পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে মানুষ, কিছু মরদেহ চেনারও উপায় নেই। স্বজনদের হাহাকার, কত স্বপ্নের মৃত্যু। এভাবেই একেকটি অগ্নিকাণ্ডের পর অদৃশ্য বাস্তবতা মূর্ত হয়ে ওঠে। অথচ চোখের সামনেই এসব ভবনে দিব্যি মানুষের কর্মব্যস্ততা চলমান রয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের পর বের হয়ে আসে প্রকৃত কারণ। তার আগে সবকিছু যেন অবহেলার পাত্র, নগদ অর্থই এখানে মুখ্য। ভবনের অনুমোদন নেই, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের সরবরাহ ছিল না—এমন অভিযোগ আগুন লাগার পর জানা যায়।
এর যেন কোনো সমাধান নেই। নগরবাসীর জীবনে বিভীষিকাময় দুঃসহ স্মৃতি এনে দেয়ার জন্য এ রকম দুর্ঘটনাগুলোই যথেষ্ট। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার কষ্ট সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হলে যে সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হয়, এমন জীবন্মৃত অবস্থায় যারা পৌঁছেন তারাই এর ভয়াবহতা বুঝতে পারেন।
বস্তুত আগুনের সঙ্গেই আমাদের বসবাস। সভ্যতার বিকাশে আগুন আবিষ্কারের পর এটি আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারণ আগুনের যে দাহ্যশক্তি রয়েছে, তা নিমিষেই বড় অগ্ণিকাণ্ডের সূচনা করতে সক্ষম।
আমাদের জীবনধারণের জন্য রান্নায় আগুনের ব্যবহারে গ্যাসের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্তমানে রান্নার কাজে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। যে কারণে ২০০৯ সালের ২১ এপ্রিল থেকে সারা দেশে নতুন আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধের নির্দেশ দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ। মাঝে এ নির্দেশ থেকে সরে এলেও ২০২০ সালের ২১ মে আনুষ্ঠানিকভাবে তিতাসসহ সব ক’টি গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানকে আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং সিএনজির নতুন সংযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয় জ্বালানি বিভাগ।
বর্তমানে বাসাবাড়িতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ স্থায়ীভাবে বন্ধ রয়েছে। এজন্য রান্নায় তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ব্যবহার বেড়েছে। এলপিজি সিলিন্ডারের মাধ্যমে এ গ্যাস সরবরাহ হয়। সিএনজিচালিত গাড়ি ও অটোরিকশাতেও সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে যে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা অবহেলিতই রয়ে যায়। যে কারণে প্রায়ই সংবাদ প্রকাশ হয় যে রাস্তায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে গাড়িতে আগুন।
এই তো গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে সিম কার্ড তৈরির কারখানায় নাইট্রোজেন গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একজন নিহত ও চীনা নাগরিকসহ আরো ছয়জন আহত হন। সর্বশেষ বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডেও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণকে দায়ী করা হচ্ছে।
অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি ঘাঁটলে দেখা যায়, পুরনো ঢাকায় ২০১০ সালে নিমতলীতে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয় ১২৪ তাজা প্রাণ, আর ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় ৭১ জন। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ট্যাম্পাকো ফয়েলসের কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু হয় ৪১ জনের। নিমতলী ও চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরও আবাসিক ভবন থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরানো সম্ভব হয়নি। সে ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে আরমানিটোলায় আগুনের ঘটনায় পাঁচজন মারা যায়।
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর এফআর টাওয়ারের আগুনে ২৭ জন নিহত হয়। ২০২১ সালে রূপগঞ্জে হাশেম ফুড বেভারেজ কোম্পানির জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় ৫২ জন।
গত বছরও আগুনের লেলিহান শিখা দেখেছে নগরবাসী। ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার মার্কেট আগুন লেগে পুড়ে যায়। কিছুদিন পর ১৫ এপ্রিল রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে।
এসব উল্লেখযোগ্য অগ্ণিকাণ্ড শেষে তদন্তে প্রকৃত কারণগুলো উঠে আসে। এফআর টাওয়ার ভবন নির্মাণে নানা অনিয়মের বিষয় জানা যায়। রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ বিপণিবিতানই ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বলা হয়।
সর্বশেষ বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জানা যায়, ভবনটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নির্ধারিত শর্ত অমান্য করে ওই ভবনে কমপক্ষে সাতটি রেস্তোরাঁ ব্যবসা করছিল। ভবনটিতে কোনো জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি ছিল না। এমনকি স্থপতিদের সূত্রে জানা যায়, এ ভবনগুলোর জন্য আটটি সরকারি সংস্থার অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে এসব অনুমোদন কীভাবে মিলেছিল, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাহলে চাইলেই ভবনে অনুমোদন ছাড়া রেস্তোরাঁর ব্যবসা করা যায়? তরুণ প্রজন্মের চেক ইন আর চিল করার জায়গা এতটাই অনিরাপদ? শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য ভবনগুলো বিস্ফোরণের উপযোগী করে রাখা হয়েছে। এ দায় কার? কেউ কেউ আহ্বান জানাচ্ছে ফুড ব্লগারদের রেস্তোরাঁর অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব তাহলে কী?
২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর পার্শ্ববর্তী একটি অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ছাদের ওপর থাকা ক্যান্টিন বন্ধ করে দিয়েছিল রাজউক। হালে জনপ্রিয়তা পাওয়া রুফটপ রেস্তোরাঁগুলো তাহলে কি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে করা হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে এখনই সর্বোত্তম সময়। কারণ এখন রাজধানীজুড়ে রেস্তোরাঁগুলোয় অভিযান চালানো হচ্ছে। এখনই জানা যাবে আগুন লাগা ও দ্রুত আগুন নেভাতে না পারার প্রকৃত কারণ। তবে জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে যাওয়ার পর উত্তর পেলে তখন এর ভুক্তভোগীই সর্বোচ্চ কষ্ট পাবেন। তাই শুধু আগুন লাগার পর অভিযান নয়, বরং সারা বছরই ভবনের অনুমোদন পেতে সরকারি সংস্থাগুলোর স্বচ্ছতা বজায় রাখা প্রয়োজন। কারণ জীবনের দাম অনেক বেশি, যা টাকার অংকে কেনা যায় না। প্রতিটি মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার রাখে। আগুনে পুড়ে মরার এ বীভৎস অধ্যায়ের দ্রুত সমাপ্তি ঘটুক, সেটিই সবার প্রত্যাশা।
তৌফিকুল ইসলাম: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা