মেট্রোরেলে ঢিল ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে কোনো যাত্রী আহত না হলেও একটি গ্লাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে ১০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে একাধিক অজ্ঞাত ব্যক্তিকে। মেট্রোরেল প্রথমবার এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলো। ঠিক এমন সময়ে ঢিল ছোড়া হলো, যখন যাত্রীরা মেট্রোরেলের সার্ভিসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন এবং বিকালেও যাতায়াতের সুবিধা চাইছেন।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। চীনের সাংহাই মেট্রো, বেইজিং সাবওয়ে, গুয়াংজু মেট্রো, ইউহান মেট্রো, যুক্তরাজ্যের লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি সাবওয়ে, রাশিয়ার মস্কো মেট্রো, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল মেট্রো, স্পেনের মাদ্রিদ মেট্রো, জাপানের সাবওয়ে মেট্রোরেলেও ঢিল ছোড়ার নজির নেই। তাহলে ঢাকার মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে কেন এমন হলো সেটি অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছোড়া হয়। দুঃখজনক হলেও এটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পত্রিকায় এত সংবাদ প্রকাশের পরও এর পুনরাবৃত্তি বন্ধ হয় না। এমন দুর্বৃত্তপনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও থেমে থাকে না অজ্ঞাতরা। বস্তুত মেট্রোরেলে যেন এমন দুর্ঘটনা না ঘটে, সেজন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি এখনই নাগরিক সচেতনতা প্রয়োজন।
ট্রেনে ঢিল ছোড়ার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি স্পট শনাক্ত করেছে। কিন্তু জায়গাগুলো নির্জন হওয়ায় সেখানে পুলিশ থাকে না। রেলওয়ে পুলিশের সূত্রমতে, এ ঘটনায় জড়িতদের ৮০ ভাগই শিশু-কিশোর। যারা বিভিন্ন বস্তি এলাকায় বেড়ে উঠেছে। বস্তির এসব শিশুকে আটক করা হলেও বেশির ভাগ সময় মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। একবার সিলেটগামী ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করার ঘটনায় এক যুবককে আটক করা হয়েছিল। রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় ট্রেনে পাথর ছুড়লে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পাথর ছোড়ায় যদি কারো মৃত্যু হয়, তাহলে ৩০২ ধারায় দোষীর মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। তবে এ আইনে এখন পর্যন্ত কারো শাস্তির নজির পাওয়া যায়নি।
মেট্রোরেলে ঢিল ছোড়ার ঘটনায় অপরাধী শনাক্ত হলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ লাখ টাকার জরিমানা হতে পারে। এমনকি উভয় দণ্ড দেয়ার বিধানও রয়েছে।
মেট্রোরেল আইন ২০১৫-এর ৩৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি মেট্রোরেল এবং তার যাত্রীদের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায় অথবা বিঘ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড করে, তাহলে ওই ব্যক্তি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এ অপরাধে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এছাড়া মেট্রোরেল আইন ২০১৫-এর ৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন বা এ অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা দেন অথবা ষড়যন্ত্র করেন এবং এ ষড়যন্ত্র বা প্ররোচনার ফলে সংশ্লিষ্ট অপরাধটি সংঘটিত হয়, তাহলে এ সহায়তাকারী, ষড়যন্ত্রকারী বা প্ররোচনাদানকারী এ অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
এখন দেখার বিষয় যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা দক্ষ হাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে যেহেতু এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসরতদের তালিকা প্রণয়নসহ সতর্কতার বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তাতে আশা করা যায় যে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হবে না। তবে রেলের ঘটনার দিকটি সামনে রেখে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। তাছাড়া রেলের ক্ষেত্রে নির্জন জায়গায় ঢিল ছোড়া হয়, আর মেট্রোরেল ব্যস্ত শহরের মধ্য দিয়ে গেছে। তাই এক্ষেত্রে অপরাধী শনাক্ত সহজ হবে বিবেচনা করা হলেও মেট্রোরেলের লাইনের পাশেও মানুষের আনাগোনা কম এমন জায়গা রয়েছে, তাই মেট্রোরেল রক্ষণাবেক্ষণের নজরদারিতে কোনো ঘাটতি রাখা যাবে না।
মেট্রোরেল এখনো পূর্ণ অপারেশনে যেতে পারেনি, তার পরও দুটো রেলের মাধ্যমে প্রথম পর্বের নয়টি স্টেশনই চালু হয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে মেট্রোরেল আমাদের জন্য অনন্য মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং নাগরিকদের আন্তরিক সহযোগিতা। এ রেল চালু হওয়ার পর যাত্রীদের আনন্দ, উচ্ছ্বাসের রেশ দেখা গেছে। বিশেষ করে প্রচণ্ড জ্যামের এ নগরীতে মেট্রোরেল যেন স্বস্তির সুবাতাস প্রবাহিত করছে।
প্রথম দিকে টিকিট ও কার্ড নিয়ে সামান্য জটিলতা দেখা দিলেও প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ততার প্রভাবে সেটি বেশি দিন থাকেনি। দ্রুত যাতায়াতে সুবিধা হওয়ায় মেট্রোরেল ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনের অনুষঙ্গে পরিণত হচ্ছে। এ অবস্থায় মেট্রোরেলে যাতায়াত নিরাপদ হোক আমরা সে প্রত্যাশাই করি। এর আগেও মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক লাইনে ফানুস আটকে থাকার ঘটনা ঘটেছিল, তখন ২ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর মেট্রোরেল চালু করা হয়।
মেট্রোরেল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, এর রক্ষণাবেক্ষণে সবার ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে যেন ব্যত্যয় না ঘটে, সেজন্যই আইন করা হয়েছে। কিন্তু শুধু আইন দিয়ে মেট্রোরেল রক্ষা করা যাবে না, নাগরিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। মেট্রোরেলের বর্তমান রুট আরো সম্প্রসারণ হবে, তাই রেলওয়ের দুর্ভোগ যেন মেট্রোরেলের বেলায়ও না ঘটে সেজন্য সবার সতর্কতা প্রয়োজন।
ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা মহানগরীতে মেট্রোরেলকে যাত্রীবান্ধব হতে হবে। এজন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ভূমিকায় আমরা আশ্বস্ত হতে চাই। সেই সঙ্গে জনসেবার যে উদ্দেশ্যে এ রেল চালু হয়েছে, সেটিরও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কেননা এ রেল অবকাঠামো তৈরির সময় নগরবাসীকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে অলস বসে থাকা সে সময়ের কষ্টগুলো একদিন সার্থক হবে, এটিই নগরবাসীর প্রত্যাশা। দেশের যোগাযোগ খাতে নতুন দিনের সূচনা যে মেট্রোরেলের মাধ্যমে হয়েছে, সেটি যেন দুর্বৃত্তদের ছোড়া ঢিলে ম্লান হয়ে না যায় সেদিকে সবারই মনোযোগ প্রয়োজন। মেট্রোরেল ঢিল ছোড়ার জায়গা নয়, এটি একটি অপরাধ, এ মানবিক বোধ সবার মধ্যে জাগ্রত হওয়া জরুরি। এরই মধ্যে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো মেট্রোরেলের বেলায় ঘটেছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি না হোক, এটিই সচেতন নগরবাসীর কাম্য। শহরটা নির্বিঘ্ন যাতায়াতের উপযোগী হোক, এক্ষেত্রে গর্হিত অপরাধ যেন সংঘটিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য নাগরিকদের সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকার ও নাগরিকদের যৌথ ভূমিকার মাধ্যমেই নিরাপদ মেট্রোরেল নিশ্চিত করা যেতে পারে।
তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক