কার্টুন পছন্দ করে না, এমন শিশু কমই পাওয়া যাবে। ছোটবেলায় আমরাও পছন্দ করতাম। অপেক্ষায় থাকতাম কখন দেখতে পাব? তখন বিটিভি ছাড়া আর কোনো চ্যানেল ছিল না। দেখার সুযোগ হতো সপ্তাহে একদিন অথবা দুদিন, তাও অল্প সময়ের জন্যে। কিছুদিন পর এল ডিশ সংস্কৃতি। কার্টুন দেখানোর জন্যে অনেকগুলো চ্যানেল। এখন চলছে ইউটিউব এবং স্মার্ট টিভির যুগ। কার্টুন দেখার সুযোগ আরো উন্মুক্ত। ইচ্ছা করলেই যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কার্টুন দেখা খুব সহজ বিষয়।
অনেক অভিভাবকও চায় শিশু কার্টুন দেখুক। শিশুকে শান্ত রাখার জন্য, খাওয়ানোর জন্য অথবা ব্যস্ত রাখার জন্য কার্টুন ছেড়ে অভিভাবকরা নিশ্চিত থাকেন। মায়েরা তাদের গৃহস্থালি ও রান্নাবান্নার কাজ নিশ্চিন্তে করতে পারেন। শিশুরা বিরক্ত করে না বলে অভিভাবকরাও খুশি। কিন্তু এর ফলে স্ক্রিন আসক্তি ও শারীরিক সমস্যাসহ আরো কী কী ক্ষতি হচ্ছে, তা হয়তো আমরা খুব কম অভিভাবকই জানি।
বড়দের কার্টুন দেখা আর শিশুদের দেখার মধ্যে তফাত বিস্তর। বড়রা সত্য-মিথ্যা, বাস্তব-অবাস্তবের পার্থক্য কিছুটা হলেও করতে পারে। কিন্তু ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি এত সরল নয়, চোখে দেখা সবকিছুকেই তারা বিশ্বাস করে। আশঙ্কার বিষয়টি এখানেই। যে বয়সে শিশুর জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক উদ্দীপনা, সে সময়ে আমরা কার্টুনে বুঁদ করে রেখে শিশুর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশকে দুর্বল করে দিচ্ছি।
কার্টুনের বেশির ভাগ চরিত্র কাল্পনিক, অনেক ক্ষেত্রে তা অবাস্তবও বটে। ঘটনাগুলোকে এমনভাবে চিত্রায়িত করা হয়, যাতে শিশুরা আকৃষ্ট হয়। বারবার দেখতে দেখতে শিশুরা এগুলোকে স্বাভাবিক বলে মনে করে, তখন বাস্তব ঝুঁকিকে বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়। যেমন কার্টুনে চরিত্রগুলোকে গাছ, পাহাড় বা বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিতে দেখা যায়, যা অনুকরণ করতে গিয়ে অনেক শিশু দুর্ঘটনার শিকার হয়।
আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে ভাষার বিকৃতি। যে বয়সে শিশু মাতৃভাষা রপ্ত করতে শিখে, সে বয়সে বিকৃত ও বিদেশী ভাষার কার্টুন দেখছে। প্রতিনিয়ত বিকৃত ভাষা শোনার কারণে শিশুরা মার্জিত ভাষায় কথা বলতে শিখছে না। কার্টুনের ভাষা ও কণ্ঠস্বর নকল করছে। কার্টুনের চরিত্রের মতো অনুকরণ করে কথা বলছে। মাতৃভাষা শেখার আগেই ভিনদেশী ভাষা রপ্ত করছে। যে শিশু এখনো মাতৃভাষায় ঠিকমতো কথা বলতে শেখেনি, মোটু পাতলু কার্টুনের বদৌলতে তাকেও হিন্দিতে কথা বলতে দেখা যায়। ভিন্ন ভাষা শেখা দোষের কিছু নয়। কিন্তু বিকাশের প্রারম্ভিক সময়ে মাতৃভাষা ঠিকমতো রপ্ত করতে না পারলে শিশুর সাংস্কৃতিক বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
আসলে ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক অনেক গভীর। মাতৃভাষা শেখার আগে অন্য ভাষায় অভ্যস্ত হলে শিশুর মধ্যে দেশীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে একধরনের অস্পষ্টতা ও অনীহা তৈরি হতে পারে। বিদেশী কার্টুন মানে ভিন্ন সংস্কৃতি। ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা আর ভিন্ন সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হওয়া—এই দুটো বিষয় এক নয়। প্রথমটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অসাম্প্রদায়িক ও উদারমনা করে আর দ্বিতীয়টি পরিণত করে শেকড়বিচ্ছিন্ন মানসিক শরণার্থীতে।
প্রতিনিয়ত ভিন্ন সংস্কৃতির কার্টুন দেখার ফলে শিশুরা নিজের সংস্কৃতিকে জানার আগেই বিদেশী সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হচ্ছে। এটাকেই তারা স্বাভাবিক ও সঠিক বলে মনে করছে। বড় হয়ে তারা যখন নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে, তখন বেশির ভাগ শিশু তা গ্রহণ করতে চায় না। এটা তাদের কাছে তখন আকর্ষণীয় মনে হয় না। আর এ শিশুরা যদি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, খাবার, পোশাক, জীবনাচরণ, মূল্যবোধ সবকিছুকেই সে সেকেলে মনে করতে শুরু করে।
কার্টুনের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, সহিংস আচরণ। কার্টুনের বেশির ভাগ দৃশ্যই মারামারি অথবা অন্যকে আঘাত করা। কার্টুনে হিরো সবসময় অন্যকে ধোলাই দেয়। শিশুও শিখে হিরো হতে গেলে অন্যকে আঘাত করতে হবে। ক্রমাগত এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে সহিংসতাকে সে স্বাভাবিক মনে করে। শিশুও কার্টুনের মতো করে সহিংস ও আগ্রাসী আচরণ করতে শুরু করে।
টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনের পুরোটাই সহিংসতা, মারামারি, প্রতিশোধ নেয়া, অন্যকে হেয় করা, বিরক্ত করে মজা পাওয়া, প্রতারণার আশ্রয় নেয়া ইত্যাদি। কার্টুনের পুরো সময়টাই অস্থিরতা বিদ্যমান। আনন্দ পেলেও শিশুমনে এর প্রভাব কী আমরা কি কখনো ভেবে দেখছি? এ কার্টুন দেখে আমাদের শিশুরাও কি অস্থিরচিত্ত ও সহিংস হয়ে উঠছে না?
ডিজনি-পিক্সার নির্মিত কার্টুনগুলো শিশুদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। মিউজিক ও অ্যানিমেশন দিয়ে প্রেম ও ভালোবাসার দৃশ্যগুলোকে এমনভাবে দেখানো হয়, যা বড়দেরও আকৃষ্ট করে। এসব দেখে শিশুরা লিপ কিস কী বুঝতে পারে? বয়ফ্রেন্ড অথবা গার্লফ্রেন্ডের মানে জানে। টম অ্যান্ড জেরির প্রায় প্রতিটি পর্বেই দেখতে পাবেন টম তার পাশের বাড়ির নারী বিড়ালকে আকৃষ্ট করার জন্যে কী না করছে। ডোরেমন কার্টুনে নোবিতা তার বান্ধবীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে কত কিছু করছে।
প্রেম ও যৌনদৃশ্য কোনোভাবেই কোমলমতি শিশুর বয়সের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ ধরনের দৃশ্য শিশুর মনে নানা প্রশ্ন ও কৌতূহল উদ্রেক করতে পারে। যা তার বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক ভাবনা ও বিকাশকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, যার চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে চারিত্রিক অবক্ষয়, বিকৃত যৌন আচরণ এবং নারীর প্রতি অসম্মান ও যৌন সহিংসতা।
এছাড়া কার্টুনে বিভিন্ন চরিত্রের শারীরিক কাঠামোকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয় (যেমন পুরুষ চরিত্রের ক্ষেত্রে পেশিবহুল শরীর, নারী চরিত্রের ক্ষেত্রে চিকন কোমর ও স্ফীত বক্ষ)। অধিকাংশ সময় নারী চরিত্রগুলোকে অশ্লীল পোশাক ও ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে চিত্রায়িত করা হয়, যা কোমলমতি শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব দৃশ্য ক্রমাগত দেখতে দেখতে শিশুও একসময় যৌনতা ও নগ্নতাকে স্বাভাবিক মনে করে। মনের অজান্তেই এ ধরনের শারীরিক কাঠামো ও অশ্লীল আচরণকে আদর্শ ভেবে অনুকরণ করতে শুরু করে।
বেশির ভাগ বিদেশী কার্টুন এবং রূপকথার অ্যানিমেশনে পরিবার উপেক্ষিত। ডিজনি চ্যানেলের একটি জনপ্রিয় শো হচ্ছে ‘জ্যাসি’ (Jessie) অথচ সেখানে মা-বাবার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। চরিত্রগুলোকে এমনভাবে চিত্রায়িত করা হয় দেখলে মনে হবে মা-বাবা বিষয়টিই অপ্রাসঙ্গিক। ডোরেমন কার্টুনে মা-বাবার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলা, স্কুল ফাঁকি দেয়ার নানা কৌশল, অন্যকে বোকা বানানো এবং অন্যের প্রতারণা করার নানা কৌশল দেখানো হয়। এসব দেখে শিশুরাও শেখে কীভাবে মা-বাবার সঙ্গে মিথ্যা বলতে হয়, কীভাবে তাদের ফাঁকি দিতে হয়।
কার্টুনে বৈষম্যের শিক্ষাও বেশ প্রকট। বেশির ভাগ কার্টুনে রাজকুমার বা রাজকুমারীকে ফর্সা, সুন্দর ও আকর্ষণীয় শারীরিক কাঠামোতে দেখানো হয় আর খলচরিত্র (রাক্ষস, ডাইনি, দৈত্যকে) দেখানো হয় কালো, কিম্ভূতকিমাকার এবং কদাকার হিসেবে। এসব দেখে শিশু শিখছে গায়ের রং ফর্সা মানে ভালো মানুষ, কালো বা দেখতে সুশ্রী না হলে খারাপ মানুষ। অথচ দেখতে কালো কদাকার হলেও একজন মানুষ যে ভালো হতে পারে, এই শিক্ষা শিশু পাচ্ছে না। এভাবেই শিশুরা বর্ণবাদের শিক্ষা পাচ্ছে।
এতক্ষণ যা লিখলাম, তা পড়ে মনে হতে পারে সব কার্টুনই খারাপ। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। আমাদের আপত্তি কার্টুনের বিষয়বস্তু নিয়ে। কন্টেন্ট ভালো হলে এখান থেকেও শিশুকে ইতিবাচক অনেক কিছু শেখানো সম্ভব। এর সুন্দর উদাহরণ হচ্ছে মীনা কার্টুন, যা আমাদের সংস্কৃতির উপযোগী করেই তৈরি করা হয়েছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যে মীনা কার্টুন শিশুদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছিল।
এ কার্টুনে মীনা ছিল আদর্শ চরিত্র। আনন্দের পাশাপাশি মীনা কার্টুনের মূল শিক্ষা ছিল পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা। মীনা কার্টুনের মাধ্যমে ছেলেমেয়ের সমঅধিকার, বাল্যবিবাহ রোধ, যৌতুককে না বলা, শিশুদের স্কুলমুখী করা, স্যানিটেশন ইত্যাদি বিষয় খুব চমৎকারভাবে শিশুদের শেখানো হয়েছিল। পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক দায়িত্বশীলতার বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ফলাফল হচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই মীনা শিশুদের কাছে মডেলে পরিণত হলো, আবির্ভূত হলো কিশোরীদের মুক্তির অনুপ্রেরণা হিসেবে।
এ রকম আরেকটি প্রোগ্রাম হচ্ছে সিসিমপুর। শিশুদের আনন্দদানের পাশাপাশি কত চমৎকারভাবে অনেক কিছু শেখানো হচ্ছে। সিসিমপুরের মাধ্যমে শিশুরা বর্ণমালা, শব্দগঠন ও সংখ্যা গণনা, ছবি আঁকা ও গান গাওয়ার মতো নানা সৃজনশীল কাজ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, কিছু বাস্তব জ্ঞান (যেমন রাস্তা পারাপার, আগুন লাগলে, ভূমিকম্প হলে, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয়-বর্জনীয় ইত্যাদি) শিখতে পারে। এছাড়া গ্রামবাংলার লোকগল্প, লিঙ্গসমতা, সামাজিক মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, বিভিন্ন অঞ্চল ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা সম্পর্কে শিশুরা জানতে পারে। যা শিশুদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এবং ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীল হতে সাহায্য করে।
মীনা এবং সিসিমপুর ব্যতীত এখন পর্যন্ত আমরা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্টুন সিরিজ তৈরি করতে পারিনি। মাঝেমধ্যে কিছু চেষ্টা হয়তোবা হয়েছে, কিন্তু এসব প্রয়াস মানসম্মত হয়নি বলেই এ দেশে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে বর্তমানে মীনা কার্টুন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়ছে না।
শূন্যতা তৈরি হলে সে স্থান ফাঁকা থাকে না। ভালো কিছু দেখার পথ বন্ধ করা হলে সে শূন্যতা নেতিবাচক বিষয়বস্তু দিয়েই পূর্ণ হয়। এ কারণেই কার্টুন নেটওয়ার্ক, পোগো, নিক, হাঙ্গামা ইত্যাদির মতো বিদেশী চ্যানেল আমাদের দেশে এতটা বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে। একই কারণে ডোরেমন, মোটু পাতলু, টম অ্যান্ড জেরি, স্কুবি ডুর মতো কার্টুন সিরিজগুলো এ দেশে এতটা জনপ্রিয়।
যখন অপসংস্কৃতির আগ্রাসন জোঁকের মতো চেপে বসে তখন সুস্থ ও নির্মল সাংস্কৃতিক জাগরণ দিয়েই তাকে প্রতিহত করতে হয়। মীনা ও সিসিমপুরের মতো সুস্থ কার্টুন নির্মাণের মাধ্যমেই কাজটি করতে হবে। একই সঙ্গে শিশু যেন সারা দিন কার্টুন দেখে স্ক্রিন আসক্ত না হয়, এ ব্যাপারেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
শ্যামল আতিক: প্যারেন্টিং গবেষক