‘মা’ শব্দটি আমাদের এ সৌন্দর্যে ভরা ধরিত্রীর বুকে সব থেকে মধুরং প্রিয়। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ, স্নেহ, মায়া, মমতার চাদরে মোড়ানো একটি স্থান। আর মা সন্তানের বড় শিক্ষক। সন্তান ছোটবেলায় লেখাপড়ার হাতেখড়ি পায় মায়ের থেকে, শুধু লেখাপড়া নয়, আদবকায়দা, সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ সবকিছুর ওপর রয়েছে মায়ের অনেক বড় এক প্রভাব। প্রকৃতির সঙ্গে মায়ের রয়েছে নিবিড় এক সম্পর্ক, কারণ প্রকৃতি মায়ের মতো। আর বর্তমানে পরিবেশ সচেতন জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন একজন পরিবেশ সচেতন মা।
পৃথিবীতে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে উঠেছে বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। পুরো পৃথিবীতে ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রাকৃতিক আবাসস্থল। আর এ কারণেই হুমকির মুখে পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা। ফলে পুরো পৃথিবীতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে। কিন্তু বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কখনো দায়বদ্ধতা দিয়ে সম্ভব হবে না। প্রয়োজন বন্যপ্রাণীর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি।
একটি শিশু ছোট থেকে যা শেখে তা সারা জীবন প্রতিফলিত হয় তার কর্মের মাধ্যমে। আর তার মা হয় তার জীবনের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক। আর এ মা শেখাতে পারেন প্রকৃতিকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, আত্মার বন্ধন দ্বারা প্রকৃতির সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হতে হয় কিংবা কীভাবে ছড়িয়ে দিতে হয় এ ভালোবাসা পৃথিবীতে।
ছোটবেলায় একটি শিশুকে শেখানো হয় কীভাবে সে বেড়ে উঠবে, বড়দের সে কীভাবে সম্মান করবে, সামাজিক রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, ধর্মীয় অনুশাসন যা সারা জীবন তার কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়। এ বিষয়টি বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হয় তার সন্তান-সন্ততির মধ্যে।
জীববৈচিত্র্য তথা বন্যপ্রাণী যে সংরক্ষণ করতে হবে তা আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তেমন একটা নেই। এখনকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ যে মানুষের জন্যই প্রয়োজন তা একেবারে অনুপস্থিত আর সত্যি বলতে মানুষ এটা জানে না।
সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষা ব্যবস্থায় যে চ্যাপ্টারগুলো পড়ানো হয় তা শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারে না কিংবা শুধু পরীক্ষায় পাস করার জন্যই ওই অংশগুলো পড়া হয়। ফলে সব স্তরে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়টি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য ভয়াবহভাবে বিপন্নতার সম্মুখীন। শুধু সচেতনতা সৃষ্টি, প্রকল্প বা সরকারি উদ্যোগে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অসম্ভব। কারণ মানুষ যতক্ষণ দায়বদ্ধতা থেকে সংরক্ষণে যুক্ত থাকবে ততক্ষণ শুধু দাপ্তরিক ভাষায় সংরক্ষণ বিষয়টি কাগজে-কলমে থাকবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সরে আসবে সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য থেকে। প্রয়োজন হবে নতুন পদক্ষেপ, প্রকল্প আর উদ্যোগের। মানে সেটা দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি কম থাকবে।
মানুষকে এটা উপলব্ধি করাতে হবে যে বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থভাবে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন এ সংরক্ষণের। এ সংরক্ষণ বিষয়টি প্রয়োজন সহজাত ভালোবাসা, মায়া-মমতার চাদরে মোড়ানোভাবে। এ কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে পারবেন একজন মা। হ্যাঁ, আমাদের দেশে চাই প্রকৃতি সংরক্ষণবিদ মা।
এ সংরক্ষণবিদ মা তৈরি হবেন কোনো ডিগ্রি বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে নয়। আমাদের দেশের মেয়েদের বা মায়েদের বিষয়টি উপলব্ধি করানোর মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে, বাংলার প্রতিটি মেয়ের মধ্যে যে মাতৃত্ব আছে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি তাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করালে সে ভালোবেসে এ কাজে লিপ্ত হবে।
পাশাপাশি এ কাজ সম্পাদনের জন্য আলাদা করে সরকারি প্রকল্প বা অর্থ খরচের প্রয়োজনীয়তা আমি মনে করি না, প্রয়োজন আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়। কীভাবে? এখানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক সমন্বিত উদ্যোগ।
মায়ের গর্ভে যখন সন্তান আসবে তখন অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি একজন মাকে পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কে জানাতে হবে, সন্তানের ভবিষ্যৎ দূষণমুক্ত একটি পৃথিবী দেয়ার জন্য একজন মাকে সচেতন করতে হবে। এতে যুক্ত করতে হবে স্বাস্থ্যকর্মী, কমিউনিটি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ আর স্থানীয় নারী স্বাস্থ্যবিষয়ক এনজিওকে। এ সংস্থাগুলোর কর্মীরা তাদের সাধারণ কার্যাবলির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় গর্ভবতী নারীদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝাবে।
একজন মা যখন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সচেতন হবে তখন সে তার সন্তানকেও সেই বার্তাটি পৌঁছে দেবে। এভাবেই মায়ের ভালোবাসায় সুস্থ থাকবে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
আশিকুর রহমান সমী: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, গবেষক, লেখক ও বন্যপ্রাণী বিষয়ে একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত