সময়ের ভাবনা

কুষ্ঠ ও কলেরা ফিরে আসছে, প্রতিকার কী?

পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব রোগ-ব্যাধি মানুষকে ভুগিয়েছে, সে রোগগুলোর পুনরাবৃত্তি কারো কাম্য নয়। কিন্তু অসচেতনতা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ফের রোগগুলো দেখা দিচ্ছে। এর প্রতিকারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি।

পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব রোগ-ব্যাধি মানুষকে ভুগিয়েছে, সে রোগগুলোর পুনরাবৃত্তি কারো কাম্য নয়। কিন্তু অসচেতনতা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ফের রোগগুলো দেখা দিচ্ছে। এর প্রতিকারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি।

অতীতে কুষ্ঠ, কলেরা, পক্স, পোলিওর মতো রোগ মানুষকে সীমাহীন যন্ত্রণা দিয়েছে। যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার ফলে নিয়ন্ত্রণে এলেও রোগগুলোর ফিরে আসা অস্বস্তিকর। এজন্য সচেতনতার বিকল্প নেই। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করলে দ্রুত নিরাময় সম্ভব হয়।

কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। মিসর, চীন, গ্রিস, রোম, ভারতসহ প্রায় সব দেশের ইতিকথায় এর বিবরণ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এ রোগের ইতিহাস চার হাজার বছরের পুরনো। এর সবচেয়ে পুরনো কংকালনির্ভর প্রমাণ মেলে ভারতবর্ষে, যা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের সময়কার। রোগটির সঙ্গে মানুষের পরিচয় কয়েক হাজার বছর আগের হলেও এর প্রকৃত কারণ এবং এর কোনো চিকিৎসাও তাদের জানা ছিল না। ফলে শতসহস্র বছর ধরে এ রোগকে কেন্দ্র করে চলে আসে নানাবিধ অলীক ধারণা ও কুসংস্কার, যার শিকার হয়ে নিপীড়িত, নিগৃহীত হয়েছে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। কোথাও এটাকে মনে করা হয়েছে স্রষ্টার অভিশাপ, কোথাও বা পাপাচারের ফল। এ রোগের কার্যকারণ বা প্রতিকারের বিষয়ে তেমন কিছু না জানলেও সবাই এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে এ রোগ ছোঁয়াচে। ফলে সমাজের স্বার্থপরতার বলি হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হতে হয়েছে অস্পৃশ্য, কোথাও সমাজচ্যুত, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাসিত।

সময়ের ফেরে দিন বদলেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে কুষ্ঠ রোগীর কারণ, এর উপসর্গ ও ক্রমধারা সম্পর্কে আমরা সম্যক ওয়াকিবহাল। এর কার্যকর চিকিৎসাও আয়ত্তে এসেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি শনাক্ত হলে কুষ্ঠ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য একটি রোগ।

যুক্তরাজ্যে রোগটি সেখানকার অধিবাসীদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। রোগটি বেশ ভোগালেও পরবর্তী সময়ে তা নির্ণয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা ও দক্ষ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে কুষ্ঠ রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। 

আমাদের দেশে বর্তমানে নয়টি জেলা কুষ্ঠ রোগের রেড জোনে রয়েছে। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে চা বাগান এলাকাতেই রয়েছে ৯০ শতাংশের ওপরে রোগী। নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে গাদাগাদি করে বসবাস ও সচেতনতার অভাবে চা শ্রমিকরা কুষ্ঠ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। হিড বাংলাদেশের তথ্যমতে মৌলভীবাজার সদর, জুড়ী, কুলাউড়া, বড়লেখা, রাজনগর, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা ২৪০ হলেও স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবমতে বর্তমানে এ জেলায় কুষ্ঠ রোগী রয়েছে ১২২ জন। গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৪। 

এ রোগে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীই প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে আসে না। অনেকেই একেবারে শেষ পর্যায়ে আসে। ফলে রোগীর ভোগান্তি বাড়ে।

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কুষ্ঠ নির্মূলে কর্মসূচি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা প্রতি ১০ হাজারে একজনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা সেই ১৯৯৮ সালেই অর্জিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কুষ্ঠ চিকিৎসার জন্য তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। এসব হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের জন্য জীবাণু নিরূপণ, স্কিন বায়োপসি, নার্ভ বায়োপসি ও অন্যান্য ইমিউনোলজিক্যাল পরীক্ষারও ব্যবস্থা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলো (এমটিডি) বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। তাই প্রাথমিকভাবে কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ পেলে দেরি না করে চিকিৎসা নেয়া উচিত।

বিশ্বে ফের কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত ১ থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত ১৩টি দেশে ৪০ হাজার ৫৬৩ জন শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তের পর মৃত্যু হয়েছে ৮১৮ জনের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, কলেরার প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের ৪৩টি দেশে ১০ কোটি মানুষ ঝুঁকিতে আছে। দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। ২০২২ সালে গত ৬০ বছরে ঢাকায় কলেরার প্রাদুর্ভাবে হাসপাতালগুলোয় রোগীর চাপ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এ বছরও কক্সবাজারে ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এর লঘু প্রাদুর্ভাব রয়েছে। একসময় কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। কলেরার বিস্তৃতির পেছনে জীবাণুবাহিত পানি পান ছিল সবচেয়ে বড় কারণ। সে যুগে গ্রামবাংলায় পুকুর ও নদীর পানির ওপরই নির্ভরতা ছিল। রোগের কারণ শনাক্তের পর মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চলতে থাকে। সচেতনতার পথ ধরেই কমে আসে কলেরার প্রাদুর্ভাব। গত বছর মূলত ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ ব্যবস্থার কারণেই এ প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২০১৯ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার ৯১ শতাংশ মানুষকে পানি ফুটিয়ে পান করতে হয় এবং এর জন্য বছরে প্রায় ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস পোড়ে। ঢাকার অনেক এলাকায় কলে হলুদ রঙের দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণত সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে পানি মিলে গেলেই এভাবে দূষিত হয়। পানির পাইপে ফুটো থাকার কারণে অথবা পুরনো ও পরিত্যক্ত পাইপগুলো বদলে নতুন পাইপ স্থাপনের সময় এ সমস্যা হতে পারে। আবার পানি সংকটে থাকা এলাকায় পাম্প থেকে সরাসরি পানি নিতে অবৈধ হোস পাইপ ব্যবহার করা হয়। এ পাইপগুলোয় প্রায়ই ছিদ্র থাকে, যেখান দিয়ে পানিতে জীবাণু মিশে যায়। এসব দেখভালের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে আবারো কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া কলেরা টিকা প্রদানের কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল, সেটি অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পেও সুপেয় পানি ও কলেরার টিকার ব্যবস্থা করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে কলেরার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য আক্রান্ত অঞ্চলগুলোয় টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কলেরার টিকা ব্যবহার করে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশে কলেরার টিকা গ্রহণের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম, যেমন নিরাপদ পানি ব্যবহার, নিরাপদ পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে।

সুস্থ শরীরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সবারই প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে জীবনযাপনে শৃঙ্খলা মেনে চলার বিকল্প নেই। অসুখবিসুখ কারোই কাম্য নয়। রোগ নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রোগ যদি শরীরে বাসা বেঁধেই ফেলে, তাহলে অবহেলা করা যাবে না। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেমন উচিত নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা, তেমনি সুস্থ জীবনযাপনের জন্য নাগরিকদেরও ভূমিকা রয়েছে। করোনা মহামারী ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের দুর্বলতার জায়গাগুলো দেখিয়ে দিয়ে গেছে, এমনকি টিকাস্বল্পতায় করোনার চতুর্থ ডোজ দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হলেও সেটি স্থগিত করতে হয়েছে। এজন্য সঠিক জরিপের আলোকে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিগুলো শনাক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে মহামারী মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত সক্ষমতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক

আরও