বেকারত্ব নিয়ে বিবিএসের প্রশ্নবিদ্ধ জরিপের রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন বিতর্কের শুরু। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত সময়ে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে, এমন তথ্যের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে বিবিএসের জরিপে তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মত দিয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএসের) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী দারিদ্র্যের হার এখন ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বিবিএসের জরিপে দেশে অতিদারিদ্র্যের হারও কমেছে। ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে অতিদারিদ্র্যের হার এখন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।
কভিড পরিস্থিতির প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের রেশ, কর্মসংস্থানে স্থবিরতাসহ নানামুখী চাপের এ সময়ে দারিদ্র্যের হার যেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে, এমনকি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপেও বলা হয়েছে করোনার সময় দেশে দারিদ্র্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। তাহলে কীসের ভিত্তিতে বিবিএসের জরিপে দারিদ্র্য হ্রাসের বিষয়টি উঠে এল, এটি মোটা দাগে প্রশ্ন তৈরি করছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতেও গত বছর এমন বিতর্ক জন্ম নিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক, ইউনাইটেড নেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এবং অক্সফোর্ড পোভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের প্রতিবেদনেও দেশটিতে দারিদ্র্য কমার বিষয়টি উঠে আসে। কিন্তু সে দেশের অর্থনীতিবিদরা জরিপের তথ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে জরিপ করা হয়েছে, যা আসলে দারিদ্র্যের হার কম দেখালেও ভারতের রাজ্যগুলোর প্রকৃত দারিদ্র্য তুলে ধরেনি।
এদিকে জরিপে দারিদ্র্যের হার কম হলে সরকারের সাফল্যের বিষয়টি উঠে আসে। বাংলাদেশে সোশ্যাল সিকিউরিটি প্রোগ্রাম (এসএসপি) যেমন—বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা, দরিদ্রদের জন্য আয়বর্ধক কর্মসূচি, আশ্রয়ণ প্রকল্প, কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি ইত্যাদি দারিদ্র্য কমাতে অবদান রেখেছে। অর্থনীতিবিদদের ভাষ্যে, ১৯৯০ সাল-পরবর্তী সময়ে শিল্প-কারখানার প্রসারের ফলে দেশে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। সেই উন্নতির সুবিধার ফলে দারিদ্র্যের হার কমেছে। কিন্তু একই সঙ্গে এ বাস্তবতাও তারা স্মরণ করিয়ে দেন যে দারিদ্র্য যতটুকু কমার কথা ছিল, সে তুলনায় কমেনি।
উল্লেখ্য, বিবিএস ২০১৬-১৭ সালের পর দারিদ্র্য সম্পর্কিত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। সংস্থাটি সে বছর ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে (এইচআইইএস)’ প্রকাশ করেছিল। বিবিএস জানিয়েছে, এ ছয় বছর দারিদ্র্যের কোনো জরিপভিত্তিক তথ্য না থাকায় অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় দারিদ্র্য বৃদ্ধির স্থিতিস্থাপকতার ওপর ভিত্তি করে কিছু দারিদ্র্যের প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ অবস্থায় জরিপের মাধ্যমে হালনাগাদ দারিদ্র্য পরিসংখ্যান প্রস্তুত করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। যেটি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রগতি পরিবীক্ষণের পাশাপাশি এসডিজি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পরিবীক্ষণের জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
এভাবে দারিদ্র্য জরিপে ইতিবাচক অবস্থান বজায় থাকা অগ্রগতির নমুনা হলেও এটি মূলত হিতে বিপরীত হবে। কারণ অনুল্লেখিত দারিদ্র্য জিইয়ে রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তাতে সঠিক নীতির প্রতিফলন ঘটবে না। এটি ভবিষ্যতের জন্যও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে, সেই সঙ্গে অতিদারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়াবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার বেশি থাকার কারণে যেসব বিদেশী অনুদান আসে, সেক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এ রকম বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন জরিপগুলো উঠে আসছে? এক্ষেত্রে কি জরিপের প্রশ্নপত্রে কোনো ঘাটতি রয়েছে যে কারণে সঠিক তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে না। এজন্য নতুন কোনো প্রশ্ন যোগ করার প্রয়োজন রয়েছে কিনা সেটি যাচাই করে দেখা প্রয়োজন।
বিশ্বের পরাক্রমশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র্যবিষয়ক জরিপ এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হতে পারে। ইউএস সেনসাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক দারিদ্র্য ১৮ বছর বয়সীদের নিচে হ্রাস পেয়েছে, ৬৫ ও তার বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ১৮ থেকে ৬৪ বয়সীদের মধ্যে অভিন্ন রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তাদের বয়সভিত্তিক জরিপের যে ধারণা রয়েছে, সেটি বেশ কার্যকর মনে হচ্ছে। আমাদের দেশেও বয়সভিত্তিক এ রকম দারিদ্র্য জরিপ পরিচালনা করলে সেটি আশা করা যায় প্রকৃত ফলাফল দেবে। এটি সঠিকভাবে বয়স্ক ভাতা বণ্টনের ক্ষেত্রেও নিয়ামক হবে। এজন্য বিবিএসের জরিপের প্রশ্নপত্র ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই।
বেকারত্বের জরিপের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) একটি সংজ্ঞা বিবিএস নির্ধারণ করলেও দারিদ্র্য জরিপের ক্ষেত্রে এমন কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার মানদণ্ড গ্রহণ করা হয়েছিল কিনা সেটি বিবিএস জানায়নি। তবে বিবিএস একটি বিষয় স্বীকার করেছে, দারিদ্র্য কমলেও আয়বৈষম্য বেড়েছে। বাংলাদেশের মাসিক গড় পারিবারিক আয় ২০২২ সালে বেড়ে ৩২ হাজার ৪২২ টাকায় পৌঁছায়। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপের তুলনায় এটি প্রায় ১০২ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০১৬ সালে মাসিক গড় আয় ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। আর ২০১০ সালে এ আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা।
এ পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নের একপর্যায়ে বৈষম্য বাড়লেও পরে কমে আসে বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এবং পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। আমরা এ ব্যাখ্যায় আশান্বিত হতে চাই। কিন্তু বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা হলে তা দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফল বয়ে আনবে না।
দারিদ্র্য নিরসনের জন্য সঠিক তথ্যসংবলিত জরিপ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য মাঠপর্যায়ে জরিপের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি। এক্ষেত্রে বিদেশে কীভাবে জরিপকাজ চালানো হয় তা অবগত করাতে হবে। আর পুরো জরিপের প্রক্রিয়ায় যেন স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে এ জরিপগুলো দৃশ্যমান ভূমিকা পালন করে। তাই দারিদ্র্যসংক্রান্ত জরিপে প্রচলিত কিছু অনুষঙ্গের বিন্যাস সাধনও প্রয়োজন। যেমন মাথাপিছু আয়-ব্যয় দেশের সার্বিক জনগোষ্ঠীর প্রতিফলন ঘটায় না, তাই এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন। আর মাথাপিছু আয়-ব্যয় দারিদ্র্য জরিপে আনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বয়সভিত্তিক দিকটি প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে। সর্বোপরি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা বিবিএসের জরিপগুলো আরো সুচারুরূপে দেখতে চাই। বিবিএসের আসন্ন কোনো জরিপ নিয়ে বিতর্ক তৈরি না হোক—সে প্রত্যাশাই করি।
তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক