বিপুল বিনিয়োগেও সাফল্য আসেনি

ঢাকার পানগাঁও আইসিটিকে ব্যবসায়ীবান্ধব করতে পদক্ষেপ নেয়া হোক

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা কনটেইনারবাহী পণ্যের ৭০ শতাংশের গন্তব্যস্থল ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চল। এর বড় অংশই পরিবাহিত হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহার করেই।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা কনটেইনারবাহী পণ্যের ৭০ শতাংশের গন্তব্যস্থল ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চল। এর বড় অংশই পরিবাহিত হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহার করেই। ফলে এটি ব্যস্ততম মহাসড়কে পরিণত হয়েছে। এ মহাসড়কের ওপর চাপ কমাতে ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ টার্মিনাল নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম বন্দরে আসা কনটেইনারের পণ্য নদীপথে পরিবহন করা। ঢাকা ও আশপাশের শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় ও সময় সাশ্রয় করে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমকে সহজতর করা, ছোট ছোট জাহাজে করে কনটেইনার পরিবহন করা, পরিবেশবান্ধব হিসেবে নদীপথে কনটেইনার পরিবহনকে জনপ্রিয় করে তোলা ও বন্দর সুবিধাকে আমদানি-রফতানিকারকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। পানগাঁও আইসিটিতে আছে আমদানি-রফতানি পণ্য খালাস-বোঝাইয়ের সব সুযোগ-সুবিধা। সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহের কারণে টার্মিনালটির কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতার একটি বড় অংশই অব্যবহৃত থাকছে। নানা প্রতিবন্ধকতায় এ টার্মিনালকে ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় করা যায়নি। টার্মিনাল চালুর এক যুগ পরও পরিবেশবান্ধব এ নদীপথকে জনপ্রিয় করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। টার্মিনালটি নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেও মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কমানো যায়নি। পরিবেশবান্ধব এ নদীপথকে ব্যবহার করতে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা নিরসন করা অতীব জরুরি। পানগাঁও আইসিটিকে ব্যবসায়ীদের ব্যবহারের উপযোগী করতে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

২০২২ সালে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয় জাহাজ ভাড়া নির্ধারণসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন। এ প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে থাকা পানগাঁও আইসিটিতে পণ্য পরিবহন কমতে থাকে। দুটি কারণেই ব্যবসায়ীরা টার্মিনালটি ব্যবহার করছেন না বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে কনটেইনারে পণ্য আনা-নেয়ার জন্য সড়ক ও রেলপথের চেয়ে বেশি খরচ পড়ছে এ নৌপথে। এছাড়া চট্টগ্রাম-পানগাঁও নৌপথে নিয়মিত কনটেইনার জাহাজ না চালানোর কারণে নৌপথে সময়ও লাগে বেশি। বণিক বার্তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাপান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যবাহী কনটেইনার আনতে ১ হাজার ২০০ ডলার ব্যয় হয়। অথচ চট্টগ্রাম থেকে পানগাঁও টার্মিনালে কনটেইনার আনতে হাজার ডলারের প্রয়োজন হয়। সময় ও খরচ বেশি হওয়ায় টার্মিনাল ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কমছে। এ কারণে তারা চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমেই পণ্য আমদানি করেন। খরচ বেশি হওয়ায় পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে শিপিং এজেন্টরা তাদের রাউটিং নেটওয়ার্কে পণ্য ডেলিভারির জন্য পানগাঁও আইসিটিকে ডেস্টিনেশন হিসেবে উল্লেখ করেন না।

ঢাকার পানগাঁওয়ে প্রায় ৩২ একর জায়গার ওপর সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ টার্মিনাল চালু হয় ২০১৩ সালের শেষের দিকে। বছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ১ লাখ ১৬ হাজারটি। চলতি বছরের ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) মাত্র ১৭টি জাহাজ গেছে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালে। আর কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২ হাজার ১৫০ একক। অথচ গত বছরের একই সময়ে পানগাঁও আইসিটিতে ১৪২টি জাহাজ ভিড়েছিল। তখন ১০ মাসে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ২৮ হাজার ৪৪৪ একক। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমেছে ৯২ শতাংশ। টার্মিনালটির সক্ষমতার বড় অংশই অব্যবহৃত থাকায় সড়কপথের ওপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। ফলে এ মহাসড়কে যানজট বাড়ছে। সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিবেশবান্ধব এ নৌপথের টার্মিনাল নির্মাণের মূল্য উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে।

টার্মিনাল নির্মাণে বিপুল বিনিয়োগ হলেও ব্যবসায়ীদের কোনো কাজে আসছে না। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহনে নৌপথকে জনপ্রিয় করতে সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। সড়ক ও রেলপথের চেয়ে সময় ও খরচ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা টার্মিনালটি ব্যবহারে অনাগ্রহী। এ কারণে সক্ষমতার বড় অংশই এখনো অব্যবহৃত থাকছে। এ অবস্থায় পণ্য পরিবহনে মহাসড়কে চাপ না কমায় প্রকল্পটি নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যই অর্জন সম্ভব হয়নি।

এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন হয়েছে ৬ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার। এর বড় অংশই ব্যয় হয়েছে তুলা আমদানিতে। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি করা কাঁচা তুলা ও মেশিনারিজের একটি নির্ধারিত পরিমাণ পানগাঁও আইসিটিতে খালাসের জন্য ২০১৫ সালের একটি সরকারি আদেশ রয়েছে। কিন্তু সেটিও যথাযথ মানা হচ্ছে না।

এ প্রকল্প ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় করা সম্ভব। এজন্য দরকার সঠিক নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। কাস্টমস পলিসিতে সংস্কার আনতে হবে। আন্তর্জাতিক ভেন্ডরদের ওয়্যারহাউজ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে পানগাঁও রুটটি দ্রুত লাভজনক ও জনপ্রিয় করা সম্ভব। সরকারকে জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। ভাড়াসংক্রান্ত যে প্রজ্ঞাপন রয়েছে তা বাতিল করে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ভাড়া নির্ধারণের সুযোগ দিতে হবে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পর আমদানিকারকরা যাতে রাউটিং নেটওয়ার্কে পানগাঁও আইসিটিকে ডেস্টিনেশন হিসেবে উল্লেখ করেন সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে মন্ত্রণালয়কে। পরিবেশবান্ধব এ নৌপথ ব্যবহারে ব্যবসায়ীরা উদ্বুদ্ধ হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কমবে। পরিবেশ দূষণও অনেকাংশে কমে আসবে।

আরও