বাংলাদেশ পুলিশ একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী। দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা তথা শান্তিরক্ষা, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে কার্যকর এবং জনগণের সেবা করাই এ বাহিনীর কাজ। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ পুলিশের জনবল, সুযোগ-সুবিধা ও কাঠামোগত উন্নয়ন সবই হয়েছে। তার পরও এ বাহিনী জনকল্যাণমুখী ও পেশাদার অভ্যন্তরীণ বাহিনী হয়ে উঠতে পারেনি। সেবার গুণগত মান বাড়েনি। ফলে আন্তর্জাতিক সূচকেও পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। বরং বিগত সময়ে পুলিশকে চাঁদাবাজি, ঘুস, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, মিথ্যা মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি-নির্যাতনসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে দেখা গেছে। জনকল্যাণের চেয়ে ক্ষমতাসীনদের তুষ্ট করতেই বেশি ব্যস্ত ছিল তারা। বিগত সরকারের আমলে পুলিশের হয়রানি-নির্যাতনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর। দেশে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলেও পুলিশকে কখনই এবারের মতো জনরোষের শিকার হতে হয়নি। সরকার, রাজনৈতিক দল ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করেছে এবং এখনো করতে চায়। সেবার গুণগত মান বাড়াতে এবং পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার, রাজনৈতিক দল ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে এ ধরনের অপপ্রয়াস থেকে পুলিশকে মুক্ত রাখতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করে এ বাহিনীকে আরো স্বায়ত্তশাসিত, স্বচ্ছ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক সূচকে ভালো করতে পুলিশকে সেবার মান বাড়াতে হবে এবং পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার বন্ধসহ কঠোর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশ নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। ঘুস, চাঁদাবাজি, নিরীহ মানুষকে হয়রানি ও মামলা না নেয়াসহ নানা অভিযোগ। আবার মামলা নিলেও তদন্ত ঠিকমতো করা হয় না। পুলিশের কাছে গেলে কোনো ঘটনার প্রতিকার তো পাওয়াই যায় না, উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তারা প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। আবার কোনো পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো কিছু ঘটলেই তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্তদের ‘ক্লোজড’, ‘সাময়িক বরখাস্ত’, ‘বদলি’, ‘বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ’ ইত্যাদির কথা শোনা যায়। কিন্তু এসব পদক্ষেপে বাস্তবে কী ঘটে তা আর কিছুই জানতে পারে না জনগণ। বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিতদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাবাস, অর্থদণ্ড, মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি হতে দেখা যায়। কিন্তু অপরাধী পুলিশের কী হয় সে বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। অর্থাৎ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে বারবার অপরাধে কম জড়াত।
পুলিশের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রসঙ্গ এলেই বরাবরই জনবল সংকট, বাজেটস্বল্পতা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু গত ১৫ বছরে (২০০৯-২৩) এ ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ সময়ে পুলিশে ৮৩ হাজার ৭০টি পদ সৃজন করা হয়েছে। ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য সৃষ্টি করা হয় উচ্চ পর্যায়ের ১৭৮টি পদ। এজন্য শিল্পাঞ্চল পুলিশ, অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিট, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) নামে পৃথক তিনটি ইউনিটও চালু করা হয়। গত দেড় দশকে পুলিশে নতুন নিয়োগ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুসারে, একই সময়ে বাহিনীটির জন্য বরাদ্দ বেড়েছে ৪৩৩ শতাংশের বেশি। ২০০৯-১০ অর্থবছরে পুলিশের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার কিছু বেশি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা ১৭ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ সময়ে পুলিশে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে অস্ত্র ও গোলাবারুদে। আগে ব্যবহৃত থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলের পরিবর্তে পুলিশকে দেয়া হয়েছে ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চাইনিজ রাইফেল। এছাড়া এ সময় এসএমজিসহ অত্যাধুনিক অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ যুক্ত হয়েছে। কিন্তু বিপুল বিনিয়োগ ও জনবল বৃদ্ধির পরও দক্ষতা ও সেবার মান বাড়েনি পুলিশের। উল্টো গত দেড় দশকে পুলিশের নানা কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিপীড়নমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে।
একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত পেশাদার বাহিনীগুলোর মধ্যে ক্রমেই অবনমন হয়েছে পুলিশের অবস্থানের। বিভিন্ন দেশের পুলিশের সেবামান নিয়ে সূচক তৈরি করে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন (আইপিএসএ)। বিশ্বের ১২৫ দেশের পুলিশ সেবার মান নিয়ে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড পুলিশ ইনডেক্স ২০২৩-এ বাংলাদেশ পুলিশের অবস্থান ১০০তম। সেবামানের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ছাড়া আর কোনো দেশের পুলিশ বাহিনী এত পিছিয়ে নেই।
বিগত সময়ে পুলিশের জন্য মন্ত্রণালয় যা চেয়েছে সরকার তা-ই দিয়েছে। এসব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরকার পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এসব সুবিধার বিনিময়ে সরকারের হয়ে কাজ করেছে পুলিশ। কিন্তু রাষ্ট্র কিংবা জনগণের কল্যাণে কাজ করতে দেখা যায়নি পুলিশকে। মানুষকে নানা হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই পুলিশের নিয়োগে এক স্তরের প্রথা ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশে তিন স্তরে চার ক্যাটাগরিতে সদস্য নিয়োগ করা হয়। মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ ও পদোন্নতি-পদায়ন নিশ্চিত করতে দুই স্তরের নিয়োগ প্রথা চালু করা প্রয়োজন।
১৮৬১ সালের ব্রিটিশ শাসনামলের আইনে বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। এ আইনের কোথাও পুলিশকে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বলা হয়নি। পুলিশ সেবা ও জনকল্যাণমুখী হিসেবে গড়ে তুলতে ১৮৬১ সালের নিয়ন্ত্রণকারী পুরনো আইনগুলোকে সংস্কার করে সময়োপযোগী করা দরকার। বিগত সরকারের শাসনামলে পুলিশ ও জনগণের যে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে তা কমিয়ে আনতে হবে। সেজন্য পুলিশকে জনবান্ধব হতে হবে। জনগণের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে হবে এবং মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। এসব বিষয় অর্জন করতে হবে কাজ দিয়ে, সেবা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যকে সব দল, মত, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখতে হবে।
পুলিশের শক্তি প্রয়োগ, মানবাধিকার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হলে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের শক্তি প্রয়োগের নীতিমালা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে, অর্থাৎ সর্বনিম্ন শক্তি প্রয়োগ, সমানুপাতিক হারে শক্তি প্রয়োগ, যৌক্তিক বা আইনসিদ্ধভাবে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এ শক্তি প্রয়োগের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘের শক্তি প্রয়োগের নীতিমালায় জবাবদিহির ক্ষেত্রে যারা শক্তি প্রয়োগ করছেন শুধু তারা নন, যারা পরিকল্পনাকারী, যিনি তার নির্দেশদাতা এবং প্রশিক্ষণ প্রদানকারীরাও এর দায় এড়াতে পারেন না।
জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকার ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। সংস্কারের মাধ্যমে আইনি কাঠামোসহ পুলিশি সেবা, সক্ষমতা ও ইতিবাচক ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। পুলিশের জন্য একটি কমিশন গঠন করে দিতে হবে। পুলিশ সদস্যদের বদলি, পদোন্নতি, নিয়োগ, কার্যক্রম পরিচালনা ও সঠিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। পুলিশকে সেবামুখী করতে এবং মামলা ও এর তদন্ত, গ্রেফতার এবং অভিযানসহ সব ক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনতে শক্ত কাঠামো তৈরি করতে হবে। এজন্য পুলিশসংক্রান্ত আইন ও বিধান যুগোপযোগী করতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পদোন্নতি ও পদায়নের জায়গাগুলোয় শতভাগ স্বচ্ছতা আনতে হবে। তাহলে পুলিশের সেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সূচকে উন্নতি ঘটবে।