বিপর্যয়ের মুখে এসএমই খাত

এসএমই খাত রক্ষার্থে প্রণোদনা ও ঋণপ্রবাহ বাড়ানো হোক

দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত ও এর উদ্যোক্তাদের প্রতিনিয়ত নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। তবে প্রধান সমস্যা হচ্ছে অর্থায়ন সংকট, বিশেষ করে ঋণপ্রাপ্তি। উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যৎসামান্য ঋণ পান।

দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত ও এর উদ্যোক্তাদের প্রতিনিয়ত নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। তবে প্রধান সমস্যা হচ্ছে অর্থায়ন সংকট, বিশেষ করে ঋণপ্রাপ্তি। উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যৎসামান্য ঋণ পান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিছু ব্যাংক এক্ষেত্রে উদার নীতি অনুসরণ করলেও বেশির ভাগই তাদের অর্থায়ন করতে চায় না। উপরন্তু যোগ হয়েছে বাড়তি সুদের হার এবং বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যা।

বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এ বছর তিন ধাপে দেশের প্রায় অর্ধেক জেলা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হওয়া জেলাগুলো হলো ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারী। এসব জেলা ছাড়াও বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদের কৃষি, ফল-ফসল ও প্রাণিসম্পদসহ ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসএমই খাত। এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন ব্যাংক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়েছে। আবার সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। একই সঙ্গে গ্রাহকদের জমাকৃত আমানতও চাহিদা অনুযায়ী ফেরত দিতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে অর্থ সংকটে পড়েছে দেশের এসএমই খাত। ব্যাংক ঋণবঞ্চিত হওয়ায় এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে। সচল থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়া দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ায় নতুন করে ঋণ গ্রহণে নিরুৎসাহিত হচ্ছে এ খাতের উদ্যোক্তারা। এতে নতুন উদ্যোক্তাও তৈরি হচ্ছে না।

সব মিলিয়ে এক ধরনের বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে খাতটি। যদিও শিল্প খাতে শ্রমশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশই এসএমই খাতের। বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একদিকে পর্যাপ্ত অর্থায়ন ছাড়া এ খাতের বিকাশ যেমন কঠিন, তেমনি বর্তমানে প্রণোদনা না পেলে খাতটির বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে বলে প্রতীয়মান হয় না।

করোনা মহামারী (কডিড-১৯) পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসএমই খাত রক্ষায় ৩০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা পর্যায়ে বিতরণ করা হয়। ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ৭৮ দশমিক ৯২ কোটি টাকা (২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ) ক্ষতিগ্রস্ত নারী উদ্যোক্তাদের এবং ১৩৬ দশমিক ৫৪ কোটি টাকা (৪৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ) ব্যবসা খাতে ভ্যালু চেইনের ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার অনুকূলে বিতরণ করা হয়। ঋণপ্রাপ্ত মোট ৩ হাজার ১০৮ জন উদ্যোক্তার মধ্যে ১১ হাজার ৬৮ জন (৩৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ) উৎপাদন খাত ও ৪৭৭ জন (১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ) সেবা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং ঢাকার বাহিরের মোট ৫৯টি জেলার ২ হাজার ৬১৯ জন (৮৪ দশমিক ২৭ শতাংশ) প্রান্তিক উদ্যোক্তার অনুকূলে বিতরণ করা হয়। এছাড়া কভিডকালীন এসএমই খাতকে রক্ষায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ‘পুনঃঅর্থায়ন স্কিম’ নামক একটি তিন বছর মেয়াদি তহবিল গঠন করা হয়েছিল। এ ধরনের উদ্যোগ আবারো নেয়া যেতে পারে।

তাছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, কর্মসংস্থান বাড়ানো অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধিহীন জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে না। স্থবির কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গতি ফেরাতে হলে এসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও বিনিয়োগের বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এসএমই খাতে ঋণের প্রবাহ কমেছে। গত বছর শেষ তিন মাসে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) এসএমই খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৪ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে এসএমই খাতে ব্যাংকগুলো ৫৪ হাজার ৫২৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। জুন শেষে এসএমই খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ৬ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। তবে এ ঋণের বড় অংশই গেছে মাঝারি আকারের শিল্প ও সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, ছোট ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের বিনিয়োগ অনেক কম হয়েছে।

এদিকে এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর বেচাবিক্রিতেও শ্লথগতি নেমে এসেছে। হাজার হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করলেও বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিক্রি ২-৩ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। ফলে তারল্য প্রবাহ আরো কমেছে। সরকারের এ খাতের ওপর বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। এ খাতে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হতে হবে। এসএমইদের ঋণপ্রাপ্তিতে বিদ্যমান সুদের চাপ কীভাবে আরো কমানো যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং সেবার পরিসর কীভাবে আরো বাড়ানো যায়, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এসএমই খাতকে সেবা দেয়ার জন্য দেশের ব্যাংকগুলোর নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার।

এদিকে এসএমই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রায় সময় এসএমই নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তার অভাবকে দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া আশানুরূপভাবে অর্থায়ন না পাওয়ায় মাঠপর্যায়ে কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি। আবার নীতিমালা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। যে কারণে খাতটির উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত পাঁচ বছর মেয়াদি ‘এসএমই নীতিমালা ২০১৯’ তাই কেবল পরিকল্পনা ও সুপারিশের মধ্যেই আটকে ছিল। এ খাতের উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতকল্পে সার্বিক ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন বলে সংস্থাটি জানিয়েছেন। সুতরাং এ খাতের বিকাশে এসব সমস্যাও আমলে নিতে হবে।

এডিবির ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে কুটির শিল্পে প্রায় ৭৮ লাখ অতি ক্ষুদ্র (মাইক্রো), ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত চার দশকে দেশের এসএমই খাতের উৎপাদন ক্রমে বাড়ছে। আর গত দুই দশক দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এ খাতের অবদান বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। বর্তমানে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২৫ শতাংশ। তার পরও দেখা যায় পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাবে উদ্যোক্তারা দক্ষতা বাড়ানোয় নজর দিতে পারেন না। ফলে তাদের দক্ষতা ঘাটতি তৈরি হয়। ক্রমবর্ধমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে খাবি খেতে হয়। প্রযুক্তিগত জ্ঞানে তারা পিছিয়ে থাকেন, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে দৌড়ে পিছিয়ে রাখে তাদের। কিন্তু এসএমই খাতের বিকাশ ঘটলে এবং উদ্যোক্তাদের পণ্যের গুণগত মান উন্নত করা গেলে তা রফতানি বাণিজ্য ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা যায়। এতে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিও সুদৃঢ় হবে। যেহেতু দেশের এসএমই খাত মূলত গ্রামকেন্দ্রিক ও কৃষিভিত্তিক। একই সঙ্গে জিডিপিতে এ খাতরে অবদান ২৫ শতাংশ থেকে উন্নীত করতে হলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোগকে বিকশিত করতে হবে। তাই বর্তমান সংকট বিবেচনায় নিয়ে এ খাত টিকিয়ে রাখতে এবং বিকাশমান করতে সরকার সচেষ্ট হোক—এমনটাই প্রত্যাশা।

আরও