সময়ের ভাবনা

বিদেশি ভাষা চর্চার অর্থনৈতিক গুরুত্ব

বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষা শেখার গুরুত্ব অপরিসীম, যেহেতু ভাষা সব যোগাযোগের মাধ্যম। তাই বিশেষ করে কর্মসূত্রে বিদেশে গমন ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশি ভাষা শেখার ফায়দা অনেক। বিশেষত বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্যের মেরুকরণের পরিপ্রেক্ষিতে বহু ভাষা শেখা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ২০১৭ সালের ‘ভবিষ্যতের

বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষা শেখার গুরুত্ব অপরিসীম, যেহেতু ভাষা সব যোগাযোগের মাধ্যম। তাই বিশেষ করে কর্মসূত্রে বিদেশে গমন ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশি ভাষা শেখার ফায়দা অনেক। বিশেষত বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্যের মেরুকরণের পরিপ্রেক্ষিতে বহু ভাষা শেখা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ২০১৭ সালের ‘ভবিষ্যতের ভাষা’ (Languages for the Future) শিরোনামের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ভাষা হচ্ছে যথাক্রমে ইংরেজি, চায়নিজ, স্প্যানিশ, আরবি, ফ্রেঞ্চ, জাপানিজ, হিন্দি, জার্মান, রাশিয়ান, পর্তুগিজ, ডাচ, পোলিশ ও ইতালিয়ান। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভোক্তারা কোনো পণ্য ক্রয়ের আগে সে পণ্য সম্পর্কে তথ্যাদি নিজেদের ভাষায় জানতে চায়। ইন্টারনেটভিত্তিক ভোক্তাদের ৬০ শতাংশই অ-ইংরেজি অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে কেনাকাটা করে। ৭২.৪ শতাংশ মানুষ নিজেদের ভাষায় পর্যাপ্ত তথ্য আছে এমন ওয়েবসাইট থেকে কেনাকাটায় আগ্রহী। এজন্য বর্তমানে আমদানি/রফতানীকৃত পণ্যের গায়ে ইংরেজিসহ একাধিক ভাষায় পণ্যটি সম্পর্কে বর্ণনা থাকে।

চীনের মান্দারিন ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটির অধিক। বৈশ্বিক সমীকরণে চীন আগামী দিনে সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য দেশের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে এক দশকেরও বেশি সময়জুড়ে চীনা ভাষা শেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার দেশ চীন। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমদানি-রফতানি মিলিয়ে মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৪ শতাংশই চীনের সঙ্গে হয়। চীন থেকে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আসে। এছাড়া দেশটিতে জনসংখ্যা রফতানির সংখ্যাও বাড়ছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের গুরুত্ব কতখানি বেড়েছে, তা সম্প্রতি ডলার ও ইউয়ানের তুলনামূলক আলোচনার প্রসঙ্গেই দৃশ্যমান। এমতাবস্থায় চীনের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদেই চীনা ভাষা শেখার গুরুত্ব সামনে আরো বৃদ্ধি পাবে তাতে সন্দেহ নেই। চীনা ভাষায় বর্ণমালা নেই, চিত্রাক্ষর আছে। বাম থেকে ডানে এবং সোজাসুজি ওপর থেকে নিচে নেমে আসা অক্ষরগুলোর ব্যবহারও অন্য ভাষাগুলোর মতো না। চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের সুবাদেই নিকট ভবিষ্যতে এ ভাষা শেখার গুরুত্ব বাড়বে। এক সন্তান নীতির কারণে চীনে বর্তমানে জনসংখ্যার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। যে কারণে দেশটিতে জনশক্তি রফতানির বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। উচ্চশিক্ষা আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূত্রে জাপানে বাংলাদেশীদের নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। সম্প্রতি জাপানের সঙ্গে জনশক্তি রফতানিবিষয়ক একটি চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, নতুন এ চুক্তির আওতায় দক্ষ শ্রমিক হিসেবে জাপানে যেতে হলে অনুমোদিত সংস্থাগুলো থেকে জাপানি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। পেশাগত দক্ষতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভাষা শেখার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।

পেশাগত দক্ষতা এবং ভাষা শিক্ষা শেষে চূড়ান্ত বাছাই অনুষ্ঠিত হবে জাপান দূতাবাসে। এসব কারণে দেশটিতে যেতে ইচ্ছুকদের মাঝে জাপানি ভাষা শেখার গুরুত্বও বাড়ছে। চীনা ভাষার চিত্রাক্ষরগুলো জাপানি ভাষার ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়। তবে দুটো ভাষার চিত্রাক্ষর একই নয়, এক্ষেত্রে বিভিন্ন পার্থক্য রয়েছে।

জাপানে যেতে হলে জাপানি ভাষা জানতেই হবে। এজন্য জাপানি ভাষার এন ফোর লেভেল পর্যন্ত জানতে হবে। জাপানি ভাষায় এন ফাইভ হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়। এর পরের ধাপ হচ্ছে এন ফোর লেভেল। অর্থাৎ জাপানি ভাষায় বলতে, লিখতে ও পড়তে জানতে হবে।

জাপানে যেতে হলে জাপানি ভাষা জানার সর্বনিম্ন স্ট্যান্ডার্ড এটি। এর পরে এন থ্রি বা এন টু জানলে সেটাকে অতিরিক্ত যোগ্যতা বলে ধরা হবে। এছাড়া জাপানে যাওয়ার পরও নিয়মিত ভাষার বিষয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ থাকবে। জাপানি ভাষা শেখার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে সারা দেশে ২৭টি ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। জাপানি ভাষা শিক্ষার সার্টিফিকেট পেতে বাংলাদেশে অবস্থিত জাপানের দূতাবাসে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে।

এছাড়া কোরীয় ভাষায়ও চীনা অক্ষরগুলোর ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় জনশক্তি প্রেরণের ক্ষেত্রে কোরীয় ভাষা শেখার গুরুত্ব বাড়ছে। কোরীয় ভাষা আয়ত্ত করতে পারলে যে সুবিধাটা হয়, তা হলো ভাষাগত দুর্বোধ্যতার সমস্যায় পড়তে হয় না। বাংলাদেশী শ্রমিকদের সম্পূর্ণ সরকারিভাবে নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। এক্ষেত্রে অন্যান্য শর্তের সঙ্গে কোরিয়ান ভাষা পড়া, লেখা ও বোঝার পারদর্শিতা এবং কোরিয়ান ভাষা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এক্ষেত্রে নিজ উদ্যোগেই কোরিয়ান ভাষা শিখতে হবে। যেকোনো বেসরকারি প্রশিক্ষণ সেন্টার থেকে তা শিখতে হয়। ভাষা শেখার পর পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের এইচআরডি কোরিয়া স্কিল টেস্টে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হওয়ার পর মৌখিক পরীক্ষা হয়। এভাবে ভাষাগত দক্ষতায় উত্তীর্ণদের দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ থাকে। আর সবাই যে ইংরেজিতে দক্ষ হয়, সেটিও না। এজন্য স্থানীয় ভাষা শিখতে পারলে তা যোগাযোগকে সহজ করে। এমনকি দেশে অনেক বিদেশি কর্মরত থাকায় তাদের সঙ্গে কাজ করার সুবাদেও এ বিদেশি ভাষাগুলো শেখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যেমন চীনের অনেক নাগরিক ইংরেজি বোঝেন না। এক্ষেত্রে যোগাযোগের তাগিদে বোঝাপড়ায় সমস্যা হয়।

