মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত যেন দেশে ফায়দা লোটার অছিলা হয়ে না ওঠে

অছিলা অর্থাৎ কৃত্রিম উপলক্ষ সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার ঘটনা এ দেশের ইতিহাসে এত বেশি আছে যে এটিকে এখন বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বললেও এতটুকু অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না। খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও নিছক মুনাফা হাসিলের উদ্দেশ্যে যুদ্ধকে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) অছিলা বানিয়ে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টির প্রাকারান্তরিক ফলাফলই ছিল ‘উনপঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ। করোনা বা ইউক্রেন যুদ্ধকে অছিলা হিসেবে ব্যবহার করে নানা খাতের ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, আমলা, রাজনীতিক প্রভৃতি শ্রেণী কর্তৃক রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কত হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ ও সমুদয় তদন্ত যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে করে যেতে বলা হয়, তাহলে শুধু এ কাজের জন্যই তাদের এক বছর অতিরিক্ত সময় দিতে হবে (এটি করতে বলা হচ্ছে না)। মোট কথা কোনো একটি আকস্মিক ঘটনাকে অছিলা বানিয়ে তা থেকে একচেটিয়া মুনাফা ও ফায়দা লোটার এমন সিদ্ধহস্ততার উদাহরণ পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

এমনি পরিস্থিতিতে সর্বসাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান-লেবানন-ফিলিস্তিনকেন্দ্রিক মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতকে অছিলা হিসেবে ব্যবহার করে উপরোক্ত স্বার্থান্বেষী মহল যে আরো একবার কু-উদ্যোগী হয়ে উঠতে পারে, তেমনটি আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আর সে ক্ষেত্রে সে ধরনের কু-উদ্যোগ থেকে দেশকে তথা দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে সরকারকে কিছু কিছু বিষয়ে এখন থেকেই যথেষ্ট সতর্ক হতে হবে। না হলে ওই সব স্বার্থান্বেষী মহল তাদের ধূর্ত বুদ্ধি খাটিয়ে সহসাই হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে যে একপর্যায়ে হয়তো অনেকটা নিরুপায় হয়েই তাদের নতুনতর প্রস্তাব ও দাবি-দাওয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আর বর্তমান সরকার একটি অন্তর্বর্তী অবস্থার মধ্যে আছে বিধায় এসব সুযোগ-সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে তারা হয়তো একটি বেশি মাত্রায়ই কৌশলী হয়ে চড়াও হওয়ার চেষ্টা করবে। এ অবস্থায় সরকারকে এক্ষেত্রে কী ধরনের কু-উদ্যোগ মোকাবেলা করতে হতে পারে, তা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণমূলক কিছু আলোচনা এখানে তুলে ধরা হলো।

এক্ষেত্রে প্রথমেই বলে নেয়া দরকার যে ইসরায়েলকেন্দ্রিক উল্লিখিত সংঘাত বর্তমানে মূলত ফিলিস্তিন, লেবানন ও ইরানের পরিধিতে বিরাজমান থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ কর্তৃক কী কী বিষয় ও ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে, সেটি অনেকটা সে আলোকেই বিবেচনা করতে হবে। এবার মূল আলোচনায় আসা যাক এবং এক্ষেত্রে প্রায় চোখ বন্ধ করে প্রারম্ভেই বলে দেয়া যায় যে ১ অক্টোবর রাতে ইরান কর্তৃক ইসরায়েলে মিসাইল হামলা হওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই এ দেশের সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা নিশ্চিতভাবেই ভাবতে শুরু করেছেন কীভাবে পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে দেয়া যায়। আর তা বাড়াতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কবিহীন শাকসবজি ও মাছ-মাংস থেকে শুরু করে প্রায় কোনো কিছুই বাদ যাবে বলে মনে হয় না। এমতাবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য যেসব মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান বাজারমূল্য সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধান, পরিধারণ ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তাদের উচিত হবে অবিলম্বে এসব কর্মকাণ্ড জোরদার করা। কারণ এ দেশে যে অছিলাতেই হোক, একবার কোনো পণ্য বা সেবার মূল্য বেড়ে গেলে তা আর প্রায় কখনই কমে না।

ধারণা করা যায়, ধূর্ত ব্যবসায়ী কর্তৃক পণ্যমূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণের পর পরই শুরু হবে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের আপৎকালীন আর্থিক প্রণোদনার দাবি। তারা সমস্বরে বলবেন, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির কারণে তাদের কার্যাদেশ প্রাপ্তি ও রফতানি কমে গেছে এবং সে কারণে তাদের এখন প্রায় না খেয়ে থাকার অবস্থা। তা সত্ত্বেও, তাদের ভাষায়, নিজেদের না খেয়ে থাকা নিয়ে তারা ভাবেন না। কারণ দেশের উন্নয়নের জন্য তারা না খেয়ে থাকতেও রাজি আছেন (টিপু মুনশিসহ তারা প্রায় সবাই ১৫ বছর ধরে বলতে গেলে না খেয়েই ছিলেন!)। কিন্তু সর্বাগ্রে তারা দেশের মানুষ ও অর্থনীতিকে বাঁচাতে চান! অতএব এ মুহূর্তে এ খাতে প্রণোদনাদানের কোনো বিকল্প নেই। তা এ রকম একটি নাটক যখন তারা মঞ্চস্থ করবেন, তখন শ্রোতা হিসেবে সরকারকে অবশ্যই আবেগাপ্লুত না হয়ে অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ গত দেড় দশক ধরে পোশাক খাতের প্রায় ‘না খেয়ে থাকা’ এ উদ্যোক্তাদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করার চেয়েও অধিক অগ্রাধিকারসম্পন্ন জরুরি কাজ সরকারের সামনে আরো অনেক রয়েছে। আর এটাও প্রায় নিশ্চিত যে পোশাক খাতের মতো অন্যান্য অনেক খাতের উদ্যোক্তারাও অনুরূপ দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারের সামনে উপস্থিত হবে এবং সেসব দাবি-দাওয়া মোকাবেলার ক্ষেত্রেও সেই একই সুপারিশ প্রযোজ্য বলে মনে করি।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘদিনের একটি চলমান সমস্যা হচ্ছে ব্যাপক রাজস্ব ঘাটতি। ফলে বিপুল রাজস্ব ঘাটতির এ মুহূর্তে যেভাবেই হোক সরকারকে সব ধরনের কর ও শুল্ক ছাড় বা অব্যাহতি দান থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, সর্বসাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন খাতের বহু উদ্যোক্তাই বাজারমূল্য স্থিতিশীল কিংবা কারখানা টিকিয়ে রাখার কথা বলে এ ধরনের কর-শুল্ক অব্যাহতির প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সামনে হাজির হবেন। কিন্তু এসব ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক প্রস্তাবে সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া দেয়াটা কোনোভাবেই উচিত হবে না বলেই মনে করি। কেননা এ ধরনের ছাড়ের ফলে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিই যে শুধু চাপের মুখে পড়বে তাই নয়। অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে এ ধরনের ছাড়ের মাধ্যমে কথিত উদ্দেশ্যের এক ফোঁটা অর্জিতও হয় না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পণ্যমূল্য হ্রাসের আকাঙ্ক্ষা থেকে যে কতিপয় পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক হ্রাস করেছে, তার কোনো সুফল কি আদৌ পাওয়া গেছে? যদি না পাওয়া গিয়ে থাকে তাহলে এ জাতীয় কর-শুল্ক হ্রাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটানোই সমীচীন হবে বলে মনে করি।

এর পরই হয়তো ভাড়া বৃদ্ধির দাবি নিয়ে হাজির হবে একসময়ের শাহজাহান খান-মশিউর রহমান রাঙ্গা গং খ্যাত সড়ক ও নৌ-পরিবহন খাতের উদ্যোক্তারা। এ ব্যাপারে এ মর্মে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে বাংলাদেশের সড়ক ও নৌ-পরিবহন খাতে যাত্রী ভাড়ার যে হার, তা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে এ খাতে নতুন করে ভাড়া বৃদ্ধির কোনো প্রস্তাব একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির কারণে যদি জ্বালানি তেলের মূল্যও বৃদ্ধি পায়, তাহলেও না। আর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলব, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের ওপর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব হয়তো পড়তেই পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এর মূল্য সহসা না বাড়ানোটাই উচিত হবে বলে মনে করি। কারণ আরো অনেক আগেই এ মূল্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হারের চেয়ে অনেক উচ্চ হারে নির্ধারণ করা আছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায়ও এ হার অনেকখানি বেশি। তার পরও যদি এ মূল্য বাড়াতে হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে সেচপাম্পে ব্যবহৃত ডিজেলের জন্য হ্রাসকৃত একটি মূল্য ব্যবস্থা যেন অবশ্যই বহাল থাকে।

সব মিলিয়ে বলব, ইসরায়েলকেন্দ্রিক সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির কিছু না কিছু নেতিবাচক প্রভাব হয়তো বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর অবশ্যই পড়বে। আর তা মোকাবেলায় সরকারকে অবশ্যই যথেষ্ট সতর্ক ও সাবধানী অর্থনৈতিক কৌশল অবলম্বন করতে হবে। তবে একই সঙ্গে সতর্ক থাকতে হবে উপরোক্ত ধূর্ত শ্রেণীগুলোর ব্যাপারে, যাতে অতীতের মতো তারা আবারো এটিকে অছিলা হিসেবে ব্যবহার করে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও অনৈতিক মুনাফা আদায় করে নিতে না পারে। আর সেই সঙ্গে ওই সব চতুর উদ্যোক্তাদের এ মর্মে পরামর্শ দিতে হবে যে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নিজেদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও বাজারকৌশল উন্নয়ন এবং দক্ষ ও সৃজনশীল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা করতে হবে—বর্ধিত রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ভোগের মাধ্যমে নয়। নিজেদের তারা মুখে মুখে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হওয়ার অংশীদার বলে দাবি করবেন, আর মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির মতো অছিলা খুঁজে খুঁজে বাড়তি প্রণোদনা ও হ্রাসকৃত কর-শুল্কের যুক্তি দাঁড় করাবেন—এটা কোনো কাজের কথা হতে পারে না। তবে রাষ্ট্রকে অবশ্যই যেটি করতে হবে তা হচ্ছে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডসংক্রান্ত পরিবেশ যাতে গতিশীল ও মসৃণ হয় এবং ব্যবসায়ের অদৃশ্য খরচ যাতে না বাড়ে সে বিষয়গুলো নিশ্চিত করা।

মোট কথা উদ্যোক্তাদের আর্থিক প্রণোদনা নয়, দিতে হবে রাষ্ট্রের পক্ষে থেকে নীতিগত সমর্থন, যাতে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির মতো আকস্মিক আন্তর্জাতিক সংকটেও তারা প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারে। আর উদ্যোক্তাদেরও বুঝতে হবে যে আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ, কর ও শুল্ক অব্যাহতি, রাজস্ব ফাঁকিদান এগুলো উদ্যোক্তাবৃত্তির ক্ষেত্রে টেকসই ও মর্যাদাকর কোনো পথ নয়। আসুন এ দেশে আমরা একটি মর্যাদাকর উদ্যোক্তা-সংস্কৃতি গড়ে তুলি, যেখানে মানুষ দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা সম্প্রদায়কে শুধু সম্মানের চোখেই দেখবে না, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় তাদের অংশগ্রহণকে আরো বেশি করে প্রত্যাশা করবে।

আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়

আরও