মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, ক্রয়ক্ষমতা কমছে—সমাধান কী?

অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির বিচরণ খুবই স্বাভাবিক। মূল্যস্ফীতির হার কখনো শূন্য হয় না। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির হার সর্বদা পরিবর্তন হয়। মূল্যস্ফীতি বাড়ার সঙ্গে যদি বেকারত্বের হার বাড়ে এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে, তাহলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।

অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির বিচরণ খুবই স্বাভাবিক। মূল্যস্ফীতির হার কখনো শূন্য হয় না। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির হার সর্বদা পরিবর্তন হয়। মূল্যস্ফীতি বাড়ার সঙ্গে যদি বেকারত্বের হার বাড়ে এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে, তাহলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। নিম্ন আয়ের মানুষ তিন বেলা না খেয়ে দুই বেলা বা এক বেলা খেয়ে বেঁচে থাকতে চায়। একপর্যায়ে অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। এ বছরের ৩০ মার্চ সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতির কারণে ৩৭ শতাংশ মানুষ এক বেলা আহার না করে থাকার চেষ্টা করছে। ৭১ শতাংশ মানুষ চাহিদার তুলনায় কম খাচ্ছে। ১৮ শতাংশ মানুষ বিগত ছয় মাস ধরে না খেয়ে থাকার চেষ্টা করছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে নিম্ন আয় এবং মধ্যম আয়ের মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সীমিত আয় দিয়ে জীবন মান ধরে রাখাও যাচ্ছে না। নিত্যপণ্যের ওপর ব্যয় অনেক গুণ বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ অন্যান্য বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিলাসবহুল পণ্যের দোকানে এখন আগের মতো ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায় না।  

মূলত সারা বিশ্বে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়া শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই। এ যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তার কারণ হলো সারা পৃথিবীতে রাশিয়া থেকে প্রতিদিন ৬.৫ মিলিয়ন ব্যারেল ক্রুড অয়েল রফতানি করা হয়। রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলে পৃথিবীর মোট চাহিদার ২৯ শতাংশ গম রফতানি করে। রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি করা হয় মোট চাহিদার ১৭ শতাংশ, সূর্যমুখী তেল রফতানি করা হয় ৭৫ শতাংশ, নাইট্রোজেন সার ১৫ শতাংশ, পটাশ সার ১৭ শতাংশ। এ তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সারা পৃথিবীতে পড়বে। যুদ্ধের কারণে স্বাভাবিক সরবরাহ চ্যানেল বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে পণ্য আমদানি ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে যায়। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়ে ভোক্তা শ্রেণীর ওপর। যুদ্ধের প্রভাব থেকে বাংলাদেশও রেহাই পায়নি।  রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ খাদ্যশস্য, জ্বালানি তেল, সূর্যমুখী তেল, সার আমদানি করে। আমদানি ব্যয় বাড়ায় স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলোয় দেখা যায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি। দুঃখের বিষয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে বেশির ভাগ দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে সক্ষমতা অর্জন করলেও বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। তারা বিভিন্ন নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে। বাংলাদেশও মূল্যস্ফীতি দমনে নীতি গ্রহণ করছে। কিন্তু নীতিগুলো কার্যকর হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তা অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি।

সংশ্লিষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, চলতি বছরের জুনে মালদ্বীপে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ভুটানে ৩ দশমিক ৮৩, নেপালে ৬ দশমিক ৮৩, ভারতে ৪ দশমিক ৮১ ও বাংলাদেশে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বহুল আলোচিত শ্রীলংকা কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে এ বছরের জুলাইয়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। শ্রীলংকায় যখন মূল্যস্ফীতির হার ৭০ শতাংশের ঘরে বাংলাদেশে তখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ। শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতির হার যখন ৭ শতাংশের ঘরে বাংলাদেশে তখন এ হার বেড়ে ১০ শতাংশের ঘরে চলে যায়। সারা বিশ্বে জ্বালানি তেল, পাম অয়েল, সয়াবিন তেল, গম, তুলা, সারের দাম কম হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী।

খাদ্য ও জ্বালানি তেলনির্ভর এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব প্রকট আকারে দেখা দিচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। ঢাকাভিত্তিক পিআিরসি ও বিআইজিডি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলেছে, মূল্যস্ফীতির কারণে ২১ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে। হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভের গবেষণা বলেছে, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয়ের তিন গুণ বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতিতে এখন আয় ও ভোগের বৈষম্য চরম আকারে বেড়ে যাচ্ছে। বৈষম্য বাড়ার আরো অনেক কারণ রয়েছে। আয় ও ভোগবৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, জিনি সহগ (আয়ের দিক থেকে) বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৪৯৯, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২ এবং ২০১৩ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। ভোগের দিক থেকে জিনি সহগ এখন রেকর্ড করা হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৩৪, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪। আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন, মাসিক ব্যয় বেড়ে ২০২৩-এ হয়েছে ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, যা ২০১০ সালে ছিল ১১ হাজার ২০০ টাকা।

অতিসম্প্রতি বিবিএস বলেছে যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষরা এখন নিম্ন মানের খাদ্যদ্রব্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে অর্থাৎ ভোগের ধরন পরিবর্তন হয়েছে। ১ জানুয়ারি ২০১৩-এ প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ২০১৯ সালে মোটা চাল খাওয়ার হার ছিল ৮২ শতাংশ, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২ শতাংশে। মধ্যম আয়ের মানুষের মোটা চাল খাওয়ার হার ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ঢাকাভিত্তিক সানেম গবেষণা প্রতিষ্ঠান  ২০২২ সালে আটটি বিভাগে ১ হাজার ৬০০ পরিবার নিয়ে গবেষণা করে দেখেছে যে ছয় মাস ধরে ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে।  যেখানে বিগত ছয় মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে, যুক্তরাজ্যে ১০ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৭ শতাংশে, জার্মানিতে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। মূল্যস্ফীতির হার কমানোর অনেক উপায়ের মধ্যে অন্যতম হলো সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া। বেশির ভাগ দেশ সুদের হার বাড়িয়ে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপানো বন্ধ করে দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। অন্যপক্ষে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে সহায়তা করে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েই চলবে। বাজেটের আকার প্রতি আর্থিক বছরে বাড়ছে। আকাঙ্ক্ষিত পরিমাণে রাজস্ব আয় না বাড়ায় বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। বাজেট ঘাটতি পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ নিলে সেটা অর্থনীতিতে প্রবেশ করে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া হয় ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। চলমান অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। এর বেশির ভাগ অর্থ যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আসে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলংকার (সিবিএসএল) গভর্নর নন্দলাল বীরাসিংহে রুপি ছাপিয়ে সরকারকে সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ার অনেক কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো করোনাভাইরাস দেখা দেয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার ৯ শতাংশে বেঁধে দেয়। ফলে বাড়তে থাকে টাকার প্রবাহ। এ প্রবাহ কয়েক বছর চলতে থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বেঁধে দেয়া সুদের হার চলতে থাকে। আইএমএফের চাপে পড়ে সুদের হার এখন বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। তাহলে মূল্যস্ফীতি বাড়ার এ দায় কারএটা সত্য যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে কিছু আমদানি পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং এখনো চলমান। অর্থনীতিতে চাহিদার তুলনায় জোগান কম হলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের চেয়ে পরোক্ষ কর আদায়ের প্রবৃদ্ধি বেশি। পরোক্ষ কর আদায়ের টার্গেট বেশি থাকলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। ডলার সংকটের কারণেও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। বাংলাদেশ এখন ডলার সংকটের মধ্যে দিন পার করছে। 

মূল্যস্ফীতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মজুরি হার বাড়লে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনমান ঠিক রাখা সম্ভব। ২০১৯ সালের আইএলও রিপোর্ট অনুযায়ী, যেখানে মজুরি বাড়ার প্রয়োজন সেখানে ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রকৃত সর্বনিম্ন মজুরি কমেছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এ বছরের মার্চে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য মজুরি বাড়ানো হয়েছে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে  ফেব্রুয়ারিতে ৪৪টি পেশায় নিয়োজিত কর্মীদের জন্য মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এ সিদ্ধান্ত কি সময়োপযোগী? সর্বনিম্ন মজুরির দিক থেকে মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম থেকে বাংলাদেশ অনেক পেছনে রয়েছে। ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাসিক সর্বনিম্ন মজুরি ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল, সেখানে শ্রীলংকায় ২৪৭ ডলার, ভিয়েতনামে ৩৮৮, নেপালে ৩৯৬ ও ভারতে ২১৫ ডলার ছিল। মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে মানুষ সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়। এতে সৃষ্টি হয় রুগ্‌ণ একটা পুরো জাতি। রুগ্‌ণ জাতি দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা কি সম্ভব? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে এখন দোষারোপ না করে অন্যান্য দেশের মতো নীতি গ্রহণ করে বহুল আলোচিত মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাই।

মো. মাজেদুল হক: ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

আরও