কৃষিপণ্য পরিবহনে রেলওয়ের উদ্যোগ ব্যর্থ

যেকোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা প্রয়োজন

দেশে ভোক্তা পর্যায়ে কৃষিপণ্যের দাম বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ সড়কপথে পণ্য পরিবহন। কেননা এ পথে পণ্য বাজারজাতের ক্ষেত্রে চাঁদাবাজ ও বিভিন্ন স্তরে মধ্যস্বত্বভোগীদের সরব উপস্থিতি থাকে।

দেশে ভোক্তা পর্যায়ে কৃষিপণ্যের দাম বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ সড়কপথে পণ্য পরিবহন। কেননা এ পথে পণ্য বাজারজাতের ক্ষেত্রে চাঁদাবাজ ও বিভিন্ন স্তরে মধ্যস্বত্বভোগীদের সরব উপস্থিতি থাকে। প্রতিবার হাতবদলের সঙ্গে বাড়তে থাকে পণ্যের দাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহন ব্যয় কমিয়ে দামের লাগাম টানতে ‘‌কৃষিপণ্য স্পেশাল’ নামক একটি বিশেষ ট্রেন চালু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত মাসের শেষ দিকে ট্রেনটি প্রথমবারের মতো চালু করা হয়। কিন্তু উদ্যোগটি আশার আলো দেখেনি। প্রত্যাশিত কৃষিপণ্য এবং কৃষক-ব্যবসায়ীদের থেকে পর্যাপ্ত সাড়া না পেয়ে উল্টো লোকসান গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়েকে। এসব কারণে সম্প্রতি তিনটি রুটেই বন্ধ হয়ে গেছে স্পেশাল ট্রেন চলাচল।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, পঞ্চগড়-ঢাকা, রহনপুর-ঢাকা ও ঢাকা-খুলনা এ তিন রুটে চারদিন কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন পরিচালনা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে সব মিলিয়ে পেয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৮ টাকা। যেখানে ট্রেন পরিচালনায় সংস্থাটির ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা।

রেলওয়ে বিভাগের পদক্ষেপটি প্রশংসনীয়। তবে খুব একটা বাস্তবসম্মত নয়। ফলে এর আশানুরূপ সফলতা নেই বললেই চলে। পদক্ষেপটি নেয়ার আগে বেশকিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন ছিল। বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা রেলের উদ্যোগটি বাস্তবায়নে প্রধানতম চ্যালেঞ্জ। শুধু কৃষকের পণ্য এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশন পৌঁছালেই হবে না। মাঠ থেকে পণ্য কীভাবে স্টেশনে আনা হবে এবং স্টেশন থেকে কীভাবে সেগুলো পাইকারি বাজার পর্যন্ত নেয়া হবে সেসব বিষয়কে এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়নি।

কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ভাষ্যেও অব্যবস্থাপনার বিষয়টি ফুটে ওঠে। তাদের মতে, কৃষক পর্যায়ে পণ্য স্থানান্তরের জন্য খুব বেশি ব্যয় করতে হয় না। তাছাড়া ট্রেনের চেয়ে ট্রাকে পণ্য পরিবহন তুলনামূলক সহজ ও ঝামেলামুক্ত। কারণ ব্যবসায়ীরা ট্রাক বা সহজলভ্য পরিবহন ভাড়া করে কৃষকের পণ্য মাঠ থেকেই সংগ্রহ করেন। কিন্তু ট্রেনে পরিবহনের ক্ষেত্রে কৃষিপণ্য স্টেশনে আনা-নেয়াসহ লোডিং-আনলোডিংয়ের খরচ রয়েছে। ফলে ট্রেনে পণ্য পরিবহনে কৃষক-ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহ প্রকাশ পেয়েছে। রেলওয়ে বিভাগকে এসব সমস্যা আমলে নিয়ে বাস্তব সমাধানের দিকে এগোতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রেলওয়ে বিভাগের এ ট্রেন চালু করার আগে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণে একটি সমীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। যদিও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায় যে পণ্যের বাজারদর কমিয়ে আনতে রেল যেন ভূমিকা রাখতে পারে, সেজন্যই ট্রেনটি চালু করা হয়। যদিও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এতে পণ্যের বাজারদর না কমে বরং রেলওয়েরই লোকসান গুনতে হলো, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সুতরাং উদ্যোগটি বাস্তবায়নে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক। উদ্যোগটি বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও সড়কে পণ্যবাহী যান থেকে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। একই সঙ্গে কৃষকের কাছে পণ্যের ন্যায্যমূল্য ও ভোক্তার কাছে যৌক্তিক দামে পণ্য পৌঁছানো যাবে। তাছাড়া এতে রেলওয়েরও একটি আয়ের ক্ষেত্র তৈরি হবে।

দেশে গণপরিবহন হিসেবে ট্রেনের জনপ্রিয়তা অধিক। কারণ ট্রেনে যাতায়াত ব্যয়সাশ্রয়ী। কৃষিপণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও এটিকে সাশ্রয়ী করে তোলা প্রয়োজন। পণ্য পরিবহনে ট্রেনের প্রতি অনাগ্রহের অন্যতম কারণ ট্রেনে পণ্য পরিবহনের ব্যয় সড়কপথের চেয়ে বেশি। চাষী ও ব্যবসায়ীদের মতে, ট্রেনে ঢাকায় কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য কেজিপ্রতি ভাড়া তুলনামূলক কম নির্ধারণ করা হলেও সে ভাড়ার পাশাপাশি রয়েছে কুলি, মাঠ থেকে স্টেশন ও স্টেশন থেকে মোকামের আলাদা পরিবহন খরচ। এতে সব মিলিয়ে পড়ে যাচ্ছে কেজিপ্রতি কমবেশি ৩ টাকা। কিন্তু সড়কপথে ট্রাকে পণ্য পরিবহন করতে তাদের খরচ হয় কেজিপ্রতি বড়জোর দুই-আড়াই টাকা। সুতরাং কীভাবে ব্যয় কমানো যায় সে উপায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বের করতে হবে। ট্রেন স্টেশনে কুলিদের সিন্ডিকেটের কথাও জানা যায়। সেদিকেও বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।

আবার ট্রেনের সময় সকালে হওয়ায় বাজারজাত নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। এছাড়া ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়সহ নানা কারণে সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে না পারলে ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। সুতরাং কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ট্রেন চালুর সময়টি নির্ধারণ করতে হবে, যাতে পণ্য পাওয়া যায়। এদিকে অনেক সবজিচাষী ও ব্যাপারী জানিয়েছেন যে শুরুর দিকে তারা ট্রেনে সবজি পাঠানোর বিষয়ে অবগত ছিলেন না। যদিও বাস্তবে বিষয়টি জানার পরও কম খরচ ও সহজ বলে তারা ট্রাকে পণ্য পরিবহনকেই বেছে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকই কতজন কৃষক এ বিষয়ে অবগত আছেন তা খতিয়ে দেখতে হবে। তাদের উৎসাহী করতে বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে তাদের সামনে উপস্থাপন করা প্রয়োজন।

রেলওয়ের তথ্যানুসারে, প্রতিটি বিশেষ ট্রেন প্রতিদিন ১২০ টন পণ্য বহন করতে সক্ষম। ট্রেনের অত্যাধুনিক লাগেজ ভ্যানের মাধ্যমে ফল ও সবজি পরিবহন করা যাবে। এছাড়া হিমায়িত পণ্য পরিবহনের জন্য রেফ্রিজারেটেড লাগেজও রয়েছে। উদ্যোগটির সুবিধাগুলো বিশেষভাবে কৃষকদের জানাতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকরা এ বিষয়ে না জানলে কখনই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করা যাবে না। কারণ ব্যবসায়ীদের একাংশ কখনই চাইবে না ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহনের বিষয়টি জনপ্রিয়তা পাক। এতে অসাধু উপায়ে মুনাফা অর্জনে ভাটা পড়তে পারে। সুতরাং কৃষকদের ওয়াকিবহল করা অত্যন্ত জরুরি। সেজন্য প্রচারণার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। কম খরচে, নিরাপদ ও ঝামেলামুক্ত পরিবেশে ঢাকায় সবজি পাঠানোর ক্ষেত্রে রেলপথ একটি সহজ ও জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠুক—এটিই প্রত্যাশা।

আরও