শ্রমশক্তি নিয়ে সম্প্রতি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রতিবেদনে আগের জরিপের চেয়ে বেকারত্ব কমেছে বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতার চিত্র জরিপে ফুটে ওঠেনি এমন মত দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা দেশের বর্তমান শ্রমবাজারের পরিপ্রেক্ষিতে বেকারত্ব কমেছে—এমন তথ্য গ্রহণযোগ্যতা রাখে না।
বিবিএসের জরিপে বলা হয়েছে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার। পাঁচ বছর আগে ২০১৬-১৭ সালে সংখ্যাটি ছিল ২৭ লাখ। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটে যেখানে বেকারত্বের হার বেড়েছে, বিশেষ করে কভিড-১৯ চলাকালীন অনেককেই কর্মস্থল থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। বর্তমানেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসংস্থানে স্থবিরতা বিরাজ করছে, সেখানে বিবিএসের জরিপ যে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন, সেটি বলাই বাহুল্য।
অবশ্য এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বেকারত্বের সংজ্ঞার কথা বলা হচ্ছে। আইএলওর ১৮৭টি সদস্য রাষ্ট্র যারাই শ্রম জরিপ করে, এ সংজ্ঞাগুলো অনুসরণ করে। এর বাইরে বিভিন্ন দেশের জন্য অভিন্ন মানসম্মত সংজ্ঞা এখনো নির্ধারণ হয়নি বলে আইএলওর দাবি। বস্তুত আইএলওর জরিপে সপ্তাহে অন্তত ১ ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগকে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হিসেবে ধরা হয়েছে। এমনকি পরিবারের জন্য হাঁস-মুরগি পালন করলেও বেকার বলা যাবে না এমন মানদণ্ড রয়েছে। আবার উৎপাদনশীল কাজে মজুরি না পেলেও বেকার না বলার কথা বলা হয়েছে। এ রকম সংজ্ঞা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা সেটি মোটা দাগে চিহ্নিত করা যায়। আবার আইএলওর অন্য সংজ্ঞাও কিন্তু আছে। যেমন শ্রমের কার্যকর মূল্যকে গণ্য করা হয়, অর্থাৎ সপ্তাহের ৪০ ঘণ্টার আয় দিয়ে ব্যয় মেটানো সম্ভব কিনা তার ভিত্তিতে। কিন্তু এ সংজ্ঞাকে বিবিএসের জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাই সাম্প্রতিক জরিপটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
কেননা প্রতিবেশী দেশ ভারতে বেকারত্বের হার আবার বেড়েছে। দেশটির সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) তথ্যমতে, মার্চে দেশটিতে বেকারত্ব আবার ৭ দশমিক ৮ শতাংশে উঠেছে, যা তিন মাসের মধ্যে সব থেকে বেশি। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশের তুলনায় বৃহৎ অর্থনীতির দেশটিতে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেলে আমাদের দেশে কমেছে, সেটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য। এমনকি করোনা মহামারীতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২০ সালের এপ্রিলেই ২ কোটি ৫ লাখ লোক চাকরি হারান। ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর যুক্তরাষ্ট্রে এটিই সবচেয়ে বেশি বেকারত্বের হার।
সাধারণ অর্থে উপার্জনে সক্ষমতার ঘাটতিকেই বেকারত্ব বোঝায়। কিন্তু দেশের বেকারত্বের সামগ্রিক তথ্য পেতে সরকারি পরিসংখ্যান ইতিবাচক দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্যটি ফুটে ওঠে না। ধরে নেয়া হয় যে সরকার বেকারত্বের সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে আগ্রহী নয়।
আবার বিবিএসের জরিপে আইএলওর সংজ্ঞাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হলেও আইএলও বেকারত্বের আলাদা পরিসংখ্যান প্রকাশ করে থাকে। আইএলওর আরেকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ছয় কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। আইএলওর হিসাবটিকেই পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলে মনে করেন। তাহলে বিবিএসের জরিপে আইএলওর অন্যান্য সংজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে যে সংজ্ঞার আলোকে বেকারত্ব কম দেখানো যাবে এমন সংজ্ঞাকে বেছে নেয়ার কারণ কী? একটা বিষয় তো সহজে বোধগম্য যে বিভিন্ন জরিপের আলোকেই উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানো হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বেকারত্ব জরিপে যদি বেকার সংখ্যা কম দেখানো হয়, সেটি তো পরবর্তী পদক্ষেপগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ সঠিক তথ্যের আলোকে সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা যাবে না। যেমন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকারি দপ্তরগুলোয় যে শূন্য পদগুলো রয়েছে, সেগুলো পূরণে প্রত্যাশিত গতি দুষ্কর হয়ে উঠবে। এছাড়া সামগ্রিক উন্নয়নসহ দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত প্রণয়নও সম্ভব হবে না। কারণ বেকারত্ব বৃদ্ধি পেলে অপরাধ সংঘটনের হার বেড়ে যায়, তখন আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর প্রয়োজনীয় তৎপরতাও বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়।
আইএলও, বিশ্বব্যাংক, কমনওয়েলথের হিসাব মতে, এক দশকে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এদের মধ্যে মাত্র সাত লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এর মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার রয়েছে। দেশের একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার প্রায় পৌনে এক কোটি। প্রতি বছর এর সঙ্গে বেকারদের নতুন তালিকা যুক্ত হচ্ছে। পরিসংখ্যানগত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান শতকরা ৯৫ ভাগ কর্মসংস্থান করে। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান করছে পোশাক শিল্প। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ লোক কাজ করছে।
বেকারত্ব নিয়ে বিবিএসের যে জরিপ দেখানো হয়েছে, তাতে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংযোগ ঘটানো হয়নি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, দেশে এখনো চার কোটির বেশি মানুষ দরিদ্রসীমার মধ্যে রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, যে ব্যক্তির দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ ডলার বা প্রায় ৯৭ টাকা সে দরিদ্র। এ হিসাবে দেশের চার কোটিরও বেশি মানুষ দৈনিক এ আয় করতে পারছে না। তারা দরিদ্র রয়ে গেছে। এর সঙ্গে বেকার বা যার কোনো আয় নেই তা যুক্ত হয়ে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে পারেনি।
বেকারত্ব এক দুর্বিষহ যন্ত্রণার নাম, অর্থ উপার্জনের জন্য কর্মসংস্থানের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে উদ্দেশ্যবিহীন উচ্চশিক্ষা ও কাঙ্ক্ষিত দক্ষতার ঘাটতিতে বেকারত্ব তৈরি হয়। উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বলা হলেও উদ্যোক্তাদের পদে পদে সইতে হয় বিড়ম্বনা। এরই মাঝে শেষ হয়ে যায় সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স, যোগদানের বয়স বাড়াতে রাজপথে স্লোগান ওঠে। আবার সরকারি চাকরিই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, এ প্রত্যাশা জীবনে গ্লানি নিয়ে আসে। যার ফলে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেভাবে যুবসমাজকে গড়ে তোলার কথা, সেটি না হয়ে কর্মঠ যুবকরা এক নির্দিষ্ট বৃত্তে ঘুরপাক খায়।
এমন পরিস্থিতিতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ আরো যাচাই করে নেয়া উচিত ছিল। কারণ আইএলওর যে সংজ্ঞার আলোকে জরিপ করা হয়েছে, তা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। বিবিএস সপ্তাহে ১ ঘণ্টার কাজকে কর্মসংস্থানের আওতায় নিয়ে এলেও এটি মূলত ছদ্ম বেকারত্ব। আমাদের দেশে এমন ছদ্ম বেকারত্ব অনেক আছে, যেমন সপ্তাহে অল্প কিছু সময়/দিন কাজ পায় বাকি সময় পায় না। কিন্তু এ কর্মঘণ্টার আয়ে ব্যক্তি দারিদ্র্যসীমাকে অতিক্রম করতে পারে কিনা তা বিবেচনা করা দরকার। আর উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত থেকে পারিশ্রমিক না পেলেও সেটিকে আইএলওর সংজ্ঞায় কর্মসংস্থান গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু এটিও দারিদ্র্যকে অতিক্রম করতে পারার সঙ্গে জড়িত।
আইএলওর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে উদ্ভূত বিতর্ক প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ আইএলওর সদস্য হিসেবে এ সংজ্ঞায় সম্মতি দিয়েছে। এবং এ সংজ্ঞা বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য, যে কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ এটি অনুসরণ করে। এর কারণ হলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা, আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের সংজ্ঞা অন্য দেশের সংজ্ঞার সঙ্গে যেন আলাদা না হয়ে যায়। এখন আয়ের ক্ষেত্রে সেটি আসলে দারিদ্র্য, ক্রয়ক্ষমতা এবং অসমতাকে বোঝায়। শ্রমবাজারের জরিপে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করার সময় একজন শ্রমিক হয়তো সপ্তাহে ১/২/৩ ঘণ্টা কাজ করতে পারেন। কিন্তু দেখা যাবে যে জরিপ শেষ হওয়ার পরই সে পরের তিন সপ্তাহে ১০ ঘণ্টা কাজ করছেন। এখানে সময়ের ব্যাপারও রয়েছে। যেমন গ্রামীণ এলাকায় কৃষিকাজের ক্ষেত্রে ফসল কাটা ও ঘরে তোলার সময় যদি জরিপ চালানো হয়, তাহলে সবাই বলবে তারা কাজ বেশি করেছে। অন্য সিজনে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে তো বলতে পারবে না বেশি কাজ করেছে। এক্ষেত্রে অনেক ইস্যু থাকে, যে কারণে এটি আসলে বলা যায় আংশিক দৈব চয়নের ভিত্তিতে করা হয়। তাই কিছু ক্ষেত্রে এটি যেমন পরিপূর্ণ তথ্য দেয়, আর কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য দেয় না।
এখন বেকারত্ব কি আসলেই কমেছে? এটা আইএলওর বেকারত্বের সংজ্ঞার চেয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গ, এক্ষেত্রে বিবিএসের তথ্য কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে সেখানে তো আইএলওর ভূমিকা নেই। এবং এ তথ্য কতটা নির্ভুল ছিল সেটিও তো প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। আবার বিবিএস চাইলেই কি প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতে পারবে, এক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক ইস্যুও জড়িত নয়? আইএলও এ বিষয়ে নিশ্চিত নয় এবং এটি বলার দায়িত্ব আইএলওর নয় বলে সংস্থাটি দাবি করেছে।
কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে অমিল থাকার যে প্রশ্নটি উঠেছে তাতে আইএলওর সংজ্ঞার আলোকে বিবিএসের জরিপ এবং বেকারত্ব নিয়ে তথ্য নতুন করে বিতর্কেরই জন্ম দিয়েছে এবং এ জরিপ পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে বলা যায়। নইলে অদূর ভবিষ্যতে প্রকৃত তথ্য আড়াল করে জরিপ প্রকাশ স্বাভাবিক গণ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক