আলোকপাত

আমন ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু

২৩ নভেম্বর উদ্বোধন হলো সরকারের আমন ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম। নওগাঁ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এ সংগ্রহ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। উল্লেখ্য, সরকার চলতি আমন মৌসুমে মোট সাত লাখ টন ধান ও চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে দুই লাখ টন ধান ও পাঁচ লাখ টন চাল। চার লাখ টন সিদ্ধ চাল কেনা হবে ৪৪ টাকা

২৩ নভেম্বর উদ্বোধন হলো সরকারের আমন ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম। নওগাঁ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এ সংগ্রহ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। উল্লেখ্য, সরকার চলতি আমন মৌসুমে মোট সাত লাখ টন ধান ও চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে দুই লাখ টন ধান ও পাঁচ লাখ টন চাল। চার লাখ টন সিদ্ধ চাল কেনা হবে ৪৪ টাকা কেজি দরে এবং এক লাখ টন আতপ চাল কেনা হবে ৪৩ টাকা কেজি দরে। আর দুই লাখ টন ধান কেনা হবে ৩০ টাকা কেজি দরে। গত আমন মৌসুমের তুলনায় এবার ধান ও চালে প্রতি কেজিতে ২ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আসলে এ দাম গত বোরো মৌসুমের ধান ও চালের সংগ্রহ মূল্যের সমান। ২৩ নভেম্বর শুরু হয়ে আমন ধান-চালের এ সংগ্রহ অভিযান চলবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গত ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সরকারের আমন ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। 

যে বিষয়গুলো অনেক বছর ধরে সরকারকে আমন ও বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে ধান ও চাল সংগ্রহে প্রভাবিত করে আসছে, সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো—এক. ধান কাটা ও ঘরে তোলার মৌসুমে বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখা। আমাদের দেশে ধানচাষীদের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তারা ধারদেনা করে ফসল ফলান। তাদের সংসারে নানা অভাব-অনটন লেগেই থাকে। ফলে ধান কাটার পর পরই বহুকষ্টে ফলানো ফসল বিক্রি করতে বাজারে নিতে হয়। মৌসুমের শুরুতে ধানচাষীরা যাতে ধানের ন্যায্য দাম পান, তা যতটা সম্ভব নিশ্চিত করতে সরকার মাঠপর্যায়ে চাষীদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনে। দুই. সরকারি গুদামে চালের নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলা। সরকারি খাদ্যগুদামে যথেষ্ট পরিমাণে ধান-চাল মজুদ থাকলে তা চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়াতে নিরুৎসাহিত করে। তিন. বাজারে চালের দাম বাড়লে সরকারি মজুদ থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস) ও ন্যায্যমূল্যের দোকানে চাল বিক্রির মাধ্যমে এর দাম স্থিতিশীল রাখা। তাছাড়া সরকারি গুদামের মজুদ থেকে সরকার নির্দিষ্টসংখ্যক হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে স্বল্প মূল্যে চাল বিতরণ করে আসছে। এটি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নামে পরিচিত। চার. খাদ্যশস্যের (চাল, গম) সরকারি মজুদ থেকে সরকারের লক্ষ্যমুখী খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। এসব কর্মসূচির মধ্যে দুস্থ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন (ভিজিডি), দুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য সহায়তা (ভিজিএফ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

দেশে চাল উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বোরো। বছরে মোট উৎপাদিত চালের কমবেশি ৫৫ শতাংশ পাওয়া যায় বোরো থেকে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এর তথ্য মোতাবেক গত পাঁচ বছরে (২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২) বোরোর উৎপাদন বছরে যখন ১ কোটি ৯৫ লাখ টন থেকে ২ কোটি ৯ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তখন দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আমন উৎপাদনের পরিমাণ বছরে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার টন থেকে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার টনের মধ্যে রয়েছে। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা আউশের বছরে উৎপাদনের পরিমাণ সীমাবদ্ধ ছিল ২৭ লাখ থেকে ৩২ লাখ ৪৫ হাজার টনের মধ্যে। সে কারণে সরকার ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে বোরোর পর আমনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। 

চলতি আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহে সরকারি কর্মসূচির একাধিক অসংগতি উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। এক. চলতি আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা ২০২২-২৩ অর্থবছরের আমন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এক লাখ টন কম। গত বছর আমন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় আট লাখ টন। এর মধ্যে ধান তিন লাখ টন এবং চাল পাঁচ লাখ টন। এবার ধানের পরিমাণ এক লাখ টন কমিয়ে আনা হয়েছে। আর এবারের ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় চার লাখ টন কম। ২০১৯-২০ অর্থবছরের আমন মৌসুমে ১০ লাখ টন ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ছিল ছয় লাখ টন ধান এবং চার লাখ টন চাল। যেহেতু সরকারের ধান সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্য হলো মৌসুমের শুরুতে ধানের দাম স্থিতিশীল রেখে ধানচাষীদের আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করা, সেহেতু ২০১৯-২০ অর্থবছরে অধিক পরিমাণে ধান কেনার সিদ্ধান্ত ধান সংগ্রহ নীতিমালার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল। যতদূর মনে পড়ে, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ওই সময় বা পরবর্তী কোনো একসময় বলেছিলেন, ভবিষ্যতে ধানচাষীদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হবে। কিন্তু এখন ঘটছে তার বিপরীত। এটি আমন ও বোরো উভয় ধান ফসলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

দুই. প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকদের মাধ্যমে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা মোটামুটি পূরণ হলেও ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছে না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে গত আমন মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে তিন লাখ টন ধান এবং পাঁচ লাখ টন চাল। ধান সংগ্রহ হয়েছিল মাত্র ৪ হাজার ৬৯৫ টন এবং চাল ৪ লাখ ৩০ হাজার টন। বোরোর ক্ষেত্রেও এ রকম উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যেসব কারণে আমন ও বোরো ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার অনেক পেছনে থাকে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—১. চাষীর ধান উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সরকার নির্ধারিত দামের সংগতির অভাব। অর্থাৎ ধানচাষীদের বক্তব্য অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত ধানের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে কম। ২. সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে চাষীদের ধান সরবরাহে যেসব মাননির্দেশক বিনির্দেশ পালনের কথা, সেগুলো তাদের আগে তেমন অবহিত করা হয় না। ফলে অনেক সময় তাদের ধানে আর্দ্রতার পরিমাণ বা বিজাতীয় পদার্থের মিশ্রণ বা চিটার পরিমাণ নীতিমালায় নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি থাকে। মাঠপর্যায়ে খাদ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ ধরনের ধান নিতে আপত্তি জানালে ধানচাষীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়। এতে ধানচাষীরা সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান বিক্রিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ৩. সাম্প্রতিক বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সরকারি ধান সংগ্রহের মৌসুমে খোলাবাজারে ধানের দাম বেশি ছিল। এতে চাষীরা সরকারের কাছে ধান বিক্রিতে গরজ অনুভব করেননি। তবে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, বর্তমানে আমন ধানের দাম সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম। ২৪ নভেম্বর ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারে আসা নতুন আমন ধানের দামের উল্লেখ রয়েছে। এতে দেখা যায়, বাজারভেদে প্রতি মণ মোটা আমন ধান ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা, ধানি গোল্ড ধান ১ হাজার ৫০ টাকা, মোটা স্বর্ণা ১ হাজার ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ দাম সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে মণপ্রতি ৭৫ থেকে ১০০ টাকা কম। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ দাম সাময়িক। সরকার পুরোপুরিভাবে ধান সংগ্রহ শুরু করলে এবং চালকল মালিকরা ধান কিনতে বাজারে এলে ধানের দাম বেড়ে যাবে। আসলে আমন ধানের দাম নির্ভর করবে দেশে ফসলটির মোট উৎপাদন এবং চাল আমদানি পরিস্থিতির ওপর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আশা করছে, এবার আমন উৎপাদন দাঁড়াবে ১ কোটি ৭০ লাখ টনে, যা লক্ষ্যমাত্রার (১ কোটি ৬৩ লাখ টন) চেয়ে সাত লাখ টন বেশি। এদিকে চলতি মৌসুমে আমন ফসল উৎপাদন সম্পর্কে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাসে বলা হয়, সময়মতো প্রচুর বৃষ্টিপাতের অভাবে আমন আবাদের জমি ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ৩ শতাংশ ও ৪ শতাংশ হ্রাস পাবে। আমন আবাদের জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৫৭ দশমিক ৫ লাখ একর ও ১ কোটি ৪০ লাখ টনে। এ উৎপাদন গত বছর সরকারি হিসাবে উৎপাদিত ১ কোটি ৬৩ লাখ টনের চেয়ে ২৩ লাখ টন কম। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিতব্য হিসাবে জানা যাবে এ বছর আমন উৎপাদনের প্রকৃত পরিমাণ। তবে অতীতের উদাহরণ থেকে অনেকটা জোর দিয়ে বলা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবের সঙ্গে বিবিএসের হিসাবের তারতম্য ঘটবে অর্থাৎ বিবিএসের হিসাবে বোরোর উৎপাদন হ্রাস পাবে। এদিকে বোরো মৌসুমের শেষ সময় (ফেব্রুয়ারি, ২০২৪) পর্যন্ত দেশে চাল আমদানি বন্ধ থাকায় পণ্যটির দাম বেড়েই চলেছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা টিসিবির তথ্যে জানা যায়, ২৬ নভেম্বর মোটা চাল বিক্রি হয় ৫০-৫২ টাকা প্রতি কেজি। এক মাস আগে দাম ছিল ৪৮-৫২ টাকা। আর ২৬ নভেম্বর একটি দৈনিকের (সময়ের আলো) খবরে বলা হয়, এক মাসের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে মোটা চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪-৫ টাকা। মাঝারি মাঝারি চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫-৬ টাকা আর চিকন চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২-৩ টাকা।

ওপরের বর্ণনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, সরকার পুরোপুরিভাবে আমন ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করলে এবং চালকল মালিকরা ধান কিনতে বাজারে এলে ধানের দাম সরকার নির্ধারিত দামকে অতিক্রম করবে। সেক্ষেত্রে ধানচাষীরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি না করে খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে আগ্রহী হবেন। তাই চালকল মালিকরা ধান ক্রয়ে বাজারে আসার আগেই সরকার ধান সংগ্রহে ব্যবস্থা না নিলে আগের মতো এবারো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। তবে ধানের দাম বেশি বেড়ে না গেলে চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকদের মাধ্যমে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা মোটামুটি পূরণ হবে। আর ধানের দাম বেশি বেড়ে গেলে, চালকল মালিকরা চালের দাম বাড়ানোর দাবি করবেন এবং তা আদায়ে সমর্থ হবেন। অতীতে এমন ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব 

আরও