রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য ক্ষমতায় যাওয়া। এজন্য জনগণের সমর্থন প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে দলগুলো ক্ষমতায় যায়। কিন্তু আমাদের দেশে দীর্ঘ ৫২ বছরেও আস্থাশীল নির্বাচন পদ্ধতি গড়ে ওঠেনি। ফলে যে দল ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়, তারাই বিজয়ী দলের প্রতি অভিযোগ তোলে। রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকা হরতাল, অবরোধে গাড়ি পোড়ে। দুষ্কৃতকারীদের ওপর দায় চাপানো হলেও যার ক্ষতি হয়, কষ্টটা সে বোঝে।
দেশের অর্থনীতি বর্তমানে স্থবির। বিনিয়োগে সুসংবাদ নেই। নিত্যপণ্যের দামে জর্জরিত সাধারণ মানুষ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশ কমছে। রেমিট্যান্স আসা কমে গেছে। এর মধ্যে পণ্যবাহী গাড়িতে যখন আগুন দেয়া হয়, তার প্রভাব সরাসরি অর্থনীতির ওপর পড়ে।
এভাবে হরতাল-অবরোধ ডেকে সাধারণ মানুষকে তা পালনের আহ্বান জানানো হলেও সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ছে না। এখন হরতালেও রাস্তায় জ্যাম থাকে। তার মানে, হরতাল এখন পুরনো ধারণায় পর্যবসিত হতে চলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিই এখন ব্যর্থ হতে বাধ্য। এবার আসা যাক পরিবর্তন প্রসঙ্গে। তরুণরা একটি দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। বলা হয়, যেকোনো পরিবর্তন তরুণদের হাত ধরেই আসে। উষ্ণ হৃদয় আর ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের সম্মিলনে তরুণ সমাজ যেকোনো দুর্বার স্বপ্ন জয়ের সাহস বুনতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে ২০২৩’-এ ৪২ শতাংশ তরুণের বিদেশে যেতে চাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ জরিপ নিয়ে তুমুল আলোচনা দেখেছি। কেউ কেউ এটিও বলেছে বাকি ৫৮ শতাংশের কাছে নাকি জরিপের প্রশ্নমালা পৌঁছেনি। আবার জরিপের ক্ষেত্রে এটিও লক্ষণীয়, সংকটের সমাধান হলে ৮৫ শতাংশই আবার দেশে ফিরে আসার কথা বলেছেন। তাহলে দেশের সার্বিক সংকট তরুণদের দেশে থাকতে উদ্বুদ্ধ করতে পারছে না, এটিই তাহলে নির্মম সত্যে পরিণত হয়েছে।
অবশ্য এটি একটি বাস্তবতা, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের তরুণরা পাড়ি দেয়। কিন্তু এ পাড়ি দেয়া যেন সম্মানজনক হয় সেটি দেখার দায়িত্ব সরকারের। দালালদের প্রলোভনের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে কর্মহীন থাকা কিংবা ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধির মাধ্যমে এসব স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে সম্প্রতি বিদেশগামীদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে, কিন্তু বিদ্যমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোয় মানসম্মত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত না করার অভিযোগ উঠেছে। তাই অদক্ষ, স্বল্প দক্ষ কর্মী পাঠিয়ে যেন দায় পূরণ হচ্ছে।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করা স্বাধীন দেশের এমন হাল কেন হলো? কেন দেশটাকে তরুণদের স্বপ্নের দেশ হিসেবে গড়ে তোলা গেল না? দেশে কিসের ঘাটতি রয়েছে? জনসংখ্যাকে কি জনসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব হলো না? অথচ দেশের অর্থনীতির আকার বহু গুণে বেড়েছে। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তাহলে কেন তরুণরা দেশকে স্বপ্নের দেশ বলে ভাবতে পারছে না?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধান জরুরি। দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে পদে পদে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। আবার রয়েছে হামবড়া মনোভাব। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে কেউ ড্রাগন ফলের চাষ করলে তাকে সার্টিফিকেটের বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। সবার লক্ষ্যই এখন যেন বিসিএস ক্যাডার হওয়া। এ সোনার হরিণকে ধরতে গিয়ে অনেকেরই জীবন থেকে যৌবনের মূল্যবান সময় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে কোনো বেসরকারি চাকরি পেলেও সরকারি চাকরি না পাওয়ার আফসোস থেকে যাচ্ছে। অথচ বেসরকারি খাতেই ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়।
স্টুডেন্ট ভিসায় তরুণদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৫৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৩।
দেশে এত বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও জেলায় জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কথা বলা হচ্ছে। এতে শিক্ষার মান বাড়বে না কমবে তা নিয়ে কারো চিন্তা নেই। গবেষণার বদলে শুধু সনদধারী বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাই শিক্ষাবিদরা করছেন। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে উদাসীনতার সুযোগে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। এতে মেধা পাচারের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে মেধার কদর না পেলে দেশে মেধাবীরা থাকবে না এটিই স্বাভাবিক। একবার বিদেশে যেতে পারলেই দেশগুলোয় সেটেল হয়ে যাওয়ার মানসিকতাই অধিকাংশ তরুণ লালন করে। খুব কমই দেশে ফিরে এসে কর্মজীবন সাজায়।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র রাজনীতির আঁতুড়ঘর হিসেবে বিবেচিত হয় কিন্তু এ রাজনীতি কতটা শিক্ষার্থীদের কল্যাণে হচ্ছে তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। তাই তো দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়তে এসে অসুস্থ গ্রুপিংয়ের কবলে পড়ে গণরুমে পচতে থাকে সিংহভাগের স্বপ্ন। তরুণরা দেশ ছাড়তে কতটা আগ্রহী তার প্রমাণ মেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনে মার্কশিট তোলার দীর্ঘ লাইন দেখে (স্কলারশিপের জন্য যে বিস্তারিত মার্কশিট প্রয়োজন হয়)।
এভাবেই হতাশা নিয়ে বেড়ে ওঠে তরুণের একাংশ। মাঝেমধ্যে জীবনের ঘানি আর বইতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। মেধাবী ছেলে বা মেয়েটি মারা যাওয়ার পর সবার হুঁশ হয়, অথচ বেঁচে থাকতে প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়া হয়। বস্তুত আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তরুণদের নতুন করে ভাবতে শেখায় না। দীর্ঘদিনের জলাঞ্জলি চাপিয়ে দিয়ে পুরনো ব্যবস্থায় তরুণরা বেড়ে উঠুক এটিই সমাজের অভিভাবক শ্রেণীর প্রত্যাশা। কিন্তু আবিষ্কার আর উদ্ভাবনের নেশায় তরুণদের সৃজনশীলতার পৃষ্ঠপোষকতা খোদ রাষ্ট্রও করতে চায় না। রাষ্ট্র কাঠামো পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তরুণদের বীতশ্রদ্ধ হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে।
এটিই কি ’৭১ এর স্বপ্ন ছিল? বিশ্বের বুকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে জাগ্রত হওয়ার জয়গান তো তরুণরাই গেয়েছে। ৫২টি বিজয়ের ক্ষণ পেরিয়ে আরেকটি বিজয় দিবস দুয়ারে কড়া নাড়ছে। এদিন তরুণরা সবাই বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠবে। কিন্তু এ আনন্দ উদযাপন শুধু সাময়িক না হয়ে তরুণদের মেধা, মনন ও গতিশীলতায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাবে, এটিই প্রত্যাশা।
রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলছিলাম, এবারের নির্বাচনেও দলগুলো তরুণ ভোটারদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করবে। অনেক দল তরুণদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নও দিয়েছে। ‘আই হেট পলিটিকস’ প্রজন্মের কাছে রাজনীতির বার্তা পৌঁছে দেয়া খুব কঠিন, এটা রাজনৈতিক দলের নেতারাও জানেন। তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার মন্ত্র বুনে দিতে হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যুগোপযোগী সংস্থারসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সর্বোপরি দেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। তরুণরা যেন হতাশ না হয়ে যায়, এজন্য তরুণদের স্বপ্নের দেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। প্রবীণদের প্রজ্ঞা ও তরুণদের মেধার স্ফুটন—এ দুয়ের সমন্বয়ে আগামীর বাংলাদেশ গড়ে উঠুক, দেশটা তরুণদের স্বপ্নের দেশ হোক, এটিই আমাদের কাম্য।
তৌফিকুল ইসলাম: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা