনৈতিক পটপরিবর্তনে, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির সমৃদ্ধি আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে এজেন্ট ব্যাংকিং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশের প্রচলিত শাখাভিত্তিক ব্যাংকিং ধারণায় বিশেষায়িত ডিজিটাল ব্যাংকিং পদ্ধতি একটি নতুন সংযোজন। খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসে যখন  কৃষকের মাঠের ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়, অর্থের অভাবে কৃষক যখন দুর্যোগ-পরবর্তী ফসলের চাষ করতে পারেন না, কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন, নিজের সন্তানের পড়াশোনা এবং ভরণ-পোষণের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খান, তখন কৃষকদের দুর্যোগ থেকে বাঁচানোর জন্য দ্রুত কৃষিঋণ বিতরণ জরুরি হয়ে পড়ে। ওই সময় গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প খুলে কৃষিঋণ বিতরণের কথা বলা হয়। সুগার মিলে চাকরির সুবাদে জীবনে আমি আখচাষী আখ চাষের সঙ্গে জড়িত ছিলাম ৩৪ বছর। কৃষিঋণ বিতরণ  আদায়ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। কোনো কোনো চিনিকলে চার-পাঁচ হাজার কৃষককে শস্য বন্ধকীকরণ চুক্তির মাধ্যমে কৃষি উপকরণ, বিশেষ করে সার, বীজ, বালাইনাশক এবং নালা কাটা সেচের জন্য নগদ ঋণ দেয়া হতো - কোটি টাকা। চিনিকলের কৃষি বিভাগের মাঠকর্মীরা কৃষকের বাড়ি গিয়ে সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন করে সার, বীজ, কীটনাশকের ভাওচার দিয়ে আসেন। কৃষক সেই ভাউচারের মাধ্যমে নিকটবর্তী আখ ক্রয়কেন্দ্রের গুদাম থেকে উপকরণ তুলে নেন। উপকরণের জন্য কৃষককে মাঠকর্মীদের পেছনে পেছনে ঘুরতে হয় না। ঋণের টাকা কৃষক মিলে আখ সরবরাহের মাধ্যমে পরিশোধ করেন। সরবরাহকৃত আখের মূল্য থেকে ৬০-৭০ শতাংশ ঋণ কেটে বাকি টাকা কৃষককে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে চিনিকলগুলোয়। এটিও এক ধরনের এজেন্ট ব্যাংকিং। পদ্ধতির আগে কৃষকদের সপ্তাহে একদিন বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে ক্যাশিয়াররা আখের দাম দিতেন। আর মিল গেট কেন্দ্রে প্রতিদিনই ক্যাশিয়াররা আখের দাম কৃষকদের দিয়ে দিতেন। দেখা গেছে প্রতি মৌসুমে বিনিয়োগকৃত ঋণ শতভাগ আদায় হতো। সুগার মিলের আখ উন্নয়ন সহকারী বা সিডিএরা ঋণ প্রদান আদায় করতেন। এমন অনেক  সিডিএ আছেন, যাদের চাকরিজীবনে টাকাও কৃষিঋণ অনাদায়ী থাকেনি। বগুড়া পীরগাছা উপজেলার এমন একজন সিডিএ পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হয়েছিলেন, তার নাম মো. রফিকুল ইসলাম। তাকে তার ঋণ আদায়ের সফলতার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ঋণ দেয়ার মধ্যেই আদায়। সঠিক কৃষক নির্বাচন ঋণ উপকরণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করে শতভাগ কৃষিঋণ আদায় সম্ভব। 

আমদানিনির্ভর ডাল, তেল, মসলাজাতীয় ফসল ভুট্টা চাষে  শতাংশ রেয়াতি সুদে কৃষিঋণ প্রদানের সরকারি সিদ্ধান্ত থাকলেও বেসরকারি  রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নানা অজুহাতে কৃষকদের সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এক্ষেত্রে একটি বেসরকারি ব্যাংক লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলাধীন বড়খাতা এজেন্ট আউটলেট স্থানীয় ৫০০ ভুট্টাচাষীকে একদিনে কোটি  ৫৭ লাখ টাকা কৃষিঋণ  বিতরণ করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদিত ডাল, তেল, মসলাজাতীয় ফসল  ভুট্টা চাষের জন্য  শতাংশ রেয়াদি সুদে কৃষিঋণ প্রদানের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ব্যাংকের বড়খাতা এজেন্ট আউটলেট গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর রমনীগঞ্জ মডেল স্কুল প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কৃষকদের মধ্যে  ঋণ বিতরণ করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সক্রিয় ব্যাংকের দৃষ্টান্ত থেকে দেশের অন্য ব্যাংকগুলো শিক্ষা নিতে পারে। আমার জীবনে হাজার হাজার কৃষকের ঋণ প্রদান কার্যক্রম তদারক করেছি। দেখেছি প্রকৃত কৃষক কৃষিঋণ খেলাপি হন না। তারা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেন এবং ঋণের অর্থ কৃষিকাজে ব্যবহার করে নিজে লাভবান হন এবং দেশের মানুষের জন্যও প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের জোগান দেন। এসব কৃষক সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে কৃষিঋণ পান না। অথচ তাদের হেক্টরপ্রতি ফলন বেশি।  কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারেও তারা বেশি পারদর্শী। তাই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের  মাধ্যমে তাদের কাছে সময়মতো ঋণ প্রদান করে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে এজেন্ট ব্যাংকিং উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।

 

নিতাই চন্দ্র রায়: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

বাংলাদেশ চিনি খাদ্য শিল্প করপোরেশন

আরও