সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে আমাদের শিক্ষাঙ্গন তথা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত কি উচিত নয়, সে বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে এক ধরনের আলাপ লক্ষ করছি। অনেকে নব্বই-পরবর্তী সন্ত্রাসনির্ভর লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে, বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরের অধিক সময়ের আওয়ামী লীগ শাসনামলে দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নজিরবিহীন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বপ্রকার ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিচ্ছেন।
আবার সচেতন নাগরিক ও ছাত্র সমাজের একটি বড় অংশ; ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সদ্য ঘটে যাওয়া চব্বিশের জেন-জি রেভল্যুশনে ছাত্রদের অপরিসীম অবদানকে সামনে এনে; অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার আদর্শবাদী ছাত্ররাজনীতির ধারা চালু থাকা প্রয়োজন বলে মনে করছেন। আমিও মনে করি সমাজ ও রাষ্ট্রে সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ এবং জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আদর্শবাদী ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন তো ফুরায়ইনি বরং সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দালনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সংস্কার ও সুশাসন নিশ্চিতে এর প্রাসঙ্গিকতা আরো বেশি করে প্রতিভাত হচ্ছে।
তাই আমার অভিমত হলো ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্ররাজনীতি হোক ছাত্র সংসদকে কেন্দ্র করে, প্রধানত ছাত্রদের বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট তথা নানা অভাব-অভিযোগ ও সুযোগ-সুবিধার নিরিখে। যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের নিয়মিত ও বৈধ ছাত্ররা ছাত্রদের অধিকার ও স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নামে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন গড়ে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। যাতে কোনোভাবেই জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো লেজুড়বৃত্তিক সংস্রব থাকবে না। এরা কোনো পর্যায়েই সংশ্লিষ্ট জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো পদে থাকতে পারবে না। জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে তারা মতামত প্রদান বা জনমত গঠনে ভূমিকা রাখলেও তাদের মূল রাজনীতি হবে সারা দেশের ছাত্র সমাজের বিভিন্ন অধিকার আদায়, শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন, শিক্ষা কারিকুলাম ও পঠন-পাঠন নিয়ে ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি-দাওয়ানির্ভর।
ছাত্ররাজনীতির এ নবতর ধারাকে বোঝার জন্য উদাহরণস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় জাতীয়তাবাদী আদর্শের নিয়মিত ছাত্ররা National Students Forum বামপন্থী ভাবাদর্শের নিয়মিত ছাত্ররা"প্রগতিশীল ছাত্র সম্মিলন, ইসলামপন্থী মতাদর্শের নিয়মিত ছাত্ররা"ইনসাফ ছাত্র আন্দোলন, উদারপন্থী গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার নিয়মিত ছাত্ররা Liberal Students Rally, হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষা সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছাত্ররা ‘সনাতনী ছাত্র জোট’, সমতল বা পাহাড়ের ছাত্রদের সংগঠন হিসেবে ‘পার্বত্য বা আদিবাসী ছাত্র ব্লক’ এমনকি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী নিয়মিত ছাত্ররা যাদের বিরুদ্ধে অতীতে ছাত্রলীগের হয়ে কোনো সহিংসতায় জড়িত হওয়ার রেকর্ড নেই তাদেরও United Students Force নামে ছাত্রসংগঠন গড়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।
তবে ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সংঘাতমুক্ত হতে হবে। নির্বাচনে যাতে কোনোভাবেই প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ না থাকে এবং পেশিশক্তি বা সন্ত্রাসের দাপট নির্বাচনের পরিবেশ ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে ম্লান করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মোদ্দা কথা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে নির্বাচনের ফল ঘোষণা পর্যন্ত পুরো নির্বাচনী পরিবেশ এত নির্ঝঞ্ঝাট, সৌহার্দ ও শান্তিপূর্ণ রাখতে হবে যাতে সব পক্ষ ভোটের ফল মেনে নেয় এবং পরাজিত পক্ষ বিজয়ী পক্ষকে অভিনন্দন জানায়। এভাবে একটি আদর্শ ছাত্র সংসদ নির্বাচন যাতে ভবিষ্যৎ জাতীয় নির্বাচনের ছায়া হয়ে ওঠে।
কারণ ছাত্র সংসদকেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই মেধাবীদের ছাত্ররাজনীতিতে নিয়ে আসার নিয়মতান্ত্রিক পাইপলাইন চালু করার মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব। তাই গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও টেকসই সুশাসনের জন্য অবশ্যই ছাত্র সংসদকেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন আছে। সুতরাং যারা যেকোনো ফর্মে ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আলাপ নিয়ে হাজির হচ্ছে, তারা না বুঝেই বিরাজনৈতিকীকরণ ও সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আমাদের গর্বের জেন-জি প্রজন্মের অসাধারণ রাজনীতি সচেতনতাকে খাটো করছে।
মনজুর এরশাদ খানঃ শিক্ষক, লেখক ও সমাজ কর্মী