দেশে চালের ক্রেতা-ভোক্তারা আশা করেছিলেন, আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুমে বাজারে চালের দাম কমবে। তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। চালের দাম না কমে বরং বেড়েছে। ১০ জানুয়ারি বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরে বাজারে শুরু হওয়া আমনের সরবরাহ পুরাদমে চালু থাকলেও মিল, পাইকারি ও খুচরা সব পর্যায়ে চালের দাম বাড়ছে। শুধু পাইকারিতেই গত এক সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৬ টাকা। ১২ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমন ধান কাটা-মাড়াই চলাকালে বাজারে পাইকারি থেকে খুচরা সব পর্যায়েই চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। ১৩ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বস্তাপ্রতি (৭৫ কেজি) চালের দাম বেড়েছে ২০০-২৫০ টাকা। আর প্রকারভেদে কেজিপ্রতি চলের দাম বেড়েছে ৬ থেকে ১০ টাকা। আমনের ভরা মৌসুমে চালের দামে কেন ঊর্ধ্বগতি তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
নব্বইয়ের দশকের প্রায় শেষ দিক পর্যন্ত দেশে চাল উৎপাদনে আমনের অবস্থান ছিল শীর্ষে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৫-এর তথ্য মোতাবেক ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে দেশে আমন, বোরো ও আউশ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৮৮ লাখ ৫০, ৮১ লাখ ৩৭ ও ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টন। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে ১ কোটি ৫ লাখ ৫২ হাজার টন চাল উৎপন্ন করে বোরো শীর্ষস্থান দখল করে নেয় এবং বছরে দেশে উৎপাদিত চালের কমবেশি ৫৫ শতাংশ উৎপন্ন করে শীর্ষস্থানটি এখন পর্যন্ত দখলে রেখেছে। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে ৭৭ লাখ ৩৬ হাজার টন চাল উৎপন্ন করে আমন দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসে এবং বর্তমানে ওই অবস্থানেই রয়েছে। আউশের অবস্থান সবসময় তৃতীয়।
চলতি মৌসুমে আমন উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে এখন পর্যন্ত দুই ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) বরাত দিয়ে বণিক বার্তার ১০ জানুয়ারির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি আমন মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল ডিএই। মোট ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টরে এ বছর ধান আবাদ করা হয়েছে। পোকামাকড়ের আক্রমণ এবং ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ও মিগজাউমের প্রভাবে ৪০ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বিবেচনায় নিয়ে এবার প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ টন আমন চাল উৎপাদন হওয়ার কথা। এদিকে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ২৯ ডিসেম্বর দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার মৌসুমের শুরুতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে একদিকে যেমন আমন রোপা কার্যক্রম দেরিতে শুরু হয়, অন্যদিকে আমন চাষের জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ কমে ৫৭ দশমিক ৫০ লাখ হেক্টরে দাঁড়ায়। তাছাড়া নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর দণ্ডায়মান ধান ফসলের ৫-১০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে ইউএসডিএ বাংলাদেশে এ বছর আমন উৎপাদন আগের প্রাক্কলন থেকে এক লাখ টন কমিয়ে ১ কোটি ৩৯ লাখ টন নির্ধারণ করেছে। দেশে খাদ্যশস্যের, বিশেষ করে চাল উৎপাদনে ডিএইর হিসাবের সঙ্গে ইউএসডিএ ও বিবিএসের হিসাবের গরমিল নতুন নয়। উদাহরণস্বরূপ, ডিএইর হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে চালের মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮৭ লাখ টনে, যা বিবিএসের হিসাবে ছিল ৩ কোটি ৬৬ লাখ টন। বিবিএসের হিসাবের সঙ্গে ডিএইর হিসাবের পার্থক্য দাঁড়ায় প্রায় ২১ লাখ টনে। আবার ইউএসডিএর হিসাবের সঙ্গে পার্থক্য দাঁড়ায় ২৮ লাখ টনে। বণিক বার্তার উপর্যুক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী গত অর্থবছরেও চালের মোট উৎপাদন নিয়ে ডিএই ও বিবিএসের তথ্যে গরমিল ছিল ১৬ লাখ টনেরও বেশি। শুধু প্রধান খাদ্যশস্য চালের ক্ষেত্রে নয়, দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গম ও অন্যান্য অপ্রধান শস্যের ক্ষেত্রেও হিসাবের গরমিলের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
আমনের ভরা মৌসুমে চালের দামে ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী কারণগুলো হলো এক. গত ৭-৯ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) বার্ষিক সম্মেলনে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন নিষেধাজ্ঞা দেশের খাদ্যনিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মার্চে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখছেন। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বা দুর্ভিক্ষের এমন আশঙ্কায় চালকল মালিক ও অন্যান্য মজুদদার ভবিষ্যতে বেশি লাভের আশায় ধান-চাল মজুদের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এবার মিলার ও বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করে বাড়তি দামে ধান কিনছে, যার প্রভাব এখন বাজারে পড়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় প্রতি মণে ২০০-৩০০ টাকা বেশি দামে ধান বিক্রি হচ্ছে। এতে চালের দাম বেড়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে পরিচালিত এক অনুসন্ধান রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুনে ধান মজুদে বড় ও মাঝারি কৃষকের অংশ ছিল ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ শতাংশের কিছুটা বেশি মজুদ ছিল চালকল মালিকদের কাছে। অবশিষ্ট কমবেশি ২০ শতাংশ মজুদ ছিল ব্যবসায়ীদের কাছে।
দুই. ধানচাষীরা চাল বিক্রি করেন না; তারা বিক্রি করেন ধান। ধারণা করা হচ্ছিল চালকল মালিকরা বিপুল পরিমাণে কেনা ধান চালে রূপান্তর করছেন এবং সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে অপর্যাপ্ত পরিমাণে চাল বাজারে ছেড়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে বেশি পরিমাণে লাভ করছেন। যুগান্তরের একটি প্রতিবেদনে এ ধারণার সত্যতা পাওয়া যায়। পাইকারি চাল ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে ১৪ জানুয়ারি যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েকদিন ধরে মিল পর্যায় থেকে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে না। পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ চালের অর্ডার দিচ্ছেন, মিল থেকে দেয়া হচ্ছে তার কম। এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। করপোরেট কোম্পানিগুলোরও নিজস্ব মিল ও দোকান আছে। তারাও প্রয়োজনে চাল মজুদ করে ও সুযোগ বুঝে বাজারে ছাড়ে বলে মিডিয়ায় খবর প্রকাশ হয়েছে।
তিন. আন্তর্জাতিক বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধি দেশে চালের দামকে উসকে দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত বছরের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়ে ১৫ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। উচ্চ চাহিদা ও সীমিত সরবরাহ এ মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। ভারত সাদা ও ভাঙা চাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে। বিক্রি কম হওয়া সত্ত্বেও ভিয়েতনামি চালের দাম ২০০৮ সালের পর এ-যাবৎকালের সর্বোচ্চে উঠেছে। এদিকে এল নিনোর প্রভাব, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও বন্যার মতো সমস্যার কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় খাদ্যশস্যের ফলন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একদিকে যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে তখন চাল আমদানিকারক দেশগুলো থেকে চালের চাহিদা বাড়ছে। দেশে গত ছয় মাসে চাল আমদানি না হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়ার খবরকে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ানোর কাজে লাগিয়েছেন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
চার. চলতি অর্থবছরে দেশে কোনো চাল আমদানি না হওয়ায় এখন কেবল আমন চালের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সাধারণভাবে আমন ধান কাটা-মাড়াই শুরুর সময় থেকে বোরো ধান কাটা-মাড়াই শুরুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ডিসেম্বর-এপ্রিল সময়ে আমন চালের ব্যবহার হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক চাল ভোগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭৭ দশমিক ২ গ্রামে, যা ২০১০ সালে ছিল ৪১৬ গ্রাম। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর-এপ্রিল সময়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন কমবেশি ১ কোটি ৫০ লাখ টন চাল। ধরা যাক বিবিএসের হিসাবে এবার আমন চাল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াল দেড় কোটি টনে। আমনের এ উৎপাদনকে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট মনে করা সংগত নয়। বাফার স্টক প্রয়োজন। আমদানির অবর্তমানে চালের বাফার স্টক তৈরি হচ্ছে না, যা বাজারে ভুল সংকেত দিতে পারে।
চাল আমাদের প্রধান খাদ্য। বিবিএসের হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। আবার মাসিক মোট খরচের ৩৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কেনায়। চালের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব নিম্নবিত্তের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়লেও নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চালের মূল্যস্ফীতিতে তাদের মাছ, মাংস, ডিমসহ আমিষজাতীয় খাবার কেনা কমিয়ে দিত হচ্ছে। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের পুষ্টির অভাব ঘটছে। এ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে প্রয়োজন চালের দামে ঊর্ধ্বমুখিতা রোধ করে তা নিম্নমুখী করা। এজন্য সর্বাগ্রে যে পদক্ষেপ দরকার তা হলো বাজারে চালের সরবরাহ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়ানো। চলতি আমন থেকে যে চাল পাওয়া যাবে, তা আগামী বোরো ফসল ওঠা পর্যন্ত দেশের চাহিদা মেটাতে পারবে না বলে ধরে নেয়া যায়। বোরো ফসল ওঠা পর্যন্ত কী পরিমাণ চাল আমদানি প্রয়োজন হতে পারে একটি জরুরি সার্ভের মাধ্যমে তা নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী চাল আমদানি করা যেতে পারে। দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গমে আমরা প্রায় পুরোপুরি আমদানিনির্ভরশীল। তাই প্রয়োজনীয় গম আমদানির ব্যবস্থাও সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় চালের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, চালের বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরো জোরদার করতে হবে, যাতে চালকল মালিকরা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন। তৃতীয়ত, বাজারে চালের সরবরাহ বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের চাল কেনার নিশ্চয়তা দেবে না। চাল সংগ্রহের জন্য তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব