সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে থাকবে। অর্থাৎ মধ্যবর্তী পয়েন্ট হিসেবে ৪ শতাংশ ধরা হয়েছে। কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, নীতি অনিশ্চয়তার কারণে প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী হবে। এছাড়া নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের অভাব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা প্রবৃদ্ধিকে নিম্নমুখী করবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এক দশক ধরে বাংলাদেশে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের ওপর। কেবল নভেল করোনাভাইরাসের কারণে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে। সত্য যে অন্যান্য কারণের মধ্যে দুর্নীতি ও পুঁজি পাচার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। দুর্নীতি ও পুঁজি পাচার নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে গড় প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপরে থাকত। এক দশক ধরে দুর্নীতি ও পুঁজি পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান চোখে পড়ার মতো। এ দুই কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে না, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে প্রভাব পড়ছে প্রবৃদ্ধির ওপর। এরই মধ্যে কিছু কিছু দেশ পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র অর্থ পাচারকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সিঙ্গাপুরও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালিয়েছে। কানাডা সরকার বিদেশীদের বাড়ি ক্রয় নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় পুঁজি পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) আমানতের তথ্য প্রকাশ করছে। বিশ্বের যে কয়টা দেশ থেকে পুঁজি পাচার হয় তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। এ কারণে যে হারে প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা সে হারে হচ্ছে না। বলা প্রয়োজন যে ব্যাংক খাতের সুশাসনের ঘাটতি পুঁজি পাচারকে ত্বরান্বিত করছে। এ খাতে এখন খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকার ওপর। আইএমএফের তথ্য মোতাবেক খেলাপি ঋণ আরো বেশি। ব্যাংক খাত থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে। বিদেশে হোটেল, মোটেল কিনছে বাংলাদেশীরা।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির তথ্য মোতাবেক, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত অর্থাৎ ৪৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৭ লাখ ৯৮ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) তার গবেষণায় বলেছে যে বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়। জিএফআই আরো বলেছে যে বাংলাদেশের মোট বৈধ বাণিজ্যের মধ্যে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ মিথ্যা ইনভয়েসের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। জিএফআই প্রাক্কলন করেছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হবে। বিশ্বব্যাংক বলেছে যে অফশোর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতি বছর অর্থ পাচার হয় ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মতে, হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। পুঁজি পাচারের লক্ষ্য হলো আর্থিকসহ সব ধরনের অপরাধ লুকানো, কর ফাঁকি দেয়া, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন ও বিনিয়োগ নীতি লঙ্ঘন করা, অন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ, উন্নত দেশে নাগরিকত্ব লাভ, সেকেন্ড হোম প্রকল্প পুঁজি পাচারে উৎসাহিত করছে। দেশে আন্তর্জাতিক পণ্য বাণিজ্যে হুন্ডি হাওলার মাধ্যমে লেনদেনকৃত অর্থের পরিমাণ কমপক্ষে ১৫ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট’ কর্তৃক প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে এ পর্যন্ত অর্থ পাচারকারী হিসেবে ৮২ জন ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ হয়েছে। নাম প্রকাশ করা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা এসব ব্যবসায়ী কোনো তোয়াক্কা করেনি। সরকারের উচিত ছিল এ বিষয় নিয়ে তদন্ত করা। ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রিভেন্টিং মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কমব্যাটিং ফাইন্যান্সিং অব টেরোরিজম ২০১৯-২১ কৌশলপত্র থেকে জানা যায় বাংলাদেশ থেকে পুঁজি পাচারের ১০টি গন্তব্য। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের (সিএফএডিএস) তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কেনেন ৫৪৯ বাংলাদেশী। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয় করার তথ্য পাওয়া গেছে; যার মূল্য ৩১ কোটি ডলার। মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০৪ বাংলাদেশী সেকেন্ড হোম গড়েছেন মালয়েশিয়ায়। এ তথ্য প্রকাশ করেছেন দেশটির শিল্প ও সংস্কৃতিমন্ত্রী টিয়ং কিং সিং। এছাড়া বারমুডা, কেইম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো অফশোর বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দ্বীপ দেশগুলোয় বিপুল বিনিয়োগ বা পুঁজি পাচারের তথ্য বের হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে সম্পত্তির মালিকানা বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধিত প্রপার্টির সংখ্যা ছিল ১৫। ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ এবং ২০২১-এ বেড়ে প্রপার্টির সংখ্যা ১০৭-এ উন্নীত হয়। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটিতে বাংলাদেশীদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ। ২০২৩ সালে ১ কোটি ৭৭ লাখ ১২ হাজার সুইস ফ্রাঁ জমা হয়। সত্য যে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সূচকে বাংলাদেশ কখনো ভালো অবস্থানে ছিল না। রাজনৈতিক সরকার পুঁজি পাচারকারীদের তথ্য জানা সত্ত্বেও পাচারকারীদের অনুকূলে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করেছে। দলীয় বা রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বের করে বিদেশে পাচার করেছে, অট্টালিকা ক্রয় করেছে।
ব্যাসেল অ্যান্টি মানি লন্ডারিং সূচক ২০২৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান ৪৬; যা মোটেই সন্তোষজনক নয়। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক দ্য ব্যাসেল ইনস্টিটিউট অন গভর্ন্যান্স ১৫২ দেশের অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন ঝুঁকি নিরূপণ করে। মিয়ানমার, শাদ, কঙ্গো অর্থ পাচারে প্রথমদিকে অবস্থান করছে।
এখন পাচার হয়ে যাওয়া পুঁজি বা অর্থ ফেরত আনতে প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশের সহায়তা কামনা করছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে প্রধান করে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। জানি না কতটুকু ফলপ্রসূ হয়। দুঃখজনক যে বাংলাদেশে অর্থ পাচারসংক্রান্ত মামলা বা তদন্ত খুবই ধীরগতিতে চলে। ২০০৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত মামলা দাখিল করা হয় ৯৭৬টি। এর মধ্যে অনিষ্পন্ন হয় ৭৭৩টি। অর্থাৎ অর্থ পাচারের ৯৫ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) শুধু ঘুস ও দুর্নীতির মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থের টাকা পাচার অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে। বাকি ২৬টি অপরাধের দায়ভার দেখভাল করে অন্য সংস্থা। অর্থ পাচার, স্থানান্তর ও রূপান্তরকে ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ গণ্য করে ২০১২ সালে প্রথমে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণীত হয়। এরপর ২০১৫ সালে সরকার এটি সংশোধন করে গেজেট প্রকাশের পর থেকে দুদকসহ মোট পাঁচটি সংস্থা মামলা তদন্ত করার দায়িত্ব পায়। সংস্থাগুলো হলো দুদক, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। অন্তর্বর্তী সরকার পাচার হয়ে যাওয়া পুঁজি ফেরত আনতে অনেক তৎপর দেখা যাচ্ছে। তবে এ চেষ্টা কতটুকু সফল হবে জানি না। কারণ বাংলাদেশ এখনো পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদানের বৈশ্বিক কাঠামো ‘কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড’ (সিআরএস)-এ প্রবেশ করেনি। এখানে প্রবেশ করতে হলে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা জরুরি। এ মুহূর্তে কি আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে? না। বরং কীভাবে পুঁজি পাচার বন্ধ করা যায়, সেটা নিয়ে সরকার কাজ করতে পারে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে পারলে দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো। অর্থ ফেরত আনতে আমি বাধা দিচ্ছি না। কিন্তু সিআরএসে প্রবেশ করতে হবে অর্থ ফেরত আনতে। পুঁজি পাচার বন্ধ করতে না পারলে প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। অনেক লক্ষ্য অর্জন থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) ১৬.৪ নম্বর এর লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে অবৈধ আর্থিক ও অস্ত্রের প্রবাহ হ্রাস, চুরি হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার ও ফেরতের জোরদার চেষ্টা ও সব ধরনের সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। সুতরাং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে পুঁজি পাচার রোধ করতেই হবে।
মো. মাজেদুল হক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও অনারারি ডিরেক্টর (রিসার্চ), সেন্টার ফর ইস্ট এশিয়া ফাউন্ডেশন