একসময় যে বাংলাদেশকে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি সেই বাংলাদেশ এখন কৃষি উৎপাদনে বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ বিশ্বে পাট উৎপাদনে প্রথম, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, চাল ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থান অধিকার করে সারা পৃথিবীর মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এটা বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষির জন্য এক বিরাট গৌরবের বিষয়। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এ অভাবনীয় সাফল্যের ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে কৃষি উন্নয়নের এক অনন্য উদাহরণ।
বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে ৩ কোটি ৭৩ লাখ মেট্রিক টন চাল, ১ কোটি ৭২ লাখ টন সবজি ও প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন ফল উৎপাদন হচ্ছে। আলু উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি ৯ লাখ টন। ভুট্টা উৎপাদন হচ্ছে ৪৭ লাখ টন। মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৩৮ লাখ টন। বাংলাদেশ আজ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই না, দেশটি থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে কৃষিজাতপণ্য রফতানি হচ্ছে বিশ্বের ১৪২টি দেশে। এসব পণ্যের বড় ক্রেতা হলো মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকার নাগরিক ও অভিবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশে গত চার যুগে কৃষিতে অভাবনীয় উন্নয়ন হলেও এখনো দেশটি ১৭ কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য জোগাতে সক্ষম হয়নি। কৃষক ফসল উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করছেন এবং অপেক্ষমাণ সময় অতিক্রমের আগেই বালাইনাশক ব্যবহূত সবজি ও ফল তুলে বাজারে বিক্রি করছেন। এসব বিষাক্ত ফলমূল ও শাকসবজি খেয়ে মানুষ দুরারোগ্য ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ, হূদরোগ, ডায়াবেটিস, পেটের পীড়া, ফুসফুস ও কিডনির নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি গর্ভপাত ও শিশুমৃত্যুর মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। ২০১২ সালে দিনাজপুরে বিষাক্ত লিচু খেয়ে ১৩ জন শিশুর অকাল মৃত্যুতে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এক ধরনের আতঙ্ক। মার্কিন গবেষকরা তাদের প্রতিবেদনে বলেছেন, নিষিদ্ধ কীটনাশক ‘এনডোসালফান’-এর কারণে ওই শিশুদের মৃত্যু হয়েছিল।
বিশ্ববাজারে অরগানিক (জৈব) সবজি ও ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং জৈবপ্রযুক্তিতে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দামও তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্যদিকে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে কেবল মানুষই অসুস্থ হচ্ছে না, বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। বৃদ্ধি পাচ্ছে উৎপাদন খরচ। দূষিত হচ্ছে মাটি, পানি ও বাতাস। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বাড়ছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা খরচ। এছাড়া এলোপাতাড়িভাবে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে শত্রু পোকার সঙ্গে মারা যাচ্ছে উপকারী বন্ধু পোকা এবং পোকার দেহে বালাইনাশকের প্রতিরোধ ক্ষমতার সৃষ্টি হচ্ছে।
এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সারা দেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সারা দেশের ৩৫০টি উপজেলায় এ প্রকল্পের কাজ চলছে। একই প্রকল্পের অধীন দেশের ১০টি উপজেলায় আইপিএম মডেল ইউনিয়ন গঠনের কাজ চলছে। ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলা এবং শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ীতে আইপিএম মডেল ইউনিয়ন গঠনের কাজ চলছে পুরোদমে। প্রতিটি আপিএম মডেল ইউনিয়নের ২৫টি দলে ২০ জন করে কৃষক/কৃষাণীর সমন্বয়ে ৫০০ জন কৃষক/কৃষানীর ১০০ একর জমিতে ব্লক আকারে জৈব কৃষি ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে নানা ধরনের রবি মৌসুমের সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে এবং খরিপ-১ মৌসুমেও এ কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকবে। রবি মৌসুমের সবজির মধ্যে রয়েছে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, শসা, মরিচ ইত্যাদি। প্রকল্পভুক্ত এসব সবজিক্ষেতে সার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট এবং ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনের জন্য রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, হলুদ আঠালো ফাঁদ, নেট হাউজ, জৈব বালাইনাশক; ইকোমেকস ও বায়োট্রিন ইত্যাদি। প্রত্যেক কৃষককে প্রকল্পের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে সবজির চারা উৎপাদনের জন্য বীজ, কেঁচো সার, সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, জৈব বালাইনাশক ও নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। এসব ফাঁদ ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের পদ্ধতির ওপর কৃষক/কৃষাণীদের দুই ধাপে দেয়া হয়েছে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ। শেখানো হয়েছে ফাঁদ স্থাপনের কায়দা-কৌশল। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ৭ নং রামপুর ইউনিয়নে নেয়া হয়েছে এ ধরনের একটি সময়োপযোগী প্রকল্প। প্রকল্পভুক্ত রামপুর ইউনিয়ন এলাকায় আটটি নেট হাউজও নির্মাণ করা হয়েছে সবজির ভাইরাস রোগের বাহক পোকা দমনের জন্য। ত্রিশাল বালিপাড়া পাকা রাস্তার পাশে স্থাপিত ‘জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাইনাশক ব্যবস্থা’-এর প্রদর্শনী ক্ষেতের হলুদ ফাঁদ এবং সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ লাগানো সবজি ক্ষেতগুলো অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। প্রতিদিন শত শত কৃষক এসব ক্ষেতের সেক্স ফেরোমোন ও হলুদ আঠালো ফাঁদে মৃত অনিষ্টকারী অসংখ্য পোকা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। হতবাক হচ্ছেন। জানতে চাচ্ছেন এসব ফাঁদ ব্যবহারের কলাকৌশল, প্রাপ্তিস্থান, মূল্য এবং ব্যবহারের সুবিধা-সুবিধা। শুধু রামপুর ইউনিয়নই নয়, আশপাশের বিশেষ করে বালিপাড়া, ত্রিশাল, বৈলর, ধানীখোলা, কাঁঠাল ও কানিহারী ইউনিয়নের ফল ও সবজিচাষীরাও প্রবল আগ্রহভরে পোকামাকড় দমনের এসব নতুন পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করছেন। নিজেদের সবজিক্ষেতে প্রয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের মধ্যে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের কলাকৌশল-সংক্রান্ত বার্তাটি পৌঁছে দেয়া হবে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে। ক্ষতিকর বালাইনাশকের হাত থেকে কৃষক নিজে বাঁচবেন এবং ভোক্তাকেও বাঁচাবেন। নিরাপদ সবজি বিদেশে রফতানি হবে। ফলে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন।
বাংলাদেশের কৃষক সাধারণত ফসলের পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য কীটনাশক ব্যবসায়ীদের ওপরই বেশি নির্ভর করেন। দেশের কীটনাশক ব্যবসায়ীদের অধিকাংশেরই ফসলের অনিষ্টকারী পোকা-মাকড় দমনের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। তারা পোকা দমন বলতে বোঝেন শুধু ক্ষতিকারক কীটনাশকের ব্যবহার। যে পোকা কৃষক হাতেনাতে দমন করতে পারেন, কেরোসিনমিশ্রিত ছাই ছিটিয়ে দমন করতে পারেন, সামান্য গুঁড়ো সাবানমিশ্রিত পানি ছিটিয়ে দমন করতে পারেন বা নিম পাতা নির্যাস ও তামাকের গুঁড়ো ব্যবহার করে দমন করতে পারেন, সেসব ক্ষেত্রেও কীটনাশক ব্যবসায়ীরা কৃষককে ক্ষতিকর কীটনাশক ক্রয়ে প্রলুব্ধ করেন নিজের লাভের আশায়। শুধু কীটনাশকই নয়, রোগ না হলেও কীটনাশকের সঙ্গে ধরিয়ে দেন রাসায়নিক ছত্রাকনাশক, অণুখাদ্য ও ভিটামিনের নামে গ্রোথ হরমোন। ইদানীং কৃষিশ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় কৃষক ফসলের আগাছা দমনে রাসায়নিক আগাছানাশকও ব্যবহার করছেন প্রচুর। এসব আগাছানাশকও মাটি, পানি, বাতাস ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে।
১৯৯০ সাল থেকে পৃথিবীতে জৈব পদ্ধতিতে উত্পন্ন কৃষিপণ্যের ব্যবহার দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে প্রায় কোটি ১২ লাখ হেক্টর জমিতে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ হচ্ছে, যা মোট আবাদি জমির মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। জৈব সার প্রয়োগ ও জৈব কীটনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল এবং সবজির উৎপাদন খরচ শতকরা ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। এটি জৈব কৃষির একটি বড় সুবিধা। ২০১৪ সালে নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক তাদের গবেষণার মাধ্যমে জৈব খাবারের উপকারিতার কথা প্রমাণ করেন। ব্রিটিশ জার্নাল অব নিউট্রিশনে প্রকাশিত তাদের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাসায়নিক সারও কীটনাশক ব্যবহার করে উৎপাদিত ফসলের চেয়ে জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলে কীটনাশকের পরিমাণ এক-চতুর্থাংশের চেয়েও কম থাকে। বিষাক্ত ধাতব উপাদানও কম থাকে। তাই ক্যান্সার প্রতিরোধী অ্যান্টি-অক্সিডেন্টও অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূলে।
বিষমুক্ত নিরাপদ শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন করতে হলে কৃষকভাইদের রাসায়নিক সারের পরিবর্তে সুবজ সার, কেঁচো সার, কম্পোস্ট, ট্রাইকো কম্পোস্ট, প্রেসমাড, হাঁসমুগির বিষ্ঠা, পচা গোবর, হাড়ের গুঁড়ো, ছাই, খইল, অ্যাজোলা ইত্যাদি এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য কৃষকের অনিষ্টকারী পোকামাকড় ও রোগবালাই সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ লক্ষণ, প্রাদুর্ভাব কাল, আবহাওয়ার প্রভাব, কৃষিতাত্ত্বিক, যান্ত্রিক ও জৈবিক বালাই দমন পদ্ধতি সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান থাকতে হবে। এসব উপকরণ কৃষক যাতে হাতের কাছে এবং স্বল্প মূল্যে পান তারও ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া নিরাপদ সবজি ও ফলমূল উৎপাদনের কলাকৌশল সহজে সফলতার মুখ দেখবে না। এজন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পদক্ষেপগুলো হলো— ১. সারা দেশে ব্যাপক ভিত্তিতে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, বালাইনাশক ডিলার, খুচরা বিক্রেতা ও কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকদের হাতেনাতে এসব পদ্ধতির ব্যবহার শেখাতে হবে। ২. কৃষক যাতে হাতের কাছে সহজেই এসব উপকরণ পান, তার ব্যবস্থা করতে হবে। ৩. জৈব বালাইনাশক ও বিভিন্ন ফাঁদের দাম যেন কৃষকের সাধ্যের মধ্যে থাকে সেজন্য এসব পণ্যের ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার এবং প্রয়োজনে সরকারি ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. যেসব শিল্প-কারখানা জৈব বালাইনাশক ও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ উৎপাদন করবে, তাদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান এবং কমপক্ষে ১০-১৫ বছর কর অবকাশের সুবিধা দিতে হবে। ৫. রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শহরগুলোয় বিষমুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল বিক্রির জন্য আলাদা কৃষক বাজার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ৫. বিষমুক্ত কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দেশে অঞ্চলভিত্তিক খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পনগরী গড়ে তুলতে হবে। ৬. বিষমুক্ত নিরাপদ সবজির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। ৭. এ ব্যাপারে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।
নিতাই চন্দ্র রায়: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, গোপালপুর, নাটোর