সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হয়ে খাওয়ার কিছু খুঁজছিলাম। বেশি খোঁজার ফুরসত ছিল না। বাসার নিচের দোকানগুলো থেকেই কিছু একটা কিনে খাব, এমনই চিন্তা। প্লাস্টিকের মোড়কে আবৃত একটা ক্রিম বান নিলাম। মোড়কটা ছিঁড়তেই দেখলাম, ভেতরটা একদম ঘেমে আছে। বানটা ভেজা ভেজা। বিশ্রী একটা অনুভূতি হলো। কোনো রকমে মুখে গুঁজে দিলাম। তখনই আরেকবার অনুভব করলাম, খাদ্যদ্রব্যে প্লাস্টিক মোড়কের ব্যবহার প্রতিরোধে যথেষ্ট সচেতনতা এখনো আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। যেদিকেই চোখ যায়, দোকানগুলোয় সারি সারি ঝুলে আছে নিম্নমানের প্লাস্টিকের মোড়কে আবৃত খাদ্যদ্রব্য। প্রচণ্ড গরমে সেসব প্লাস্টিক গলে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান খাদ্যদ্রব্যে মিশে যাচ্ছে। সেগুলো খাওয়ার মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর উপাদান মানবদেহে প্রবেশ করছে। ফলে শরীরে নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে। অসুস্থতায় ভুগছে অসংখ্য মানুষ।
রেস্তোরাঁগুলোতেও একই অবস্থা। পার্সেল নেয়ার ক্ষেত্রে তারা প্রচণ্ড গরম খাবার প্লাস্টিকের বাক্সে দিচ্ছে। ফলে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান খাদ্যদ্রব্যে তো মিশছেই, সেই সঙ্গে খাদ্যের গুণগত মান ও স্বাদও নষ্ট হচ্ছে।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জারীকৃত বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রজ্ঞাপন অনুসারে, খাদ্য স্পর্শক উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল স্বাস্থ্যসম্মত ও কারিগরি মানসম্পন্ন হতে হবে। প্রজ্ঞাপনে দেয়া ব্যাখ্যা অনুযায়ী, খাদ্য স্পর্শক বলতে বোঝায়, (১) যা খাদ্যের সংস্পর্শে আসে বা (২) খাদ্যের সংস্পর্শে এসেছে বা (৩) খাদ্যের সংস্পর্শে আসার উপযুক্ত কারণ বা সম্ভাবনা আছে বা (৪) কোনো বস্তুর সাধারণ বা দূরবর্তী ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্যের গুণগত মান পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে। এ ব্যাখ্যা অনুসারে, খাদ্যদ্রব্যের মোড়ক হলো খাদ্য স্পর্শক। কিন্তু আমাদের দেশে খাদ্যদ্রব্যের মোড়কগুলো খুবই নিম্নমানের পরিবেশে ততোধিক নিম্নমানের উপাদানে তৈরি হচ্ছে। তা রোধে আইন প্রণয়নের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকি প্রয়োজন। আবার আপনি গলা ভেজাতে পানি খাবেন? সেখানেও একই চিত্র। দোকানে দোকানে সারি সারি প্লাস্টিকের বোতল। আপনি জানতেও পারছেন না, তেষ্টা মেটাতে গিয়ে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে ফেলছেন। অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য কিংবা পানীয়, উভয় ক্ষেত্রেই আপনি আসলে টাকা দিয়ে বিষ কিনছেন।
প্লাস্টিক মোড়ক টেকসই ও সহজলভ্য। তাই খাদ্যদ্রব্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ ধরনের মোড়ক ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। সেক্ষেত্রে এর বিকল্প টেকসই সমাধান কী হতে পারে, তা নিয়ে উচ্চতর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে গবেষণা খাতে সরকারকে আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে। যতদিন পর্যন্ত প্লাস্টিক মোড়কের একটি সহজলভ্য ও টেকসই বিকল্প আবিষ্কার না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত প্লাস্টিক মোড়কের ব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে না। আর ততদিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে এসব খাবার খাবে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবে। ফলে দেশের মানবসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এবার খাদ্যদ্রব্যে প্লাস্টিক মোড়কের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিকের কনটেইনার ও বোতল তৈরিতে পলিকার্বোনেট ব্যবহার করা হয়। এ থেকে বিসফেনল এ বা বিপিএ নামক রাসায়নিক উপাদান নির্গত হয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপিএ শরীরে নানা ধরনের জটিল রোগের উদ্ভব ঘটায়। প্লাস্টিকের বোতল ও মোড়ক তৈরিতে পলিভিনাইল ক্লোরাইড বা পিভিসি ব্যবহার করা হয়। পিভিসি সাধারণত বেশ শক্ত ও অনমনীয়। তাই এটিকে ব্যবহারযোগ্য করতে এর সঙ্গে প্লাস্টিসাইজারস নামে অতিরিক্ত কিছু রাসায়নিক উপাদান যুক্ত করা হয়। একটি প্লাস্টিক মোড়কে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত প্লাস্টিসাইজারস থাকতে পারে। প্রায়ই খাদ্যদ্রব্যের মোড়কের উপাদান পিভিসিতে প্লাস্টিসাইজারস হিসেবে ফ্যাথালেটস ও ইপোক্সিডাইজড সয়াবিন অয়েল (ইএসবিও) ব্যবহার করা হয়। বিপিএ ও ফ্যাথালেটস শরীরের অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে শরীরে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন হরমোনের স্বাভাবিক নিঃসরণ হয় না। যার কারণে নানা শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে শিশু ও কিশোরদের ঝুঁকি বেশি থাকে। কারণ তাদের শারীরিক বৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য হরমোনের যথাযথ নিঃসরণ অপরিহার্য। এটি নিশ্চিত না হলে পরবর্তী সময়ে সারা জীবন তাদের ভুগতে হবে। তাছাড়া ফ্যাথালেটস ও বিপিএর কারণে বন্ধ্যাত্ব, স্থূলতা, ব্রেস্ট ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। প্লাস্টিক মোড়কে ব্যবহৃত এসব রাসায়নিক উপাদান কেবল শরীরের জন্যই ক্ষতিকর তা নয়, আমাদের মনোজগতেও এগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিপিএর কারণে মানসিক অবসাদ ও মনোবৈকল্য দেখা দেয়। তাছাড়া পলিস্টাইরিন থেকে নির্গত স্টাইরিন, পলিইথিলিন থেকে নির্গত বিভিন্ন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, পিইটি থেকে নির্গত অ্যাকেটালডিহাইট ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে শরীরে প্রবেশ করে। ফলে ফুড পয়জনিং হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
প্লাস্টিক মোড়কের এসব ক্ষতিকর প্রভাব রোধে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে বেশ ঘাটতি দেখা যায়। সাধারণ মানুষ তাদের খাবার নিয়ে তেমন একটা সচেতন নয়। কোনো রকমে উদরপূর্তি করাই যেন তাদের লক্ষ্য। খাদ্য নির্বাচনে দেশের আপামর জনসাধারণকে যথাযথভাবে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিরাপদ খাদ্য মানেই নিরাপদ জীবন। তাই এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
প্লাস্টিক মোড়কের পাশাপাশি আরেকটি ক্ষতিকর বিষয় হলো খবরের কাগজ। আমাদের দেশে রেস্তোরাঁ ও রাস্তার পাশের খাবারের দোকানগুলোয় খবরের কাগজে মুড়ে খাবার দেয়া হয়। আপনি একটা পরোটা কিনতে গেলেন, দেখা যাবে খবরের কাগজে পেঁচিয়ে তা আপনাকে দেয়া হচ্ছে। ছোলামুড়ি কিংবা ঝালমুড়ির দোকানগুলোয় অহরহ খবরের কাগজের ব্যবহার হচ্ছে। এতে করে খবরের কাগজে ব্যবহৃত কালি খাদ্যদ্রব্যে মিশে যাচ্ছে। এ কালি তৈরিতে এমন সব রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা মোটেও মানবশরীরের জন্য উপযোগী নয়। তাই খবরের কাগজে মোড়া খাদ্যদ্রব্য খেয়ে রোগগ্রস্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে খাদ্যদ্রব্য পরিবেশনে খবরের কাগজ ব্যবহারের হার সবচেয়ে বেশি। সেখানকার অধিবাসীদের সচেতনতাও কম।
খবরের কাগজ তৈরিতে ৪৩ ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ক্লোরিন, ডলোমাইট, হাইপোক্লোরাস অ্যাসিড (ক্যালসিয়াম অক্সাইড), সোডিয়াম সালফেট সল্টস, সোডিয়াম থায়োসালফেটের নাম উল্লেখযোগ্য। এসব রাসায়নিক উপাদানের কোনোটিই মানবদেহের জন্য নিরাপদ নয়। খবরের কাগজের কালিতে ডাই-ইসোবুটাইল ফ্যাথালেট, ইথানল, ডাইমিথাইল সালফোক্সাইড বা ডিএমএসও, ডাই-এন-বুটাইল ফ্যাথালেট, প্রোপানলসহ নানা রাসায়নিক উপাদান থাকে। এর কোনোটিই ভোগ্য নয়। কিন্তু খবরের কাগজে মোড়া খাবার খাওয়ার মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। ফলে ব্লাডার ক্যান্সারসহ নানা ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
খাদ্যদ্রব্যের এসব বিষক্রিয়া রোধে যথাযথ মোড়ক উদ্ভাবনে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। নতুবা রোগে আক্রান্ত হবে শরীর। বেঁচে থাকতে হবে ধুঁকে ধুঁকে, যা কখনই কাম্য নয়।
নিজাম আশ শামস: লেখক ও সাংবাদিক