আমাদের জীবনধারণের জন্য খাদ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে খাদ্য সরবরাহের যে প্রক্রিয়াটি রয়েছে সেটি সবসময় গুরুত্ব পেয়ে থাকে। আর এ প্রক্রিয়ার মধ্যেই চাহিদার কথা বিবেচনা করে মজুদদারির উদ্ভব হয়। এক্ষেত্রে মানুষকে কষ্ট দিয়ে হলেও ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার যে মানসিকতা কাজ করে তা দুঃখজনক। কিন্তু এটি হয়ে আসছে এবং যেকোনো সংকটেই মজুদকৃত খাদ্যদ্রব্য পাওয়া খুব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ব্যবসার জন্য খাদ্য মজুদ করা অস্বাভাবিক নয়, মূলত বাজার অস্থিতিশীল করার জন্য অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ সংকট তৈরি করে থাকে। এটিকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
অতিরিক্ত মজুদদারির বিষয়টি আইনের আওতায় থাকলেও কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাই আইন হালনাগাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রস্তাবিত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২৩-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। আইনের খসড়া অনুমোদনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সরকার নির্ধারিত পরিমাণের বেশি খাদ্যদ্রব্য মজুদ করলে বা মজুদসংক্রান্ত সরকারের নির্দেশনা অমান্য করলে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাবেন। অবশ্য শর্ত হিসেবে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এসব অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে তিনি আর্থিক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে লাভবান হওয়ার জন্য মজুদ করেননি তাহলে তার অনধিক তিন মাস কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আইন তো আগেও ছিল, তাহলে নতুন আইন করে কি সুফল মিলবে? বিদ্যমান মজুদ আইনে কী রয়েছে? ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুদদারি নিষিদ্ধ করে এ অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ২(ঙ) ধারায় মজুদদারির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মজুদদারি বলতে বোঝায়, কোনও আইন দ্বারা বা আইনের আওতায় কোনও ব্যক্তি মজুদ বা গুদামজাত করার সর্বোচ্চ পরিমাণের বেশি দ্রব্য মজুদ বা সংরক্ষণ করা।’ এ আইনের ২৫ (১) ধারার বিধানে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কেউ মজুদদারি বা কালোবাজারে লেনদেনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তার আজীবন কারাদণ্ড বা চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। যদি প্রমাণ হয় যে, মজুদদার কোনও লাভের জন্য পণ্য মজুদ করেনি, তাহলে ৩ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।’
এখানে দেখা যাচ্ছে, খসড়া আইনে শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। আগে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান না থাকলেও এবার করা হচ্ছে। কিন্তু আইনের কার্যকারিতা না থাকায় নতুন আইন করলেও তাতে কোনো সমাধান আসবে কিনা সেটি এখন মোটাদাগে বিবেচ্য বিষয়।
এছাড়া বিদ্যমান আইনে ১৯৫৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ীরা সুবিধাজনক জায়গায় বা নিজেদের দোকান ও গুদামের সামনে পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য তালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে। নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রয়ের তারিখ ও মেয়াদও সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারবে।’ ধারা ৮-এ বলা হয়েছে, ‘কোনও ব্যবসায়ী সরকারের দেওয়া পূর্ব-কর্তৃত্ব ছাড়া কোনও ব্যক্তির কাছে কোনও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বিক্রি আটকে রাখতে পারবে না বা বিক্রি করতে অস্বীকার করতে পারবে না। এ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ দেশে এতদিন আইনের এ ধারাগুলো থাকলেও অতিরিক্ত মজুদদারি রোধে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি।
উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সরকারের কঠোর ভূমিকা রয়েছে। এমনকি চীনে ২০১৫ সালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যেটি বাংলাদেশেও করা হবে এমন গুঞ্জন থাকলেও খসড়া আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে সীমাবদ্ধ থাকল। যুক্তরাষ্ট্রে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অথরিটি (এফডিএ) নাগরিকদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সতর্ক ভূমিকা পালন করে। কেউ যেন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ না করতে পারে, এজন্য দেশটিতে কঠোর তদারকি চালানো হয়। চীনে বর্তমানে খাদ্যনিরাপত্তা আইন বিঘ্নিত করলে প্রয়োজনে একজন ব্যবসায়ীকে বছরে ১০ বার জরিমানা করার বিধান রয়েছে।
আইন জনগণের কল্যাণে মানুষের চাওয়াকে নিয়ন্ত্রিত করতে চায়। যে কারণে আইনের শাসন না থাকলে যেকোনো ক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ অবস্থায় মানুষের প্রয়োজনের সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত লাভের আশায় খাদ্যদ্রব্য মজুদ করলে তাতে বাজারে সংকট তৈরি হয়। এটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। যে কারণে মূলত বাধ্য হয়েই নতুন আইন প্রণয়নের চিন্তা করতে হয়। কারণ এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর অতিরিক্ত মুনাফাপ্রীতি বিদ্যমান আইনে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কিন্তু আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আইন বদলালেই কি সমাধান আসবে? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবির ফলে সড়কে গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হত্যা করলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করলে ৩ লাখ টাকা জরিমানা ও তিন বছরের জেল হতে পারে বলা হয়েছে। কিন্তু এ আইন হওয়ার পর সড়কে যতগুলো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো দৃশ্যমান বিচার হয়নি। মামলাজট আর বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় অভিযোগগুলো আটকে রয়েছে।
তার মানে দাঁড়ায়, মানসিকতা পরিবর্তন না হলে আইনের মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে খাদ্যগুদামগুলোয় অভিযান চালানো হলে অতিরিক্ত মজুদ করা খাদ্যদ্রব্য উদ্ধার করা যেতে পারে। কিন্তু কঠোর শাস্তির উদাহরণ না থাকলে দিনের পর দিন এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এজন্য প্রকৃতপক্ষে ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা চর্চার কোনো বিকল্প নেই। ধর্মেও অতিরিক্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে জনগণকে কষ্ট দিতে নিষেধ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে অভাবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের কথা ভেবে ব্যবসায়ীদের শিষ্টাচার অনুশীলন প্রয়োজন। এটি মনে রাখতে হবে, সব ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার কথা ভাবেন না, এক্ষেত্রে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর ভূমিকা রয়েছে। তাদের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে খাদ্য সরবরাহের চেইন যেন ঠিক থাকে সেটিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারের উদ্যোগে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করায় আরো সক্রিয় হতে হবে। সে সঙ্গে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য যেন সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে চুরি না হয়, সেজন্য শক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। এজন্য টিসিবির পণ্য ২০২১ সালের মতো ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভালো হতো। মোট কথা, বাজারে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ থেকে সরবরাহ এবং বিপণনে টিসিবিকে আরো কার্যকর করতে হবে, যেন ব্যবসায়ী পর্যায়ে অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ করার কোনো সুযোগ তৈরি না হয়।
তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক