বাংলাদেশে তেলবীজ ফসল হিসেবে সাধারণত সরিষা, তিল, চীনাবাদাম, সয়াবিন, সূর্যমুখী, তিসি, গর্জনতিল ও কুসুম ফুলের চাষ করা হয়। এছাড়া বর্তমানে ধানের তুষ থেকেও অল্প পরিমাণে ভোজ্যতেল তৈরি হচ্ছে। স্বল্প সময়ে কম পরিশ্রমে সরিষার চাষ করা যায়। কোনো কোনো জাতের সরিষা চাষ করতে সময় লাগে মাত্র ৮৫ থেকে ৯০ দিন। সরিষার উৎপাদন খরচও অন্য ফসলের তুলনায় কম। অল্প চাষে কিংবা বিনা চাষেও সরিষার আবাদ করা যায়। আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে তেলবীজ হিসেবে দেশে সরিষা আবাদের যথেষ্ট সুযোগ থাকায় এবং এর বহুমুখী ব্যবহার ও বাজারে ব্যাপক চাহিদার কারণে বাংলাদেশে ভোজ্য তেলবীজ হিসেবে সরিষার আবাদ হয় বেশি। সরিষা এঁটেল দোআঁশ থেকে শুরু করে দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতেও চাষ করা যায়। নদীচরের বালিমাটিতেও সরিষা ফলানো যায়। অন্য ফসলের মতো সরিষায় তেমন বেশি সার ও সেচের প্রয়োজন হয় না। এ তেল ফসল চাষের জন্য দুটি সেচই যথেষ্ট। সরিষায় শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ তেল এবং ২০ থেকে ২৫ ভাগ প্রোটিন থাকে। সরিষার খৈল উন্নত পশুখাদ্য ও জৈব সার হিসেবে ব্যবহার হয়। দেশে তেলবীজ আবাদি জমির প্রায় শতকরা ৭৮ ভাগ এলাকায় সরিষার চাষ হয়।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের রুচি ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, কৃষিজমি হ্রাস, বোরো ধানের আবাদ বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে একদিকে দেশে তেলবীজের জমি কমছে, অন্যদিকে চাহিদা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাজারে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে ভোজ্যতেলের দাম। ভোজ্যতেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে বিপদে পড়েছে স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। প্রতিদিনের রান্নাবান্নায় ভোজ্যতেল অপরিহার্য। এছাড়া বিভিন্ন আচার, আয়ুর্বেদীয় ওষুধ, মোম, সাবানসহ নানা প্রসাধনী তৈরিতেও ভোজ্যতেল ব্যবহার করা হয়। হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বেকারি পণ্যেও রয়েছে ভোজ্যতেলের নানামুখী ব্যবহার।
বর্তমান বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নয় মাসে দেশে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে সাতবার। গত জানুয়ারিতে যে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১১৫ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৬০ টাকা। পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল কেনার ক্ষেত্রেও ভোক্তাকে একই রকম বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে। সয়াবিনের পাঁচ লিটারের বোতলের দাম গত মাসে গড়ে ছিল ৭২৮ টাকা, এখন সেটার দাম হয়েছে ৭৬০ টাকা। বোতলজাতের পাশাপাশি খোলা সয়াবিন ও খোলা পাম তেলের দামও বেড়েছে বেশ। বাংলাদেশ ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী ও বনস্পতি উৎপাদন সমিতির ভাষ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বিবেচনা করেই নতুন বর্ধিত মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ভোজ্যতেলের। এখন থেকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১২৯ টাকার বদলে ১৩৬ এবং খোলা পাম তেল ১১৬ টাকার বদলে ১১৮ টাকায় বিক্রি হবে বাজারে।
মাথাপিছু ভোজ্যতেলের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশীয় ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলেন আজ থেকে দুই বছর আগেই কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। আমাদের মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী নতুন নতুন তেলবীজের জাত উদ্ভাবন করে ব্যাপক হারে আবাদ করতে হবে এবং ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি কমাতে হবে। ১৯ মার্চ ২০১৯ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সরিষা তেলবীজ চাষ সম্প্রসারণ ও ভোজ্যতেলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভবিষ্যতে করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে এক সভায় এসব কথা বলেন কৃষিমন্ত্রী।
একসময় ভোজ্যতেল বলতে শুধু সরিষাকে বোঝাত। সরিষা শুধু তেলই নয়। এ থেকে পুষ্টিসমৃদ্ধ খৈল পাওয়া যায়। মত্স্য ও পশু খাদ্য হিসেবে যার চাহিদা রয়েছে প্রচুর। তেলবীজ আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশে তেলবীজ চাষের এলাকা ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সব ধরনের সহায়তা করতে আগ্রহী সরকার।
আমাদের দেশে তেল ফসলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সরিষার। বর্তমানে দেশে আবাদি জমির মাত্র চার ভাগে তেল ফসলের আবাদ হয়। দেশে সামান্য পরিমাণে সয়াবিন উৎপাদন হয়। এ থেকে উৎপাদিত খৈল হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। দেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ২০ গ্রাম করে তেল খায়। সে হিসেবে শুধু মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য ১২ লাখ ২৪ হাজার টন তেলের প্রয়োজন। গত ২০১৯-২০ মৌসুমে ৮ দশমিক ১২ লাখ হেক্টর জমিতে তেল ফসলের চাষ করে ১১ দশমিক ৫৪ লাখ টন তেলবীজ উৎপাদন হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ৯ থেকে ১০ শতাংশ। দেশে ওই সময়ে মোট ৫ দশমিক ৬৯ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়, যা থেকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন সরিষা এবং ওই সরিষা থেকে আনুমানিক ৩ লাখ টন তেল উৎপাদন হয়।
তেলবীজ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিতে হবে। এছাড়া কৃষকদের উন্নত বীজ সরবরাহ করা, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা এবং কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করতে হবে। তেলবীজ বিশেষ করে সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারও কৃষকদের প্রয়োজনীয় সব উপকরণে সহায়তা দিতে চায়।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের পরিভোগ বেড়েছে শতকরা ২০ শতাংশ। এতে বার্ষিক জনপ্রতি ভোজ্যতেল পরিভোগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৪ কেজি। ২০১৫ সালে দেশে জনপ্রতি বার্ষিক ভোজ্যতেল ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৩ কেজি। বাংলাদেশে প্রতি বছর তেল ও চর্বিজাতীয় খাদ্য ব্যবহারের পরিমাণ হলো ৩০ লাখ ৩০ হাজার টন, যার শতকরা ৯০ ভাগই আসে আমদানির মাধ্যমে বিদেশ থেকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২৭ লাখ ৭৩ হাজার টন ভোজ্যতেল, চর্বি ও তেলবীজ আমদানি করে, যার মূল্য হলো ২ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের ২০০ কোটি ডলারের অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে। দেশে স্থাপিত ২৫টি ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫৫ লাখ ৭০ হাজার টন, যা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। গত চার বছরে দেশে ভোজ্যতেলের ব্যবহার শতকরা ৩৯ ভাগ বেড়ে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে ছিল ৩০ লাখ ৮০ হাজার টনে, যা ২০১৫ সালে ছিল ২২ লাখ ২০ হাজার টন। করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সালে দেশে ভোজ্যতেলের ব্যবহার শতকরা ১ দশমিক ৬ ভাগ কমে বার্ষিক ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ৩০ হাজার টনে। মূল্য ও গুণগত মানের বিবেচনায় বাংলাদেশে ব্যবহূত ভোজ্যতেলের শতকরা ৫৫ থেকে ৬০ ভাগ হলো পাম তেল।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ লাখ ৪০ হাজার টন পাম তেল আমদানি করা হয়, যার মধ্যে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার হয় ৭ লাখ ৫০ হাজার টন, বেকারি-হোটেল রেস্তোরাঁয় ৪ লাখ টন, শিল্প-কারখানায় ২ দশমিক ৫ লাখ টন এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার হয় বাকি ২ দশমিক ৪ লাখ টন।
রাষ্ট্র পরিচালিত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্যানুসারে, ২০২০ সালের মে মাসে পাঁচ লিটার ওজনের বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ৫২০ টাকা, যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬০ টাকা। পাম তেলের দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে শতকরা ৭৫ ভাগ।
দেশে বছরে আমনের চাষ হয় ৫৮ থেকে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে। অধিকাংশ কৃষক আমন ধান কাটার পর জমি পতিত রাখেন। কেউ কেউ আগাম আমন ধান কাটার পর আলু, সরিষা ও শীতকালীন সবজি ও ভুট্টার চাষ করেন; যার পরিমাণ নগণ্য। দেশে আলুর চাহিদা বছরে ৭০ লাখ টন। উৎপাদিত হয় ১ কোটি টন। বিদেশে আলু রফতানির পরিমাণও আশাব্যঞ্জক নয়। ফলে প্রতি বছরই আলুচাষীদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আলু নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। আলু বিক্রি করে কৃষক উৎপাদন খরচও তুলতে পারেন না। এক্ষেত্রে কৃষক আলুর পরিবর্তে সরিষার চাষ করতে পারেন। সরিষা চাষের সুবিধা হলো, ফসল সংরক্ষণের জন্য কোনো হিমাগারের প্রয়োজন হয় না। কৃষক নিজের বসতবাড়িতে সহজে সংরক্ষণ করতে পারেন। সারা বছরই সরিষার বাজারমূল্য ও চাহিদা থাকে সন্তোষজনক। এটি আলুর মতো স্বল্প সময়ের ফসল। সরিষার উৎপাদন খরচ আলুর চেয়ে অনেক কম এবং তুলনামূলকভাবে লাভও বেশি। সরিষার জমিতে মৌমাছি পালনের মাধ্যমে মধু উৎপাদন করা যায়। এতে সরিষার ফলন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
সরিষা আবাদের মাধ্যমে দেশে ছয় লাখ টন ভোজ্যতেলের ঘাটতি মোকাবেলা করে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। এটা আমাদের কথা নয়, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের পরামর্শ। বিনার একদল বিজ্ঞানী বলছেন, বিনা ধান-৭, বিনা সরিষা-৭ ও বোরো ধান—এ শস্যবিন্যাস অনুসরণের মাধ্যমে সরিষার চাষ করে খুব কম সময়ে ভালো ফসল পাওয়ায় আশাবাদী কৃষক।
আমন মৌসুমে আষাঢ় মাসে আগাম জাত বিনা ধান-৭-এর চাষ করে আশ্বিনের শেষের দিকে কেটে সাফল্যজনকভাবে বিনা সরিষা-৭ চাষ করা যায়। আবার সরিষা কেটে স্বাভাবিকভাবেই বোরো ধানের চাষ করা যায়। এতে আমন ও বোরো ধানের ফলনও ভালো হয়। বিনার সরিষার একরপ্রতি ফলন ২৮ মণ এবং গড় ফলন ২২ মণ। প্রতি মণ সরিষার দাম আড়াই হাজার টাকা হলে একরে ৫৫ হাজার টাকা আয় করতে পারেন কৃষক সরিষা চাষে। বিনার বিজ্ঞানীরা বলেন, আমন, আলু ও বোরোর পরিবর্তে আমন, সরিষা ও বোরো শস্য বিন্যাসের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল স্বল্প জীবনকালের আমন ধানের জাত সঠিক সময়ে চাষ করে উন্নত সরিষার জাত আবাদ করা সম্ভব। এরপর লাগাতে হবে বোরো ধান। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর শস্যবিন্যাস হলো বিনা ধান-৭, বিনা সরিষা-৭, বোরো। এ শস্যবিন্যাসকে জাতীয়ভাবে সম্প্রসারণ করতে হবে। কিন্তু সরকার ও কৃষি বিভাগ বিষয়টি নিয়ে তেমন আগ্রহ না দেখানোর ফলে সরিষা আবাদে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিশাল সম্ভাবনার বিষয়টি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
দেশে আমন আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫৮ থেকে ৫৯ লাখ হেক্টর। তার মধ্যে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে স্বল্প জীবনকালের বিনা সরিষা-৭ চাষের পর সেসব জমিতে বিনা উদ্ভাবিত সরিষার চাষ করে ছয় লাখ টন ভোজ্যতেল উৎপাদন সম্ভব, যার মাধ্যমে একদিকে দেশে ভোজ্যতেলের ঘাটতি পূরণ হবে এবং সাশ্রয় হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
নিতাই চন্দ্র রায়: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন