নিরাপদ সড়ক প্রকল্পে ধীরগতি

সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে মৃত্যুর অন্যতম কারণ

দেশের সড়কের অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। প্রতিনিয়ত বাড়ছে সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৫৯৮ জন মারা গেছে।

দেশের সড়কের অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। প্রতিনিয়ত বাড়ছে সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৫৯৮ জন মারা গেছে। এছাড়া আহত হয়েছে ৯ হাজার ৬০ জন। গত বছর নিহতের সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৬ হাজার ৫২৪ এবং আহত হয়েছে ১১ হাজার ৪০৭ জন। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০২২ সালে, ৭ হাজার ৭১৩ জন।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে এক অভূতপূর্ব আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ফুটপাতে বাসচাপায় সহপাঠীর মৃত্যুর পর কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমেছিল। ধীরে ধীরে তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রণীত হয় সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। যদিও সে বছরও সড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কম ছিল না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে, ২০১৮ সালে সড়কে ৪ হাজার ৭৬ জনের এবং পরের বছর আরো বেশি ৪ হাজার ৩৫৮ জনের মৃত্যু হয়। তবে ২০২০ সালে করোনার কারণে যান চলাচল প্রায় ৬৭ দিন বন্ধ থাকায় প্রাণহানি কিছুটা কমে ৩ হাজার ৫৫৮ জন হয়।

এভাবে বছরের পর বছর দেশে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে সড়ক দুর্ঘটনা। মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকলে সড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে গত বছরের মে মাসে নেয়া হয় ‘‌বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প’। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের ঋণে। প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা (৩৫৮ মিলিয়ন ডলার)। তবে কাজ শুরুর এক বছর পেরিয়ে গেলেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি সওজ। প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন ধীরগতির কারণে সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের ঋণ থেকে ৭৫ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

সংকটে থাকা দেশের অর্থনীতির জন্য বিশ্বব্যাংকের এ উদ্যোগ একটি দুঃসংবাদই বটে। বিশেষ করে যখন সরকার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিচারে নিজস্ব অর্থায়নে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। পাশাপাশি বৈদেশিক অনুদান ও ঋণে বাস্তবায়ন হচ্ছে এমন প্রকল্পগুলো চলমান রাখতে চায়।

আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রকল্প শেষ না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সেগুলো বাস্তবায়নের সক্ষমতা থাকে না। একই সঙ্গে প্রকল্পগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় বাস্তববিমুখ। সম্প্রতি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত এক সভায় প্রকল্প পরিচালকরা (পিডি) উল্লেখ করেছেন যে দেশের সাম্প্রতিক বন্যা ও বিগত সরকার পতনের পর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বেশির ভাগ ঠিকাদারের অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ২৬টি প্রকল্প শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা রয়েছে। তবে এর মধ্যে ২০টিরও বেশি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব নয়। এবারের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময়টা যদি বাদ দেয়া হয়, তাও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে শুরু থেকেই ধীরগতি লক্ষণীয়। বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক প্রকল্পের ক্ষেত্রে।

২০২৩ সালের প্রায় মাঝামাঝি প্রকল্পটি শুরু হলেও এ পর্যন্ত কোনো ভৌত অগ্রগতি হয়নি। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। যদিও প্রকল্পের কর্মকর্তাদের দাবি, দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না হলেও তারা কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকল্পের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে কেনাকাটা। এর জন্য আমাদের দরপত্র প্রক্রিয়াগুলো শুরু হয়েছে। কেনাকাটা সম্পন্ন হলে প্রকল্পের অনেকাংশে অগ্রগতি হবে।

যদিও এদিকে সওজ কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ঋণের পরিমাণ কমে যাওয়ায় প্রকল্পের কাজের পরিধিও কমে যাবে। এরই মধ্যে প্রকল্পটির জন্য ভূমি অধিগ্রহণ পরিকল্পনা বাতিলের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

সওজ অধিদপ্তরের নেতৃত্বে নিরাপদ সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ পুলিশ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সবচেয়ে বেশি কাজ সওজ অধিদপ্তরের। সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পে সওজ অধিদপ্তরের অনুকূলে সব মিলিয়ে বরাদ্দ রয়েছে ৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। সংস্থাটির অন্যতম প্রধান কাজ ৫ হাজার ২০০ কিলোমিটার মহাসড়কের নিরাপত্তার মান যাচাই করে সেগুলোর রেটিং করা। পাশাপাশি নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিভিন্ন সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ করা। অন্যদিকে নিরাপদ সড়ক প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৬৪ কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়ন করার কথা বিআরটিএর। প্রকল্পের মাধ্যমে সংস্থাটি দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার জন্য স্বতন্ত্র একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেবে ৬০ হাজার চালককে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলবে দেশজুড়ে। এর বাইরে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ নামে পৃথক একটি সংস্থা গড়ে তুলবে।

আবার সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পে পুলিশের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৩৪১ কোটি টাকা। সড়কের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চিহ্নিত, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরবরাহ করা হবে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম। সারা দেশে দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিসংখ্যান-সংবলিত একটি জাতীয় তথ্যভাণ্ডারও গড়ে তুলবে বাংলাদেশ পুলিশ। পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশের জন্য গড়ে তোলা হবে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের ২৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জন্য। এ টাকায় সংস্থাটি বিভিন্ন হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য জরুরি রুমের ব্যবস্থা করবে। কেনা হবে ৬০টি লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স ও ৪০টি মোটরসাইকেল অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন মেডিকেল সরঞ্জাম। প্রকল্পের আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি কলসেন্টার পরিচালনা করবে এবং চিকিৎসাকর্মীদের জন্য ব্যবস্থা করবে বিশেষ প্রশিক্ষণের।

এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, প্রকল্পটির আওতায় গৃহীত কাজগুলো নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা দিতে কতটুকু সক্ষম। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৬২ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ যানবাহনের বেপরোয়া গতি। এছাড়া চালকদের অদক্ষতা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহনের চলাচল, ফুটপাত হকারের দখলে থাকা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতা এর পেছনে বিশেষভাবে দায়ী। এছাড়া দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এর আগেও অনেক প্রকল্প নেয়া হলেও ধারাবাহিকতার অভাবে সেগুলো ফলপ্রসূ হয়নি।

আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ সড়কের বিশৃঙ্খলা। রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের যান চলাচল করে। বিশেষ করে বর্তমানে দুই ও তিন চাকার গাড়ির আধিক্যে দুর্ঘটনা আরো বেড়েছে। উপরন্তু নেই সড়ক পরিবহন আইনের যথাযথ প্রয়োগ। সুতরাং কেবল বাস্তবতা ও সক্ষমতা যাচাই না করে এমন ব্যয়বহুল প্রকল্প নেয়ার অর্থ হলো আর্থিক ক্ষত আরো গভীর করা। এভাবে একদিকে যেমন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের গতি শ্লথ হচ্ছে, অন্যদিকে সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক যতটা না কাঠামোগত বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল, তার অধিক নিয়ম-শৃঙ্খলা মানার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সরকারের প্রকল্পে ব্যয় না বাড়িয়ে সেদিকেই মনোযোগী হওয়া দরকার। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সড়ক নিরাপদ হবে সবার জন্য—এটিই প্রত্যাশা।

আরও