অর্থনৈতিক অসমতা আমলে নেয়া
বিশ্বের যেসব দেশে সম্পদবৈষম্য সবচেয়ে বেশি, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। বিষয়টি আমাদের দেশের জন্য ভালো কিছু নয়, বরং অশনিসংকেত। এর বিপরীতে দেখা যায়, বিশ্বের উন্নত ও সম্ভ্রমজাগানিয়া দেশগুলো সম্পদের এ ব্যবধান কমিয়ে এনেছে। অর্থনৈতিক অসমতা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ; এ কারণে আমাদের কর্মঠ মানুষ প্রেরণা ও স্পৃহা হারিয়ে ফেলছেন। কথায় বলে, দেহের সব রক্ত মুখে জমা হওয়া সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়; এটা আরো গুরুতর অসুখের লক্ষণ। একইভাবে বাংলাদেশের সব সম্পদ ও অবকাঠামো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়া কাজের কথা নয়। ঢাকার চাকচিক্য, গগনচুম্বী অট্টালিকা বা শুধু উড়ালসড়কগুলো অর্থনীতির সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।
এ বাস্তবতায় আমাদের উপদেষ্টা পরিষদ ও তাদের সহযোগীদের উদাহরণ তৈরি করে এগোতে হবে। কিছু ব্যক্তিগত বিলাসিতা অবিলম্বে ত্যাগ করে জাতির কাছে সংস্কারের প্রাথমিক অঙ্গীকার প্রমাণ করতে হবে। এটা শুরু হতে পারে নেতাদের অনাড়ম্বর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে, যেমন বিদেশী অতিথিদের বরণ করা ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘১৫০০ সিসির নিচে গাড়ি ব্যবহার করা, আরামদায়ক কিন্তু অনাড়ম্বর বাড়িতে বসবাস করা ও বড় বড় প্রদর্শনী বর্জন করে অর্থের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় না করা। সরকারি গাড়ির ওপরের ভাগ লাল রঙ ও মূল শরীর সবুজ রঙে রাঙানো যায়, যেখানে সাধারণত এসব গাড়ি কালো রঙের হয়; এ কালো রঙ সম্পদ, ক্ষমতা ও আভিজাত্যের প্রতীক। যে দেশের শিশুরা এখনো অপুষ্টির শিকার, সেখানে আমাদের নেতাদের উচিত হবে, সরলতার মধ্য দিয়ে প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। ব্যক্তিগত সহকারী ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় আরাম-আয়েস হ্রাস করতে হবে, যেমন ছোট-বড় ব্যক্তিগত ব্যয় হ্রাস করা এবং পারিবারিক অনুষ্ঠান/সন্তানের বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যয় কমানো। বিমান ভ্রমণের সময় প্রথম বা ব্যবসায়িক শ্রেণীতে ভ্রমণ না করা এবং সরকারি টাকায় যত কম বিদেশ সফর করা যায়, তা নিশ্চিত করা।
আমরা শুনেছি ও দেখেছি, কমপক্ষে তিন শতাধিক পুলিশের গাড়ি ও শতাধিক আরো জরুরি যানবাহন পুড়ে গেছে। পুড়ে গেছে অনেক থানা। অতি সহজেই তাদের পরিবহনের সমাধান সম্ভব। শত শত অত্যন্ত ব্যয়বহুল ২৫০০/৩৫০০ সিসি সরকারি গাড়িগুলো উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নিয়ে সেগুলো দেশীয় প্রযুক্তিতে অতিসত্বর কাভারড ভ্যানে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। এমনকি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এ গাড়িগুলোকে বেশ ভালো অ্যাম্বুলেন্স (যার প্রয়োজন সারা দেশে অতীব প্রয়োজন।) করাও কঠিন নয়। সব ঊর্ধ্বতন পদে সুবিধাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অনুধাবন করা প্রয়োজন, এ পদ ও সুবিধা তাদের কাঁধে বিশাল দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এ দায়িত্বের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত নৈতিকতা ও দৈনন্দিন সহজ জীবনযাপন দেশের সাধারণ জনগণের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। সামনেই যখন পলিথিন নির্মূলের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে উপদেষ্টা ও উচ্চ কর্মকর্তাদের যানবাহন সম্পর্কিত উপরোক্ত উদ্যোগগুলো নিয়েও জনগণের আরো কাছে আসতে পারেন নীতিনির্ধারকরা।
প্রতি বছর দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এতে কমপক্ষে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ৩৫০ কোটি ডলার ব্যয় হয়। এটা যে কেবল বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতা বা অব্যবস্থাপনার কারণে হচ্ছে তা নয়; বরং জনসেবার প্রতি নৈতিক অঙ্গীকারের অভাব ও অবক্ষয়ের কারণেও হয়। এ প্রবণতার গতিমুখ উল্টে দিতে নীতিপ্রণেতাদের উচিত হবে, নিজেদেরই নজির স্থাপন করে পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেয়া; অর্থাৎ দেশেই নিজেদের অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা নেয়া। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছ থেকে তারা অনুপ্রেরণা নিতে পারেন। তিনি কিডনির রোগী ছিলেন; বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি দেশেই চিকিৎসা নিয়েছেন এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে ডায়ালাইসিস কেন্দ্র স্থাপনও করেছেন। এ ধরনের অঙ্গীকার আমাদের ‘চিকিৎসা দারিদ্র্য (Medical Poverty)’ আমলে নিতে সহায়তা করবে এবং দেশের স্বাস্থ্য খাতের ওপর মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করবে। মালয়েশিয়ার ড. মাহাথির মোহাম্মদ নিজের হৃদরোগের জটিল চিকিৎসার জন্য নিজ দেশেই একসময় যে ইনস্টিটিউট করেছিলেন, তা আজ এশিয়ার উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র। এসব সংস্কারে অগ্রাধিকার দেয়া হলে দেশে আরো সমতামূলক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে; সব নাগরিক সেখান থেকে সেবা পাবে।
সমাজের উচ্চতম ও নিম্নতম সারির মানুষের ব্যবধান হ্রাস করতে হবে। এসব পরিবর্তনের কথা অস্বাভাবিক শোনালেও বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য তা শক্তিশালী নজির তৈরি করবে। অনাড়ম্বর ও সরল জীবনযাপনের লক্ষ্যে আমাদের নেতাদের এসব অবশ্যই করতে হবে। অরক্ষিত জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে এসব স্রেফ সামান্য কয়েকটি পদক্ষেপ। সেটা হলে মানুষ শিগগিরই বুঝতে পারবে, ছোট কয়েকটি পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সংস্কারের এ দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয়েছে।
বাস্তবায়ন
এসব প্রস্তাব আরো বাস্তবায়নযোগ্য করতে আমি সহানুভূতি, উদারতা, কৃতজ্ঞতা, স্বচ্ছ জীবনযাত্রার মতো মানবিক স্তম্ভগুলো বিনির্মাণে নতুন দেশের নৈতিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটাতে ‘মোরালজি সেল (Moralogy Cell)’ গঠনের প্রস্তাব করছি। এ সেলের কাজ হবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মাদ্রাসা, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থানগুলোয় নৈতিকতা-সহৃদয়তার কার্যক্রম পরিচালনা করে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা। সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নৈতিকতার কথা, উদারতার কথা, ক্ষমার কথা ও মানুষকে ভালোবাসার কথা শুধু বললেই হবে না, যারা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকেন, তাদের মধ্যে এ মানবিক চিন্তাধারাগুলো সঠিকভাবে বাসা বাঁধলেই সেগুলো সুশাসনের একেকটি বাতিঘর হতে শুরু করবে। ‘মোরালজি’ ধারণাটি আজ থেকে ১০০ বছর আগে জাপানের রাজধানী টোকিওর কাছাকাছি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভব হয়। এই সেলের কার্যক্রম সব মন্ত্রণালয়/কার্যালয় ও সদস্যের ডেস্কের জন্যও প্রযোজ্য হবে। সহজ কথায়, এই সেলের কাজ হবে মানুষের মনোভাব পরিবর্তন করা। এ ইতিবাচক মনোভাব লালনে এবং অদম্য স্পৃহা তৈরির জন্য সঠিক মানসিকতাই হবে জরুরি বিষয়।
ঘুস প্রতিরোধে নৈতিকতা চর্চার বিকল্প নেই। অনৈতিকতার স্পর্শে মানুষের মন এমন হয়ে ওঠে যে সেখানে খারাপ চিন্তা অতি সহজে প্রবেশ করে। খারাপ চিন্তাধারা দ্রুত অন্যকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে—বড় ছোঁয়াচে এ রোগ। উদারতা আর ত্যাগের শক্তিতে বোনা ‘সেবার চাদর’ সহজে ছেঁড়া যায় না। আবার মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতাও এক ধরনের শক্তি; এর প্রভাবে একজনের কাছ থেকে আরেকজন ভালো হতে শুরু করে। নৈতিকতার শিক্ষাই পারে মানুষকে এমন স্থানে পৌঁছে দিতে, যেখানে যেকোনো অসৎ কাজ দিয়ে তাকে প্রভাবিত করা যাবে না।
সমাজে সুবিধাভোগীরা স্বার্থপরতা ও পরশ্রীকাতরতায় ভর করে ছিদ্রান্বেষণের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ চিত্তের চেয়ে বিত্তের প্রতি বেশি মনোযোগী। মানুষ ভুলতে বসেছে, নৈতিকতার পথে অর্থ উপার্জন করে সচ্ছল কিংবা ধনী হওয়াই সফলতা ও সার্থকতা। উদারতাকে সমাজ দুর্বলতা ভাবতে শুরু করেছে। ‘আমিত্ব’ এখন সমাজে সংক্রামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। সে জন্য নিজ নিজ ঘর থেকেই শুরু হতে হবে সংস্কার। প্রতিটি খাতেই নৈতিকতার চাষ হওয়া আবশ্যক। এটি সমাজের সাম্য ও ন্যায়বিচারের প্রধান উপাদান। উদারতা, দানশীলতা, ক্ষমা—এসব ছোঁয়াচে বিষয়; এগুলো সদর্থক। উন্নত ও সভ্য সমাজ গড়তে এর বিকল্প নেই।
এ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমাজে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা প্রায় সবাই ‘বেবি বুমার ও জেনারেশন এক্সের’ সদস্য। তারা ইঁদুর দৌড়, ‘অহমবোধ’ ও চাকরির মধ্যে আত্ম মূল্য খোঁজার সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। বর্তমান প্রজন্মের ‘জেন-জি’দের নেতৃত্ব দেয়ার ভার এখন তাদের ওপর; যারা জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এদের মধ্যে প্রজন্মগত পার্থক্য আছে। ‘জেন-জি’রা ইতিবাচক পরিবর্তনের মুখাপেক্ষী; তারা আরো উদার ও মানবিক পৃথিবী কামনা করে। প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন এ প্রজন্ম ‘মানুষ ও প্রকৃতি’র প্রতি আরো উদার ও মানবিক। তারা কভিড-১৯ মহামারী ও গণতন্ত্রের নানা চড়াই-উতরাই মোকাবেলা করেছে; এর মধ্য দিয়ে তারা আরো ঘাতসহ ও সহানুভূতিশীল হয়েছে। সেদিক থেকে আপনারা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে ঝরনার মতো উচ্ছল আর সূর্যালোকের মতো এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে পেয়েছেন। বিদ্যান মানেই জ্ঞানী নন। বিদ্যান দুর্জন হলেও পরিত্যাজ্য এ সমীকরণে জ্ঞানী ও তরুণের সমন্বয়ের এ সুযোগ আমরা যেন হাতছাড়া না করি।
ডা. রুবাইয়ুল মুর্শেদ: লেখক, শল্যচিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ; সহৃদয়তা বিষয়ক মনস্তত্ত্ব গবেষক; প্রতিষ্ঠাতা প্রধান, সম্মান ফাউন্ডেশন