গত ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আগস্টে দেশে মূল্যস্ফীতির হার প্রকাশ করেছে। এতে আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে, যা জুন ও জুলাইয়ে ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৭৪ ও ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়ালেও খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমাদের পাশের দেশগুলোসহ বিশ্বের অনেক দেশে যখন মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখী, তখন দেশে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী। মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হারে উল্লম্ফন মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন কেন মানুষের কাছে ভীতিকর তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
প্রথমে দেশে মূল্যস্ফীতি হারের বিপরীতে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোসহ বিশ্বের অনেক দেশে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি হার নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। চলতি বছরের আগস্টে বার্ষিক ভিত্তিতে ভারতে খুচরা মূল্যস্ফীতি কমে ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জুলাইয়ে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর এমন তথ্য প্রকাশ করেছে ভারত সরকার। অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতির হার গত দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম এক অংকের ঘরে নেমে এসেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ, যা চলতি বছরের জুলাইয়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে মর্মে দেশটির স্ট্যাটিস্টিকস ডিপার্টমেন্ট নিশ্চিত করেছে। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, আগস্টে এ হার ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জুনে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময় ছিল ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ব্যাংক অব থাইল্যান্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের কিছু ওপরে আটকে রাখতে সক্ষম হয় থাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছর আরো নিয়ন্ত্রিত অবস্থানে চলে এসেছে মূল্যস্ফীতি। ২০২৩ সাল শেষে থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতির হার আড়াই শতাংশে আটকে রাখার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে ১৪ জুলাই বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতির পর মূল্যস্ফীতিতে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে দুই বছরে সর্বনিম্ন হয়েছে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার। দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৩ দশমিক ২ শতাংশে। ২০২১ সালের মার্চের পর এ মূল্যস্ফীতি হার সর্বনিম্ন। যুক্তরাজ্যের সরকারি হিসাবের বরাত দিয়ে ১৬ আগস্ট আজকের পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার কমে ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার জুনের ৭ দশমিক ৯ থেকে কমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের মে মাসে যুক্তরাজ্যে বার্ষিক ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ (যুগান্তর, ২৩ জুন ২০২২)। কানাডার পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাবে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে কানাডায় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ২৭ শতাংশে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় চলতি বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৭ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়ার রিজার্ভ ব্যাংক গভর্নর ফিলিপ লোই আশা প্রকাশ করেছেন, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ৩ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসবে।
উপর্যুক্ত দেশগুলোসহ আরো অনেক দেশে যখন মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখী, তখন বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী। দেশে উচ্চহারে মূল্যস্ফীতির পেছনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—এক. সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের প্রধান প্রধান মুদ্রার বিপরীতে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকার মানের আরো অবনতি: গত ৩ সেপ্টেম্বর দ্য ডেইলি স্টার বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত টাকার বিপরীতে সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে সুইস ফ্রাঁর ২৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর পরই রয়েছে ইউরো (২৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ), পাউন্ড স্টার্লিং (২৪ দশমিক ৪ শতাংশ), সৌদি রিয়াল (১৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ), মার্কিন ডলার (১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ), অস্ট্রেলিয়ান ডলার (১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ), ভারতীয় রুপি (১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ), ইয়েন (১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ) এবং ইউয়ান (৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ)। টাকার মানের ক্রমাগত অবমূল্যায়নের জন্য যেসব ফ্যাক্টর দায়ী সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—ক. রেমিট্যান্সে কমতি, রপ্তানিতে শ্লথগতি। খ. হাই পাওয়ার্ড মানি সৃষ্টি করে (টাকা ছাপিয়ে) সরকারকে ঋণ প্রদান। গ. রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার। দুই. জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের তুলনায় খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হারে নিম্ন গতি। তিন. বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। চার. তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্তের অভাব।
এখন দেখা যাক, উপর্যুক্ত কারণে বাজারে খাদ্যপণ্যের দামে কী প্রভাব পড়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনি কিনতে ক্রেতার ৪০ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। প্রতি ডজন ডিম কিনতে বেশি খরচ হচ্ছে ২৪ টাকা। কেজিপ্রতি দেশী মুরগি ১০০ এবং ব্রয়লার মুরগি ১০ টাকা বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এছাড়া কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ৪৫, রসুন ১৮০, হলুদ ১৬০, আদা ২৮০ এবং মাছ ও গরুর মাংস ১০০ টাকা বেশি দাম দিয়ে ক্রেতার কিনতে হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকার খুচরা বাজারে যে পাঁচটি খাদ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সরকার খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি আলুর দাম ৩৫-৩৬ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তা বিক্রি হছে ৪৫-৫০ টাকায়। সরকার নির্ধারিত এক হালি ডিমের দাম ৪৮ টাকা, আর বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। সরকার নির্ধারিত ৬৪-৬৫ টাকার পরিবর্তে এক কেজি দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায়। এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরকার নির্ধারিত দাম ১৬৯ টাকা হলেও তা বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৭৪ টাকায়। সরকার এক কেজি খোলা চিনির দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তা বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪০ টাকায়। দেশের শতকরা ৭০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের ভাত। টিসিবির তথ্যে দেখা যায়, গত ২২ সেপ্টেম্বর এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৪৮-৫০ টাকা। তবে পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৫২-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ২০২০ সালের জানুয়ারিতে খুচরা বাজারে সাধারণ মানের (মোটা চাল) প্রতি কেজি চালের গড় দাম ছিল ৩২ টাকার কিছু বেশি (বণিক বার্তা, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। টিসিবির দাম হিসাবে নিলেও ২০২০ সালের তুলনায় মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন কেন ভীতিকর তা নিয়ে আলোকপাত করা যাক। জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোর শীর্ষে অবস্থান খাদ্যের। আবার খাদ্যের বেশ কয়েকটি উপাদান থাকলেও দেশে খাদ্য বলতে মূলত চাল থেকে তৈরি ভাতকে বোঝায়। ভাত দেশের কমবেশি ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য। ভাত আমাদের ক্যালরির প্রধান উৎস। গত প্রায় দুই যুগে চালের দাম বেড়েছে চার-পাঁচ গুণ। একাধিক কারণে চালের উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের জীবনে ভীতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক. বিবিএসের হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। আবার মাসিক মোট খরচের ৩৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কেনায়। তাই চালের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে। দুই. চালের, বিশেষ করে মোটা চালের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব ওই চালের সব শ্রেণীর ভোক্তার ওপর পড়লেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। তিন. শুধু নিম্ন আয়ের মানুষ নয়, চালের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। চালের মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফনে মধ্যবিত্তদের মাছ-মাংস, ডিমসহ আমিষজাতীয় খাবার কেনা কমিয়ে দিতে হচ্ছে। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও মহিলাদের পুষ্টির অভাব ঘটছে। চাল ছাড়াও অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফনের বর্ণনা আগেই দেয়া হয়েছে।
এদিকে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার (১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ) যখন গত সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, তখন মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতি হারের অনেক নিচে। মজুরি বৃদ্ধির হার মাত্র ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ (যুগান্তর, ৮ সেপ্টেম্বর)।
ওপরের আলোচনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, দেশে মূল্যস্ফীতির হার, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির রেকর্ড হার হ্রাসে সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সার্বিক মূল্যস্ফীতিসহ খাদ্যপণ্যের রেকর্ড মূল্যস্ফীতি কমানো না গেলে সমাজে শ্রেণীবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটতে পারে। অর্থাৎ মধ্যবিত্তের নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তের দরিদ্র এবং দরিদ্রের অতিদরিদ্র স্তরে নেমে আসার জোর সম্ভাবনা থেকে যাবে। এতে দেশে দারিদ্র্যহার বেড়ে যাবে।
মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব