সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালের জন্য দুর্নীতির ধারণাসূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। বিশ্বের ১৮০টি দেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গত ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত সিপিআই রিপোর্ট ২০২৩-এ বলা হয়েছে, ‘Most countries have made little to no progress in tackling public sector corruption’, যার অর্থ দাঁড়ায়, অধিকাংশ দেশ সরকারি খাতে দুর্নীতি মোকাবেলায় অতি সামান্য থেকে শূন্য অগ্রগতি সাধন করেছে। রিপোর্ট থেকে আরো জানা যায়, ১৮০টি দেশের মধ্যে মাত্র ২৮টি দেশ তাদের দুর্নীতি সূচকে উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে এবং ৩৪টি দেশের দুর্নীতি সূচকে অবনতি হয়েছে। আর গতবারের তুলনায় বৈশ্বিক দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবনমন হয়েছে। সিপিআই সূচক ২০২৩-এ সবচেয়ে ভালো ও খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলোসহ বাংলাদেশের অবস্থান পর্যালোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
বিশ্বের ১৮০টি দেশের দুর্নীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রকাশিত সিপিআই সূচক ২০২৩-এ দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০ থেকে ১০০-এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়। সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর নিয়ে সিপিআই সূচক ২০২৩-এ সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে ডেনমার্ক। দেশটি সিপিআই সূচক ২০২২-এ একই অবস্থানে ছিল। পরের চারটি অবস্থান ২, ৩, ৪ ও ৫-এ রয়েছে যথাক্রমে ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে ও সিঙ্গাপুর। তাদের স্কোর যথাক্রমে ৮৭, ৮৫, ৮৪ ও ৮৩। সিপিআই সূচক ২০২২-এ তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া। ১১ স্কোর নিয়ে ১৮০-তে অবস্থান তাদের। এর পরের চারটি অবস্থান রয়েছে যথাক্রমে ভেনিজুয়েলা, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেন। ১৩ স্কোর নিয়ে ভেনিজুয়েলা, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদানের অবস্থান ১৭৭তম। আর ১৬ স্কোর নিয়ে ইয়েমেনের অবস্থান ১৭৬তম।
এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। টিআইয়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল টানা পাঁচ বছর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। এর মধ্যে ২০০১ সাল ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ বছর। অন্যদিকে ২০০২-০৫ পর্যন্ত ছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সময়কাল। বর্তমানে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন না হলেও বাংলাদেশ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর সারিতে রয়েছে। সিপিআই সূচক ২০২৩-এ ২৪ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯। সিপিআই সূচক ২০২২ এবং ২০২১-এ ২৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৭। সে বিবেচনায় সিপিআই সূচক ২০২৩-এ বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনমন ঘটেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) মতে, গত এক দশকে দুর্নীতির অবস্থানে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি ঘটেনি, বরং অবনতি হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানে অবনতির প্রধান কারণ হলো দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। দেশে দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি সরকার ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন সংস্থা (দুদক) প্রতিষ্ঠা করলেও তারা সংস্থাটিকে পুরোপুরি কার্যকর করতে তেমন উৎসাহী ছিল না। তাছাড়া দলীয় স্বার্থরক্ষার জন্য এমন সব ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, যারা বিএনপির আদর্শ ও ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। ক্ষমতাসীন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে চুপ করে থাকাকেই তারা শ্রেয় মনে করেন। চেয়ারম্যান ও একজন কমিশনারের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দুদকের কার্যক্রম অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতি দমনে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, সেগুলোর মধ্যে ছিল—ক. দুদকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালীকরণ; খ. দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন; গ. ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণী জমা প্রদান; ঘ. রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে ঘুস-দুর্নীতি উচ্ছেদ; অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে ব্যবস্থা গ্রহণ। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির খুব কমই বাস্তবায়ন হয়। ফলে ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১২, ১৩, ১৩, ১৬ ও ১৪তম। দুর্নীতি প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ দশম সংসদ নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৪-এ রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেয়। এসব প্রতিশ্রুতির যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১৩, ১৫ ও ১৭তম। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারেও আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের ঘোষণা দেয়। অথচ সিপিআই সূচকে এক ধাপ অবনতি হয়ে ২০২১ সালে বিশ্বে ১৩তম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ থেকে বাংলাদেশ ২০২২ সালে নিম্নক্রম অনুযায়ী ১২তম অবস্থানে আসে। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনী ইশতেহার ২০২৩-এ আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের যে ঘোষণা দিয়েছে তার ফলপ্রসূতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা অমূলক নয়।
আমাদের দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা, তা জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই হোক, অর্থ ও পেশিশক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর যে ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তা মেনে চলার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। টিআইবির এক জরিপমতে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা গড়ে নির্বাচন কমিশন অনুমোদিত ব্যয়ের অধিক ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করেন। জরিপ মোতাবেক, এ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। নির্বাচিত হলে ব্যয়িত অঢেল অর্থ তারা যেকোনো উপায়ে তুলে নেবেন—এ ছিল তাদের আশা। তাই নির্বাচিত হওয়ার পর এসব জনপ্রতিনিধির লক্ষ্য থাকে নির্বাচনে ব্যয়িত টাকা আয় করা ও পরবর্তী নির্বাচনের জন্য টাকা জোগাড় করা। এজন্য তারা দুর্নীতির আশ্রয় নেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (ডিসেম্বর ২০১৮) আগে একটি দৈনিকে (যুগান্তর, ১৮ নভেম্বর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের নির্বাচনে কী পরিমাণ ব্যয় হয়, সে ব্যাপারে সরকারি কোনো গবেষণা নেই। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার গবেষণা বলছে, নির্বাচনী অর্থনীতির আকার ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতি নির্বাচনেই এ হার ১০-২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ছে। মনোনয়ন পাওয়ার আগেই বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করেন প্রার্থীরা। মনোনয়ন পেতে প্রকাশ্য ও গোপনে নানা ধরনের তৎপরতা চলে। এক্ষেত্রে দলের শীর্ষ পর্যায়ে দিতে হচ্ছে মোটা অংকের চাঁদা। উন্নয়নের জন্য ব্যক্তি বা দলীয় পরিসরে অর্থায়ন। এছাড়া ক্লাব, সমিতি, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে দিতে হচ্ছে অর্থ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টিআইবি ৫০টি আসনের ১৪৯ জন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, এসব প্রার্থীর গড় ব্যয় দেড় কোটি টাকার বেশি ছিল।
বাংলাদেশের দুর্নীতি চক্রে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকা অত্যন্ত শক্তিশালী। এখানে সরকারি কর্মচারী বলতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে বা কোনো করপোরেশন বা তার অধীন সেবা প্রদানকারী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিকে বোঝাবে। প্রশ্ন হলো, সরকার সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিলেও তারা সরকারি চাকরি আইনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব এবং আইনের দুর্বলতার কারণে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়াকে মূলত এজন্য দায়ী করা হচ্ছে। সরকারি কর্মচারীদের দলীয়করণকেও এজন্য কিছুটা দায়ী করা যায়। দলবাজ সরকারি কর্মচারীরা হয়ে উঠেছেন দুর্নীতিবাজ।
বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা দুর্নীতির জন্য কম দায়ী নন। বেসরকারি খাত বিভিন্নভাবে দুর্নীতি করে। কর ফাঁকি দিতে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের প্রকৃত সম্পদ ও লাভের পরিমাণ কর কর্মকর্তাদের দেখায় না। আমদানি-রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেয়া একটি মামুলি ব্যাপার। এ সম্পর্কিত খবর আমরা পত্রপত্রিকায় প্রায় দেখে থাকি।
রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির খবর মিডিয়ায় অহরহ প্রকাশ হচ্ছে। কানাডা ও দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের অবৈধভাবে বাড়ি কেনাসহ সম্পদ গড়ে তোলার খবর মিডিয়ায় গুরুত্বসহ প্রকাশ হচ্ছে। এরা মূলত রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং ক্ষমতাসীন দলের আদর্শ ও ভাবধারায় বিশ্বাসী কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। বলা হয়ে থাকে, এরা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। যত শক্তিশালী হোক, প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে দুদককে এসব অভিযোগ সুষ্ঠুভাবে অনুসন্ধান করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলে সিপিআই সূচকে বাংলাদেশ সম্মানজনক অবস্থানে চলে আসবে।
মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক সচিব