এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল

কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার ঠেকাতে সেলকে গতিশীল করা হোক

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শাখা কোম্পানির সুদ, মুনাফা, কোনো সম্পদ কিংবা পণ্যের মূল্য মূল কোম্পানিতে পাঠায়। এছাড়া পণ্য বা সেবা আমদানির মূল্যও মূল কোম্পানি বা অন্য কোনো কোম্পানিকে পাঠায়।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শাখা কোম্পানির সুদ, মুনাফা, কোনো সম্পদ কিংবা পণ্যের মূল্য মূল কোম্পানিতে পাঠায়। এছাড়া পণ্য বা সেবা আমদানির মূল্যও মূল কোম্পানি বা অন্য কোনো কোম্পানিকে পাঠায়। এটি ট্রান্সফার প্রাইসিং নামে পরিচিত। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় পণ্যের দর কম বা বেশি দেখিয়ে কিংবা মুনাফার অর্থ প্রেরণে মিথ্যা তথ্য দেয়ার মাধ্যমে কর ফাঁকির পাশাপাশি অর্থ পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার ঠেকাতে বিগত সরকার ২০১৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠন করে। কিন্তু সেলটি এখনো সম্পূর্ণভাবে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। ফলে এসব কর ফাঁকি বা অর্থ পাচারও ঠেকানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের যথাযথ তদারকিতে যে অবকাঠামো দরকার সেখানেও পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব রয়েছে।

নানা ত্রুটি ও দুর্বলতায় গঠনের এক যুগ পরও সেলটি পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারেনি এখনো। এমনকি কোনো মূল্য লুকোচুরির তথ্যও উদ্ঘাটন করতে পারেনি তারা। যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে সেলটি গঠন করা হয়েছিল তা বাস্তবায়নে দ্রুত সেলটির কার্যক্রম গতিশীল করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া অতীব জরুরি। কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার রোধ করতে এবং রাজস্ব আহরণ বাড়াতে এ সেলের গতিশীলতার বিকল্প নেই।

যেসব দেশে কর হার বেশি সেসব দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কৌশলে কর হার কম দেশগুলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তর করে থাকে। এভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো কর কম দিলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঠিকই আয় বাড়ে। এভাবে অপেক্ষাকৃত বেশি করের দেশগুলো প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবে বিশ্বজুড়ে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি কর এড়িয়ে যায় বা ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ ধরনের কিছু ফাঁকির তথ্য পেয়েছে।

শুধু মূল কোম্পানি ও শাখা কোম্পানি ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের নামে কারসাজির সঙ্গে জড়িত নয়, বরং অন্য কোনো কোম্পানি পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেও মূল্য কারসাজি করে থাকে। এর ফলেও সংশ্লিষ্ট দেশ কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। বহুজাতিক কোম্পানিসহ আন্তর্জাতিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে ও কাঙ্ক্ষিত কর আদায়ের লক্ষ্যে সরকার ২০১২ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন প্রণয়ন করে। এটি কার্যকর হয় ২০১৪ সালে। এ লক্ষ্যে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠন করা হয়। অবশ্য আইন প্রণয়ন ও সেল গঠনের এক যুগের পরও বৈদেশিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলোর লেনদেনে স্বচ্ছতা আনার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। বৈদেশিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে সেলের কার্যক্রম দৃশ্যমান করতে জোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সেলটি গতিশীল হলে সম্পদ হস্তান্তর, আন্ডার ইনভয়েস, ওভার ইনভয়েস রোধের মাধ্যমে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে। বিদেশী কোম্পানিগুলোর আন্তর্জাতিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আসবে।

সেলটিকে গতিশীল ও কার্যকর করতে দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা। বিগত সময়ে বারবার পরিবর্তন আনা হয়েছে সেলপ্রধানের দায়িত্বেও। টেকসই ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় সবদিক দিয়েই সেলের কার্যক্রম পিছিয়ে রয়েছে। যদিও এনবিআর সূত্র বলছে, ২০১৫ সাল পর্যন্ত কয়েকজন কর্মকর্তাকে দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও মরক্কোয় প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। গত দুই বছরে দেশে নয় কর্মকর্তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ২০২৫ সালে পোল্যান্ডে পাঁচজনকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হবে।

দেশে কর্মরত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করতে প্রয়োজন বৈশ্বিক ডাটাবেজ বা তথ্যভাণ্ডারে যুক্ত হওয়া। এ ধরনের তথ্য সংরক্ষণকারী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ তথ্যভাণ্ডারে যুক্ত হতে পারলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আন্তর্জাতিক লেনদেনের তথ্য সহজেই পাওয়া সম্ভব হবে। ফলে এসব কোম্পানির যথাযথ নিরীক্ষা তথা লেনদেন আইনানুগ উপায়ে পাঠানো কিংবা বেশি দাম দেখিয়ে কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ পাঠানো হয়েছে কিনা তা সহজেই জানা যাবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক তথ্য লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনায় অন্যতম বড় বাধা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশাধিকার না থাকা। এ ধরনের ডাটাবেজে যুক্ত হতে দরকার প্রচুর অর্থায়ন। কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার রোধ করতে ডাটাবেজে যুক্ত হওয়ার বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করতে পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ বা তথ্যভাণ্ডারে যুক্ত হতে পারেনি। জানা গেছে, ইইউর অর্থায়নে এক বছরের জন্য বেঞ্চ মার্কিং টুল ডাটাবেজ ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছে এনবিআর। চলতি অক্টোবর থেকে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর মেয়াদ। তারপর পুনরায় মেয়াদ নবায়ন করতে হবে।

কর আহরণ শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থ জোগানো নয়, এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠারও অন্যতম মাধ্যম। ধনীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করে দরিদ্র গোষ্ঠীকে সহযোগিতা করা এটি রাষ্ট্রীয় ন্যায্যতার বড় স্তম্ভ। না হলে বৈষম্য মোকাবেলা কঠিন। এ সামাজিক দৃষ্টিকোণের বাইরে উন্নয়নের জন্যও কর আহরণ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে ‘বিশ্বের সবচেয়ে কম’ কর-জিডিপির অনুপাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ অনুপাত বাড়াতে সরকারকে বিভিন্ন সময়ে নানা পরামর্শ দিয়েছে; ঋণের বিপরীতে শর্ত হিসেবেও যুক্ত করে দিয়েছে এটি বাড়ানোর। সরকারও নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এ অনুপাত বাড়েনি, উল্টো কমছেই। যদিও এর কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে যে জিডিপি রয়েছে তা বিগত সরকারের বানোয়াট জিডিপি। কাগজে-কলমে এত বড় জিডিপি দেখানো হলেও বাস্তবে তা এত বড় নয়। সে কারণেই মূলত জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। বানোয়াট জিডিপির অনুপাতে কর আহরণ বাড়াতে এনবিআরকে সবসময়ই প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করে নির্ভরশীল হতে হয়েছে। ফলে সাধারণ জনগণের ওপর বেড়েছে করের চাপ।

কাজেই করদাতাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরো উৎসাহিত, প্রচার-প্রচারণা ও জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। এছাড়া কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও সহজীকরণ করতে হবে। চালিয়ে যেতে হবে আইনি ও কাঠামোগত সংস্কারগুলো। বহুজাতিক কোম্পানির তথ্য পর্যালোচনায় যেসব উদ্যোগ নেয়া দরকার তা নিতে হবে। সর্বোপরি বিনির্মাণ করতে হবে কর পরিপালনের সংস্কৃতি ও সহায়ক পরিবেশ। রাষ্ট্রীয় অব্যাহত প্রচেষ্টায় এক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি ঘটবে—এটিই প্রত্যাশা।

আরও