রাজার নতুন পোশাক ও কোমলমতি ছাত্রদের আন্দোলন

‘রাজার নতুন পোশাক’ গল্পটি সম্ভবত অনেকেরই জানা। একদল বাটপার তাঁতি সেজে যন্ত্রপাতি নিয়ে এক নতুন রাজ্যে প্রবেশ করে রাজাকে বলল যে, তারা এত মসৃণ, সূক্ষ্ম ও উন্নত মানের কাপড় তৈরি করতে পারে যা চোখেই দেখা যায় না। কৌতূহলী হয়ে রাজা তা বানানোর নির্দেশ দিলেন।

রাজার নতুন পোশাকগল্পটি সম্ভবত অনেকেরই জানা। একদল বাটপার তাঁতি সেজে যন্ত্রপাতি নিয়ে এক নতুন রাজ্যে প্রবেশ করে রাজাকে বলল যে, তারা এত মসৃণ, সূক্ষ্ম ও উন্নত মানের কাপড় তৈরি করতে পারে যা চোখেই দেখা যায় না। কৌতূহলী হয়ে রাজা তা বানানোর নির্দেশ দিলেন। আদেশ পেয়ে বাটপারের দল বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে এমনভাবে রাত-দিন কাজ করার ভান করছিল যেন সত্যি সত্যি তারা কিছু বানাচ্ছে। এরপর সেই কল্পিত পোশাক বানানো শেষ হলে বাটপারের দল বিশাল আয়োজন করে রাজাকে সেই নতুন পোশাক পরানোর চমৎকার অভিনয় করল। রাজা খুশি হয়ে মোটা অংকের টাকা বকশিস দিলেন আর তা নিয়ে বাটপাররা সটকে পরল।

আশপাশের লোকজন আসলে কিছুই দেখছিল না এবং বাস্তবে রাজার পরনে আসলেই কোনো কাপড় ছিল না। অর্থাৎ রাজা ছিলেন ন্যাংটো। কিন্তু চাটুকার সভাসদরা কিছুই বলতে পারছিলেন না। পাছে রাজা অখুশি হন কিংবা অন্যরা মনে করেন যে তিনি একটি অতি সুন্দর পোশাক দেখতে পাচ্ছেন না। বরং তারা রাজার এ মূল্যবান ও সূক্ষ্ম নতুন পোশাকের ব্যাপক গুণগান বর্ণনা করে রাজাকে মাতিয়ে রাখলেন। শুধু তা-ই নয়, জনসমক্ষে তা প্রদর্শনের জন্য একটি পথযাত্রার আয়োজন করলেন। দুপাশে হাজারো জনতার মাঝ দিয়ে রাজা যখন যাচ্ছিলেন, মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে তারা রাজার সেই নতুন পোশাকের তারিফ করতে থাকলেন।

রাজার এ নতুন পোশাকের খবর শুনে একটি নাবালক শিশুও ভিড় ঠেলে রাজাকে দেখতে এল। কিন্তু রাজাকে দেখে সে চিৎকার করে বলে উঠল, কোথায় রাজার নতুন পোশাক, রাজা তো ন্যাংটো

গল্পটি বহুদিন আগের। সেই রাজরাজাদের আমলের। কিন্তু বর্তমানের আলোকে এটি এখনো সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক যে বরাবরের মতো এখনো রাজ-রাজারা চাটুকার তথা চামচা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন। ঠক-বাটপাররা সুবিধা নেন। সভাসদরা কখনই রাজাকে আসল সত্যটি বলেন না বা বলতে সাহস পান না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষায় তারা সেই চাটার দল। আর সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী যখন মুখ ফসকে কাউকে রাজাকারের বাচ্চাবলে গালি দেন, ‘বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ’-এর মতো চাটুকাররা তক্ষুণি গবেষণায় নেমে পড়ে এবং আবিষ্কার করেন যে এঁদের শুধু বাপ-দাদাই রাজাকার নয়, বরং প্রপ্রিতামহ তথা পূর্বপুরুষও আসলে মীরজাফরের বংশধর। এক আধা-পাগলসাবেক বিচারপতি টকশোতে ঘোষণাই দিলেন যে এ আন্দোলনকারীদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। প্রতিপক্ষের বক্তা অবশ্য আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এ মুহূর্তে তার বরং নিজেরই ভারতে পালানোর আয়োজন করা উচিত। আরেক মহিলা চামচা টকশোতে বোমা ফাটালেন এই বলে যে, উদয়ন স্কুলের ছাত্রদের নাকি মিছিলে যেতে টাকা দেয়া হচ্ছে! এতদিন জানতাম টোকাইদের টাকা দিয়ে মিছিলে নেয়া হয়। অথচ উদয়নে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ছেলেমেয়েরা!

এসব আসলে তারা করেন এজন্য যে সম্ভবত তারা তাদের নেতাকে মানুষ নন, বরং দেবতার অবতার মনে করেন। ফলে সংগত কারণেই তার তো কোনো ভুল হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তার কথা না মানা তো রীতিমতো ঈমানহানির মতো। তা না হলে মানুষ মাত্রই ভুলএ আপ্ত বাক্যটি মেনে নিয়ে তারা বিপদের সময় নেতার ভুল শুধরে দিয়ে ভালো পরামর্শ দিতেন। কিন্তু চাটুকারের বৈশিষ্ট্য এটি নয়। কুপরামর্শ দেয়া তাদের কাজ এবং এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে বিপদ আরো বাড়লে শেষবেলায় বিমানের টিকিট কেটে পালান তারা।

তবে শুনেছি নেতারও নাকি এ ধরনের বিশ্বাস। আর এজন্যই তিনি চোখের জল ফেলে বার বার প্রশ্ন করছিলেন তার কি দোষ? এত প্রাণ কেন ঝরল?’। তার মানে, তিনি কিছু বলেননি এবং করেননি। কারণ তিনি মানুষ নন এবং তার ভুল হওয়ার কথা নয়।

চাটুকার পরিবেষ্টিত এ রাজাদের সমস্যা হয় তখনই, যখন কোনো নিষ্পাপ নাবালকের খপ্পরে পড়েন। আসল পোশাক তখন উন্মোচিত হয়ে পড়ে। তারা রাখঢাক বা চৌর্যবৃত্তিতে অভ্যস্ত নয়। যা দেখে, সত্য বলে জানে, তা-ই বলে, প্রতিবাদ করে। নিজের প্রাণ পর্যন্ত দেয়। বাংলাদেশের ইতিহাসও এ গৌরবময় ছাত্র আন্দোলনেরই ইতিহাস। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—এ সবই ছাত্রদের নেতৃত্বে হয়েছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে প্যালেস্টাইনে গণহত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এ গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, অথচ তার ছাত্ররা ঠিকই দুর্বার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।

এত ইতিহাস চোখের সামনে থাকার পরও কীভাবে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর সাহস হয়? কুপরামর্শ যে শুধু এ ছাত্র আন্দোলন ঘিরে, তা-ই নয়। এর শুরু অনেক আগে এবং শুধু দেশে নয়, বিদেশ থেকেও এসেছে। সরকার প্রায়শই তার একটি সবল দিক নিয়ে জোর প্রচারণা চালান। তা হচ্ছে উন্নয়ন। হ্যাঁ তা অবশ্যই একটি সবল দিকে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেশে হয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। খোদ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা লজ্জিত হয়েছেন বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে। যদি তা-ই হয়, তাহলে একটি ভালো নির্বাচন করতে তার ভয় কোথায় ছিল? জনগণ তো তার পাশে থাকার কথা। দেশের জনগণের ওপর কি তাহলে তার আস্থা নেই? সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি চমৎকার পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথাটি ভেঙে অবৈধভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার আয়োজনের কী প্রয়োজন ছিল? একবার নয় হেরে জেতেন, আরেকবার জিততেন।

আফসোস তারা উন্নয়নের জন্য সিঙ্গাপুরের লি কিউয়ান বা নিদেনপক্ষে মাহাথিরের পথ ধরতে পারতেন। তা না হয়ে এখন চসেস্কু কিংবা মার্কোসের পরিণতি বরণের দিকে যাচ্ছেন। যদি বিন্দুমাত্র বোধোদয় হয় তাহলে এখনই একটি সমাধানে আসুন। উন্নত দেশে জরিপে নিজের জনপ্রিয়তা কমে গেলে নতুন নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছাড়ার নজির আছে। এত রক্তক্ষয়ের পর, এখনো ক্ষমতা ধরে রাখার কোনো অর্থ হয় না। বিরোধীদের উচিত এ সন্ধিক্ষণে হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি ভালোভাবে সম্পন্ন করার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করা। অন্যথায় রক্তক্ষয় বাড়তেই থাকবে।

মো. সিরাজুল ইসলাম: অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও