বিশ্ব মেডিটেশন দিবস

চিকিৎসা ব্যয় কমাতে পারে মেডিটেশন

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ জনসংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৮০ হাজার, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ। জনমিতি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধির এ ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। জনসংখ্যার পিরামিড দেখলে বোঝা যায়, ২০৩০ সালের পর থেকে এ বৃদ্ধির ধারা প্রকট হতে শুরু করবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ জনসংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৮০ হাজার, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ। জনমিতি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধির এ ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। জনসংখ্যার পিরামিড দেখলে বোঝা যায়, ২০৩০ সালের পর থেকে এ বৃদ্ধির ধারা প্রকট হতে শুরু করবে। 

আমরা সবাই জানি, আমাদের জনগোষ্ঠীতে এখন তরুণদের সংখ্যা বেশি। জনমিতির ভাষায় একে বলা হয় ডেমোগ্রাফিক বোনাস। রাস্তাঘাট, হাটবাজার যেখানেই তাকাই—সবদিকেই তরুণ জনসংখ্যার আধিক্য। কিন্তু আমরা কি একটু ভেবে দেখেছি, আজ যাদের আমরা তরুণ দেখছি, ঠিক ২০ বছর পর তাদের কয়জনকে আমরা তরুণ বলতে পারব। যদি আরেকটু ভেঙে বলি, এ তরুণ জনগোষ্ঠীটিই ভবিষ্যতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। এটাও সত্য, বয়স যত বাড়তে থাকে নানা ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা বাড়তে থাকে। 

আজকে যে মানুষগুলোকে আমরা রাস্তাঘাটে হাটবাজারে দেখতে পাচ্ছি তাদের বড় একটি অংশ ভবিষ্যতে দেশ-বিদেশের নানা হাসপাতালগুলোয় ছুটোছুটি করবে চিকিৎসার জন্য। বুঝতেই পারছেন, দেশের বিদ্যমান হাসপাতালগুলোর ওপর কেমন চাপ বাড়বে। এছাড়া মানুষজন প্রবীণ হতে থাকে, তার কর্মক্ষমতাও কমতে থাকে (কিছু ব্যতিক্রম বাদে)। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা উপার্জন করার মতো অবস্থায় থাকে না। একদিকে উপার্জন নেই, অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাওয়া। দিন শেষে বাড়তি এ খরচের বোঝা রাষ্ট্রের ওপরই এসে পড়বে। 

তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরেকটি আশঙ্কা। একাধিক রোগের বোঝা। আগে একজন মানুষের সাধারণ একটি অথবা দুটো রোগ থাকত। এখন একই ব্যক্তির মধ্যে একাধিক রোগের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ বয়স্ক মানুষের মধ্যেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তার সঙ্গে আরো যোগ হয়েছে কিডনি জটিলতা, হাড়ক্ষয়, স্ট্রোক, অনিদ্রা, ক্যান্সার, ডিমেনশিয়াসহ নানা জটিল ব্যাধি। অর্থাৎ এখন প্রবীণ মানুষজনের মধ্যে রোগের সংখ্যা বেশি। রোগের সংখ্যা বেশি মানে চিকিৎসা ব্যয় বেশি। 

আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে খুব বেশি উচ্ছ্বসিত হওয়ার সুযোগ নেই। সীমিত বাজেট ও জনবল, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সঠিক ব্যবস্থাপনাসহ অনেক কিছুরই ঘাটতি আছে। তার সঙ্গে যদি প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যদি মাথাপিছু রোগের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়, তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য বাজেটের ওপর কী পরিমাণ চাপ পড়বে তা সহজেই অনুমান করা যায়। 

বুঝতেই পারছি, ভবিষ্যতে আমরা একটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। তাহলে সমাধান কোন পথে? এক্ষেত্রে দুটো সমাধান হতে পারে। এক. চিকিৎসা খাতে ব্যয় এবং পুরো স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো এমনভাবে প্রস্তুত করা যেন তা বাড়তি এ চাপ সামলাতে পারে। দুই. দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে সুস্থ জীবনাচারে (অর্থাৎ সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম ও ইতিবাচক দৃষ্টভঙ্গি লালন) অভ্যস্ত করিয়ে রোগ ও বার্ধক্যজনিত শারীরিক সমস্যার লাগাম টেনে ধরা। 

প্রথম সমাধান নিয়ে কারো মধ্যে কোনো প্রশ্ন নেই। কারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতি আমাদের মধ্যে থাকতেই হবে। তবে বুদ্ধিমান যে কেউই দ্বিতীয় মতের পক্ষেও গুরুত্ব দেবেন। কারণ এটাই উত্তম পন্থা। আসলে আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে যদি সঠিক খাদ্যাভ্যাস, যোগ ব্যায়াম এবং মেডিটেশনে উদ্বুদ্ধ করাতে পারি, তাহলে জাতির সামষ্টিক স্বাস্থ্যে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এতে রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনার পাশাপাশি রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যয়কেও উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব। 

বর্তমান বিশ্বে প্রবীণদের মধ্যে এখন হৃদরোগের প্রকোপ বাড়ছে। এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারির মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা করতে গিয়ে কত পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে তা আমাদের জানা নেই। অথচ হৃদরোগীদের যদি নিয়মিত মেডিটেশন ও সঠিক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত করানো যেত তাহলে এ চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। ১৯৮৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার কার্ডিওলজিস্ট ডা. ডিন অরনিশ ৪০ জন হৃদরোগী নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। এসব রোগীকে তিনি এক বছর ধরে মেডিটেশন, যোগব্যায়াম এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস চর্চার মাধ্যমে হৃদরোগ থেকে মুক্ত করে তিনি প্রমাণ করেন—ওষুধ বা সার্জারি ছাড়াও হৃদরোগ নিরাময় করা সম্ভব। 

এ গবেষণার খবর নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় সে বছর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ হয়। মেডিটেশনের মাধ্যমে হৃদরোগ নিরাময়ে অসাধারণ সাফল্যের ওপর তার বিখ্যাত বই ‘প্রোগ্রাম ফর রিভার্সিং হার্ট ডিজিজ’ বেস্ট সেলার গ্রন্থে পরিণত হয়। মেডিটেশনের মাধ্যমে হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধে ডা. ডিন অরনিশের গবেষণাকাজ এত ব্যাপক স্বীকৃতি পেয়েছে যে এটি এখন আর বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বেই এটি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মেডিটেশনের মাধ্যমে হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। 

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের আরেকটি গবেষণাও একই রকম আশা দেখাচ্ছে। গবেষক ড. জেমস ই স্টল ও তার দল ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের (বেনসন হেনরি ইনস্টিটিউট ফর মাইন্ড বডি মেডিসিন) সঙ্গে যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মেডিটেশন, যোগ ব্যয়াম এবং ইতিবাচক জীবনদৃষ্টির বিভিন্ন পদ্ধতি চর্চা করানো হয়। ফলাফল যা এল তা অবাক করার মতো। দেখা গেল, মেডিটেশন চর্চা শুরু করার পর অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রোগের হার এবং চিকিৎসা ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেল। এ পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে গবেষকরা বলেছেন, মেডিটেশন ও যোগ ব্যায়ামকে চিকিৎসার মূলধারায় যুক্ত করা গেলে বছরে জনপ্রতি ৬৪০ ডলার থেকে ২৫ হাজার ৫০০ ডলার সঞ্চয় করা সম্ভব (হার্ভার্ড হেলথ ব্লগ, ১৮ নভেম্বর ২০১৫)। 

পশ্চিমা বিশ্বের অনেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীদের মেডিটেশন চর্চার করার জন্য প্রেসক্রাইব করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বহু আগেই মেডিটেশনকে অল্টারনেটিভ মেডিসিন (ওষুধের বিকল্প) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে মেডিটেশন চর্চা প্রসারের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস ১০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। কারণ তারা ভালো করেই জানে, রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধে মেডিটেশনকে যুক্ত করতে পারলে চিকিৎসা ব্যয় কমানো সম্ভব। 

ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল, মেয়ো ক্লিনিক, জন হপকিন্স হাসপাতালের মতো প্রথমসারির চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো নিরাময়ের লক্ষ্যে রোগীদের মেডিটেশন চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। পাশ্চাত্যের ডাক্তাররা আগে প্রেসক্রিপশনে লিখতেন ‘বেডরেস্ট’, এখন লেখেন ‘মেডিটেট’। মূলত চিকিৎসা ব্যয়ে লাগাম টানতে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ এখন রোগ নিরাময় থেকে রোগ প্রতিরোধের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। 

আমাদের প্রতিবেশ দেশ ভারতেও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের সুস্থ করার জন্য মেডিটেশন করানো হয়। অবশ্য বাংলাদেশও যে হাত গুটিয়ে বসে আছে, তা বলা ঠিক হবে না। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন সম্মিলিতভাবে উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি লিখিত গাইডলাইন প্রণয়ন করে। ওই গাইডলাইনে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ডাক্তাররা যেন রোগীদের যোগ ব্যয়াম, মেডিটেশন এবং দমচর্চার পরামর্শ দেন সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। 

আমার ধারণা, মেডিটেশন চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য এটাই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম স্বীকৃতি। এরপর ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনিদ্রা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও স্ট্রোক জাতীয় সমস্যা নিরসনে বিদ্যমান চিকিৎসা সেবার সহায়ক হিসেবে মেডিটেশনকে স্বাস্থ্যসেবার পরিপূরক হিসেবে ঘোষণা দেয়। এ স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীকে মেডিটেশন চর্চায় উৎসাহিত করবে। 

এখন আমাদের দেশের বহু ডাক্তার উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, হতাশা, বিষণ্ণতা, অনিদ্রা, বাতব্যথা, অ্যালার্জি, আইবিএস, গ্যাস্ট্রিক, আলসারসহ নানা সাইকোসোমাটিক রোগের চিকিৎসায় মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম ও দমচর্চার পরামর্শ দিচ্ছেন। নিঃসন্দেহে তা আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। আরো ইতিবাচক সংবাদ হচ্ছে, এ দেশে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান মেডিটেশন চর্চাকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। 

তবে এটাই যথেষ্ট নয়। এখন দরকার সরকারের বাস্তব পরিকল্পনা। যদি আমাদের নীতিনির্ধারকরা মেডিটেশন চর্চায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন, নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করবে। তা একদিকে যেমন সুস্থ জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস পাবে উল্লেখযোগ্য হারে। 

২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। সবাইকে বিশ্ব মেডিটেশন দিবসের শুভেচ্ছা। 

শ্যামল আতিক: লেখক ও গবেষক

আরও