পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। সময় আট বছর। আর ঢাকার যানজটে ক্ষতি বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। ১০ বছর ধরে পরিমাণটি শুনে আসছি। তার মানে দাঁড়াল, ঢাকার যানজট কমাতে পারলে বছরে দুটি না হোক অন্তত একটি করে পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। যদি তা-ই হয়, তাহলে পদ্মা সেতু নিয়ে যেখানে এত হইচই, কাউকে চুবিয়ে মারা বা টুপ করে ফেলে দেয়া—সে তুলনায় ঢাকার যানজট নিয়ে তার ছিটেফোঁটাও তোড়জোড় লক্ষ করা যায়নি কখনো।
বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় ঢাকার যানজট সমস্যা আজকাল আরো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেকের ধারণা ‘স্যাবোটাজ’। তাই নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আসলে বিপ্লব-পরবর্তী এ সরকারের কাছে জনগণের দাবিদাওয়ার শেষ নেই। যানজটমুক্ত ঢাকাও তেমনি একটি দাবি। তবে পরবর্তী সময়ে যে সরকারই আসুক না কেন, ঢাকার যানজট তাদের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ বৈকি!
শুনেছি, নতুন সরকার এসে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বুয়েট সিগন্যালিং সিস্টেম চালুর একটি চেষ্টা চালাচ্ছে। এ আর নতুন কী? ষাটের দশকেও ঢাকায় ট্রাফিক বাতি ছিল। এখনো আছে। হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’-তে প্রায় এক যুগ আগে দেখা, মামা-ভাগিনা পর্বের একটি কৌতুক ছিল এরূপ—বিদেশ ফেরতে মামা ঢাকার রাস্তায় জ্যামে আটকানো। মামার বিস্ময়! ট্রাফিক সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলা, অথচ গাড়ি সব থেমে কেন? ভাগ্নের উত্তর, বাতির রঙ না বরং ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারাই আসল!
অর্থাৎ সভ্য দেশের অনেক নিয়মকানুনই এখানে অচল। চলে না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অনেক তত্ত্বকথাও। যেমন ওপরে সুদৃশ্য ফুটওভারব্রিজ রেখে ১০০ মিটার স্প্রিন্টের গতিতে কোনো এক তাগড়া যুবক কিংবা হাত উঠিয়ে কোনো যুবতীর রাস্তা পারাপার এখানে নিত্য সহা। আবার ডিভাইডার নেই এমন কোনো রাস্তায়, দুই পাশ থেকে দুই পক্ষেরই গাড়ি এসে পুরো রাস্তা দখল করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখোমুখি অবস্থান! ঢাকার রাস্তায় পুলিশ কর্তৃক কিছু উদ্ভট প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছিল। যেমন উল্টো পথে গাড়ি চলা ঠেকাতে কাঁটা যন্ত্রের ব্যবহার। কোটি টাকার সেই যন্ত্রগুলো এখন কোথায়? পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ সেই পুরনো। বাংলায় একটি কথা আছে, ‘ভালো হইয়া যা, ভালো হইতে পয়সা লাগে না’। ঢাকার আপামর জনগণ, চালক আর পুলিশের ‘ভালো হইতে’ কিন্তু এক টাকাও খরচ হতো না। কিন্তু ঢাকার লাভ হতো বছরে কম করে হলেও ৩০ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ একটি পদ্মা সেতু। কেননা ঢাকার যানজটের পেছনে আবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি তাদের ‘ভালো না হওয়া’ অনেকাংশে দায়ী।
বড় প্রকল্প—মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি নিয়ে প্রায় অর্ধযুগ ধরে প্রসব বেদনার মতো যন্ত্রণা সহ্য করার পর কিঞ্চিৎ স্বস্তি লাভ করলেও ততদিনে সমস্যা আরো জটিলতর হয়ে গেছে। আসলে বড় প্রকল্পের ব্যাপারে সরকারি অফিসগুলোর যতটা আগ্রহ, দ্রুত এবং সহজসাধ্য অনেক সমাধানের ব্যাপারে কারো তেমন আগ্রহ নেই। এ অন্তর্বর্তী সরকারের সময় কম, তার কাছে এমন কিছুই চাইতে হবে যাতে সে অল্প সময়ের মধ্যেই তা করতে পারে। তাই কিছু দ্রুত সমাধান তথা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম প্রস্তাব করছি। আমার ধারণা, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এর অনেক ক’টিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
নামে মেগাসিটি হলেও একটি ভালো বাস সার্ভিস বা একটা কার্যকর গণপরিবহন এখনো অনুপস্থিত। এয়ারপোর্ট থেকে ফিটফাট রাস্তায় লক্কড়ঝক্কড় মার্কা বাসগুলো রীতিমতো লজ্জাজনক! ঢাকায় এত প্রাইভেটকার বাড়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভালো গণপরিবহন না থাকা। মেট্রোরেল বা বাস এ ধরনের গণপরিবহনের সংজ্ঞায় পড়ে। মেট্রোরেলের পর কিছু উন্নতি হয়েছে কিছু পথে, কিন্তু বাসের চেয়ে ভালো সেবা দিতে পারে না। বাস বিভিন্ন রুটে গন্তব্যের অনেক কাছাকাছি পৌঁছে যেতে সক্ষম। একটি ভালো এসি বাস সার্ভিস অনেক প্রাইভেটকার ব্যবহারকারীকেও আকৃষ্ট করতে পারত। এ সরকার দ্রুততার সঙ্গে ঢাকার বিভিন্ন রুটে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে যদি ১০০টি এসি বাস চালু করতে পারত তাহলে প্রাইভেটকার ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক কমে যেত। একই সঙ্গে বহুদিন ধরে আলোচিত রুটভিত্তিক একই কোম্পানির অধীন একই রঙ ও ডিজাইনের বাস সার্ভিস চালু অবশ্যই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্ভব।
পৃথিবীর সব বড় শহরেই এমন বাস সার্ভিস থাকে। আছে দিল্লিতেও, যা দিল্লির যানজট কমাতে অনেকাংশে সাহায্য করেছে। ধারণা করা হয়, বর্তমান লক্কড়ঝক্কড় বাস মালিকদের সিন্ডিকেট, রাজনৈতিক প্রভাব আর লবিংয়ের কারণে এটি হয়ে উঠছিল না। ঢাকার লোকসংখ্যা আর সেই স্ট্যাটাস বিবেচনায় কখনই এ দৈন্য বাস সার্ভিস মানানসই নয়। মেট্রোরেল নির্মাণের সময়ে সেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহানোর বদলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এবং আমার ধারণা এ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই বরং এ বাস সার্ভিস পরিবর্তন করা সম্ভব।
কার পার্কিং: উত্তরা জসীমউদ্দীন থেকে হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত হাতের বাঁয়ে যত কমার্শিয়াল বিল্ডিং তার সবক’টিতে দেখবেন বেজমেন্টে আসবাব কিংবা অন্য কোনো পণ্যের মার্কেট। অথচ বাস্তবে রাজউক অনুমোদিত ডিজাইনে সেখানে কার পার্কিং থাকার কথা। এ মেগাসিটিতে সরকারি উদ্যোগে কোনো বহুতল পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়নি কোথাও, যা অবশ্য প্রয়োজনীয়—অন্তত মতিঝিল, বনানী বা গুলশানের মতো ব্যস্ত জায়গাগুলোয়। পার্কিং না থাকায় গাড়িওয়ালাদের কিছু করার নেই, রাস্তায় পার্ক। অতঃপর পুলিশের আয়—মামলা কিংবা উৎকোচ। সেনা নিয়োগ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ সরকার চাইলে ডিজাইনে উল্লেখিত সেই পার্কিংগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারে। কিছু বহুতল পার্কিংয়ের প্রস্তাবও পাস করে দিয়ে যেতে পারে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়ি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ: ‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম’-এর মতো রাষ্ট্রের উচিত নিজে আগে গণপরিবহনে অভ্যস্ত হওয়া। প্রকল্পের নামে হররোজ গাড়ি কেনা, সরকারি গাড়ির সঙ্গে বিনা সুদে ব্যক্তিগত গাড়ি কেনায় সরকারের প্রণোদনা—এসব নীতিগত সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে ঢাকার যানজটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অন্তত ঢাকায় অবস্থানরত সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার সীমিত করার উদ্যোগ নেয়া উচিত। তা হতে পারে বিভিন্ন অফিসে বাস কিংবা মাইক্রোবাস চালু করা। দু-চারজন মন্ত্রী-সচিব পর্যায়ের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সবার জন্যই এ বিধান করা উচিত যে তারা ঢাকায় চাকরি করলে কেউ সরকারি ব্যক্তিগত গাড়ি পাবেন না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস দেয়া: প্রতিদিন রাস্তায় যত প্রাইভেট গাড়ি দেখা যায় তার একটা বড় অংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী বহনকারী। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি সরকারি উদ্যোগে সাবসিডি দিয়ে বড় বাস দেয়া যেত তাহলে যানজট লাঘবে ভূমিকা রাখত। তেল খরচ কমত।
ছাত্র নিয়োজন: প্রথমত, আমাদের পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ নেই। আবার আমাদের গাড়িচালকরাও মোটেও সেই সভ্য পর্যায়ের না যে ট্রাফিক ছাড়াও বাতি দেখে পথ চলবে। আবার ট্রাফিক পুলিশ দুর্নীতিতে জড়িত। এসব সমস্যা সমাধানে কাজে লাগানো যেতে পারে ছাত্রছাত্রীদের। পার্ট টাইম চাকরি হিসেবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কিছু প্রশিক্ষণ দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগানো যেতে পারে। সরকারের এ খরচ বহুগুণ ফিরে আসবে। ছাত্রছাত্রীরাও স্বাবলম্বী হওয়ার একটা উপায় পাবে। শুধু ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ নয়, জনগণকে ট্রাফিক আইন বিষয়ে সচেতন করতেও ছাত্রদের থাকবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বিকেন্দ্রীকরণ: ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বহুদিন ধরে বলা হচ্ছে। একটি নীতিগত সিদ্ধান্তই এখানে যথেষ্ট। কিন্তু কিছু মহলের চাপে এটি সম্ভব হয়নি। এ বিপ্লবী সরকার চাইলে একটি বিপ্লবী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকার ওপর চাপ কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিভাগীয় শহরগুলোয় যদি পূর্বাচলের মতো সরকারি হাউজিং প্রকল্প নেয়া হয়, কিছু সরকারি অধিদপ্তর ঢাকা থেকে সরানো হয়, সেখানে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়, তাহলে ঢাকামুখী মানুষের স্রোত কমবে।
স্বল্পতম সময়ে কিছু ভালো সিদ্ধান্ত আর ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে কোনো ধরনের বড় স্থাপনা নির্মাণ ছাড়াই ঢাকার যানজট অনেকাংশে কমানো সম্ভব। ঢাকাকে বাসের অযোগ্য করে তোলার পেছনে যানজট সবচেয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এ বিপ্লবী সরকারের উচিত স্বল্পতম সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য কিছু ব্যবস্থা নিয়ে মানুষকে স্বস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা।
মো. সিরাজুল ইসলাম: অধ্যাপক, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়