বর্তমানে বৈশ্বিক মেরুকরণের এ সময়ে আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু পাশ্চাত্য থেকে সরে এসে প্রাচ্যমুখী হচ্ছে। যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ চীন, জাপান, কোরিয়ায় বিপুলসংখ্যক জনশক্তি রফতানির যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটি কাজে লাগাতে হলে আমাদের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ভাষা শেখার বিষয়ে সর্বোচ্চ মনোযোগী হতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে স্প্যানিশ ভাষার প্রচলন থাকায় এ ভাষা শেখার প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। এছাড়া ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষার প্রতিও তরুণদের আগ্রহ লক্ষণীয়। আর মুসলিম দেশ হিসেবে ধর্মীয় কারণেই আরবি ভাষা শেখার চর্চা আমাদের দেশে বহু আগে থেকেই রয়েছে।

বিদেশি ভাষা শেখার জন্য বিভিন্ন ইনস্টিটিউট যেমন রয়েছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে। এছাড়া শিক্ষার্থীরা মূলত অধ্যয়নের পাশাপাশি বিদেশি ভাষা শেখার চর্চা করে। আবার কোনো কোনো বিভাগে শর্ত দেয়া থাকে ইংরেজি ছাড়া আরো একটি বিদেশি ভাষা শিখতে হবে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগে আরেকটি ভাষা বাধ্যতামূলকভাবে শিখতে হয়।

মূলত ভাষা শেখার জন্য আন্তরিকতা ও নিবিড় চর্চার প্রয়োজন হয়। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে শুধু ভাষা সিলেবাসের আওতাভুক্ত করলেই হয় না। যে কারণে দীর্ঘ ১২ বছর বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজি ভাষা শেখানোর পরও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে না পারা একধরনের ব্যর্থতাই বটে। এজন্য ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে তোলার পাশাপাশি অন্য কোনো ভাষা মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের জন্য আওতাভুক্ত করা যায় কিনা সেটি বিবেচনা করা প্রয়োজন।

মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ায় আরবি ভাষা শেখার গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছিলাম। যেহেতু আমাদের দেশে এখন মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী আলিয়া, কওমি, হাফেজি ও নুরানি ঘরানা মিলিয়ে দেশের মাদ্রাসাগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ২৬ লাখ ৫৭ হাজার ২৫২ জন। কিন্তু এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে আরবি ভাষায় দক্ষ জনশক্তি প্রেরণে হিমশিম খেতে হয়। কারণ ধর্মীয় কারণে কোরআন-হাদিস অধ্যয়নকে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় এ গ্রন্থগুলোয় যে ধ্রুপদি আরবিতে ব্যবহার করা হয়েছে মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যক্রমে সেদিকেই বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। এর ফলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষা পড়লেও এ ভাষায় শুধু মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে সনদ অর্জন ছাড়া কোনো দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না।

ভাষা শেখার বিষয়টি এখন শুধু একাডেমিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত না, এর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। যে কারণে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বাণিজ্যের স্বার্থে আমাদের নতুন ভাষা শিখতে হয়। ঠিক তেমনি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য হলেও অন্য একটি ভাষা আমাদের মনোজগৎ প্রসারিত করে।

বস্তুত একটি নতুন ভাষা শেখা মানে সে ভাষার অবারিত দিগন্ত চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া। এছাড়া একটি ভাষা শেখার প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্ক শাণিত হয়, বুদ্ধিমত্তা প্রখর হয়। আর নতুন যেকোনো কিছু শেখাই বেশ আগ্রহ উদ্দীপক। যদি শেখার ইচ্ছে থাকে।

বর্তমানে অন্তর্জালের দুনিয়ায় বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষের সঙ্গেই যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। তাই মৌখিক, লিখিত ও শ্রবণের ক্ষেত্রে ভাষাচর্চার সুযোগ এখন অবারিত।

বর্তমান সময়ে ভাষা শিক্ষাকে কেবল সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিবেচনা না করে এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে চলতি বিশ্বে ভাষার ভূমিকা আরো বৃদ্ধি পাবে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের তরুণ জনশক্তিকে ভাষার এ উন্মুক্ত স্রোতের সঙ্গে নিজেদের দক্ষ করে তুলতে হবে। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে আরো সমৃদ্ধির পথে ধাবিত করতে এর বিকল্প নেই।

তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক

আরও