আলোকপাত

ডেঙ্গুতে আর্থিক ক্ষতি ঠেকাতে টেকসই পরিকল্পনা জরুরি

ক্ষুদ্র পতঙ্গ মশা, কিন্তু তার দ্বারা সাধিত অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক বেশি। পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ২০০ প্রজাতির মশা বিভিন্নভাবে মানুষের রোগশোকের জন্য দায়ী।

ক্ষুদ্র পতঙ্গ মশা, কিন্তু তার দ্বারা সাধিত অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক বেশি। পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ২০০ প্রজাতির মশা বিভিন্নভাবে মানুষের রোগশোকের জন্য দায়ী। মশাই একমাত্র প্রাণী যে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ নিয়েছে। আর মানুষের মৃত্যু ঘটানোর জন্য দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মানুষ। 

প্রতি বছর মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যায় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মশাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য; বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শীর্ষ হুমকির তালিকাভুক্ত করেছে। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে এবং মশার কামড়-পরবর্তী জটিলতার সম্মুখীন হওয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ করে, যার ফলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশগুলো। 

বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৬ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে ঢাকায় পাওয়া গেছে ১৬ প্রজাতির। উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং  মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ না করার কারণে বাংলাদেশে মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনকেফালাইটিস। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) গবেষণায় জিকারও অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। 

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে ডেঙ্গু রোগের ঝুঁকি দ্রুত বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা প্রজনন ও বসবাসের জন্য নতুন নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি এবং ডেঙ্গুর সংক্রমণও বাড়ছে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের সরাসরি সম্পর্ক নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এখনো পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি, তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা যে করোনাভাইরাসের মতো ডেঙ্গু ভাইরাসও পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম।

বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতি বছরই বর্ষাকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব তীব্র হয়। বিশেষত, বর্ষার সময় জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে এডিস মশা দ্রুত প্রজনন করে। রোগীর সংখ্যা বছরে বছরে পরিবর্তিত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমন্বয়ে বেড়ে চলেছে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ২০০ রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান শুধু ঢাকার ৭৭টি হাসপাতাল ও অন্যান্য কয়েকটি জেলা হাসপাতালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। বাস্তবতা হচ্ছে যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড় ক্লিনিকে আরো অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে এবং এমন অনেক রোগী আছে যারা ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে। প্রতিবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ একই সময়ে ফিরে আসছে এবং আমরা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। এডিস মশা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

এবছর ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৮০ জন মারা গেছে। গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭০৫। সাম্প্রতিক আক্রান্তের পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে সামনের দিনগুলোয় এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।

ডেঙ্গুর প্রকোপ কম বা বেশি হওয়ার পেছনে জনসাধারণের সচেতনতা, এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে তাদের সহযোগিতা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উল্লেখ করেছিলাম যে অক্টোবর ডেঙ্গুর জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে। গবেষণায়ও সেই পূর্বাভাস বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গবেষক দল ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্বের যে গবেষণা করছে, তা থেকেও স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে যে পরিস্থিতি খুবই জটিল। ব্রুটো ইনডেক্স নামে পরিচিত মশার ঘনত্বের সূচক যদি কোনো এলাকায় ২০-এর ওপরে থাকে, তবে সেই এলাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রভৃতি রোগের ঝুঁকি বেশি হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে ব্রুটো ইনডেক্স এখনো ২০-এর ওপরে রয়ে গেছে। এডিস মশার ঘনত্ব এমন থাকলে নভেম্বর-ডিসেম্বরে শীতের মাঝেও ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে না।

আমাদের দেশে সাধারণত শীতকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ কমে আসে। কারণ ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মশার প্রজনন কম হয়। তবে চলমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে যে এ বছর পরিস্থিতি ব্যতিক্রমী হতে পারে। তাই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো তৎপর হতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও বেশিসংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অন্যান্য বছরের মতো খুব বেশি কমবে না।

গত ১২ এপ্রিল জাতীয় দৈনিকের একটি প্রতিবেদন ‘‌মশার পেটে ১ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা’। হেডলাইনটি চমকে যাওয়ার মতো, যদিও হিসাবটি গত ২৭ বছরের বলে জানিয়েছেন প্রতিবেদক মতিন আব্দুল্লাহ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ডেঙ্গুর আর্থিক ক্ষতি নিয়ে একটি গবেষণা করেন। তাদের গবেষণামতে প্রতিজন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য গড়ে ৩৯ হাজার ৮৯৩ টাকা খরচ করেছে।  সরকারি হিসাবমতে ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ রোগী হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছে। তাহলে তাদের মোট ব্যয় হয়েছে ৪০৪  কোটি টাকা। এ ব্যয় শুধু চিকিৎসা ব্যয়। এছাড়া হাসপাতাল পরিচালনা, পরিবহন, রোগী ও তার পরিবারের লোকদের শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ব্যয় আরো অনেক বেশি। ২০২২ সালেও ৬২ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী ২০২৩ সালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে হাজার কোটি টাকার ওপরে। তাদের তথ্যমতে ২০১৯ সালে ব্যক্তি পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৫৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।  তবে যারা হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছে তাদের খরচ এবং ডেঙ্গু থেকে নিরাপদে থাকতে মশা প্রতিরোধী কয়েল, স্প্রেসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার খরচ এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দি ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সে প্রকাশিত সায়মা ইসলাম ও ইফতেখারুল হকের গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৯-২০ সালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় অর্থনৈতিক ব্যয় প্রায় ১৫ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার। ডেঙ্গু মোকাবেলার সামগ্রিক ব্যয় আরো বাড়বে, যদি বহির্বিভাগের রোগীর খরচ এবং রোগী ও তার স্বজনদের শ্রমঘণ্টা হিসাবের মধ্যে আনা হয়। হাসপাতালে ভর্তি ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা খরচের পাশাপাশি এ রোগ থেকে বাঁচতে মশা প্রতিরোধে স্প্রে, কয়েল, ব্যাট, মশারিসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম কেনার খরচ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। 

ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের চিকিৎসা বা মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করার অর্থনৈতিক ক্ষতি একমাত্র ক্ষতি নয়। মশা গবাদিপশু ও অন্যান্য পশুর ক্ষতি করে। এ ক্ষতির অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে কিছু বিতর্ক আছে। তবে অনুমান করা হয়, পৃথিবীতে বার্ষিক ৬১ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে।

মশাবাহিত রোগের চিকিৎসায় জনগণ নিজেদের পকেট থেকে ব্যয় করেছে। তবে সরকারকেও প্রচুর টাকা ব্যয় করতে হয়েছে, যা এখানে অন্তর্ভুক্ত নয়। তাছাড়া মশাবাহিত রোগ আতঙ্কে অনেকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার আর্থিক ক্ষতি হিসাব করা যায় না। 

বিশ্বাস করি, সিটি করপোরেশন, স্থানীয় প্রশাসন ও নগরবাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টেকসই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এ সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ডেঙ্গু সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান হতে পারে, যা শুধু ডেঙ্গু নয়, অন্যান্য মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধেও কার্যকর হবে। ডেঙ্গু ২০১৯, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বিপুল জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করেছে এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এমন পরিস্থিতি ভবিষ্যতেও হতে পারে। তাই এর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশে যেসব গবেষক মশা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তাদের সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার একটি বিজ্ঞানভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের অবর্ণনীয় কষ্ট ও আর্থিক ক্ষতির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারলে দেশের বড় রকমের অর্থনৈতিক ক্ষতি ঠেকানো সম্ভব।  

ড. কবিরুল বাশার: কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও