জুলাইয়ের আন্দোলন, যা শুরুতে কোটাভিত্তিক সরকারি চাকরির বৈষম্যের
বিরুদ্ধে একটি সাধারণ প্রতিবাদ হিসেবে শুরু হয়েছিল, তা দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ
মুহূর্তে পরিণত হয়। সেই সময়ের শাসক দল এ আন্দোলনকে একটি সাধারণ প্রতিবাদ হিসেবে দেখলেও
এর জের ধরেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে। ওপর থেকে
দেখতে এটি একটি সরল ঘটনা মনে হতে পারে, কিন্তু যদি আমরা আন্দোলনের বিশেষত শেষ পর্যায়ের
ঘটনাগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তবে দেখা যাবে যে আওয়ামী লীগ এ আন্দোলনের পূর্ণ
শক্তি বা প্রকৃত সম্ভাবনাকে কোনোটিই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
বিশেষ করে, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে, কেবল
কোটা সংস্কারের দাবিতে এমন প্রতিবাদ এর আগে কখনো দেখা যায়নি। তাছাড়া কয়েক
দিনের মধ্যে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত মৃত্যু
সত্যিই হতাশার বিষয়। এ ঘটনা দেশের রাজনৈতিক চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব জানি এটি কীভাবে রাজনীতিকে
প্রভাবিত করে। প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো যা
জনগণ, ভোটাররা, নির্বাচকরা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস করেন
এবং ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেন। এখানে রাজনৈতিক দুর্নীতির প্রভাব উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি
অনুষ্ঠিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারী সরকারের
পতন বর্তমান রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবকে সামনে এনেছে।
যদিও আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরনো দল, হাজার বছরের ইতিহাসের
সেরা অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধ এ দলটিরই অবদান। তথাপিও অনেক পরে এসে তারা দেশের মানুষের
মনোভাব ও একটি সাধারণ দাবির সঙ্গে তাল মেলাতে চরমভাবে ব্যর্থ
হয়। সেই সময়ের সরকার পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে এবং একটি সিদ্ধান্তে আসার জন্য পর্যাপ্ত
সময় পেয়েছিল। কিন্তু সরকার বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়। চূড়ান্ত ফলাফল ছিল যে সাবেক মন্ত্রীরা এবং এমনকি প্রধানমন্ত্রীও নিরীহ মানুষের জীবনের চেয়ে
রাষ্ট্রের সম্পত্তি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিকে অগ্রাধিকার
দিয়েছেন। এটি ছিল একটি বড় ভুল। নিজেদের ক্ষমতার মসনদ রক্ষা বাদই দিলাম।
একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিকভাবে অনেক মিত্র শক্তি
থাকতে পারে। এ শক্তিগুলোর ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকতে পারে। কিন্তু যদি সবার
জন্য রাজনৈতিক চর্চার সাধারণ নিয়ম এক না হয়, তাহলে যেকোনো প্রতিবাদ মারাত্মক ঝুঁকি
তৈরি করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কেন স্বাধীনতা অর্জনকারী
দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল এ সমস্যা সঠিকভাবে মোকাবেলা
করতে ব্যর্থ হলো? দলের নেতারা তখন কী করছিলেন?
এ ধরনের ব্যর্থতার পেছনে বেশ অন্তর্নিহিত বার্তা রয়েছে।
চতুর্থ মেয়াদে ৭ জানুয়ারি, ২০২৪-এর নির্বাচনে
সরাসরি ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ আনন্দে উচ্ছ্বসিত ছিল। যেখানে
নির্বাচনটাই যথার্থ অর্থে ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। পূর্বাপর (২০০৭ সালের নির্বাচন বাদে) গণতান্ত্রিক
নির্বাচনী ব্যবস্থা উপেক্ষা করে, আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতায় ছিল এবং কোনোভাবে জনমতের
গুরুত্ব দিতে অনিচ্ছুক ছিল। দলটি সময়ে সময়ে বিভিন্ন ইস্যুকে উপেক্ষা করেছে বা দমন করেছে
এবং জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের দিকে চোখ বন্ধ রেখেছিল। একটি দেশের বৃহত্তর
সংখ্যক নির্বাচকমণ্ডলীকে (জনগণ) দীর্ঘদিন ভোটদানের সুযোগ থেকে দূরে ফেলে দেয়া
হয়েছিল। একটি জনরোষ তৈরি করতে এটি যথেষ্ট ছিল এবং নির্দিষ্ট সময়ে
সেটি ঘটবে সেটাও অনিবার্য ছিল।
শাসক দলে বড় বড় অসংখ্য দুর্নীতিবাজ তৈরি
হয়ে গিয়েছিল। প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখা মিলছিল এদের। এরা কেউ শতকোটি, কেউ হাজার কোটি
টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নানা কায়দা-কৌশল
করে বের করে নিজেদের করে নিয়েছিল। ইচ্ছামতো দেশের বাইরেও নিয়ে
গিয়ে জমা রাখছিল। সাধারণ মানুষ এত এত দুর্নীতিতে চরমভাবে অতিষ্ঠ
ছিল। তারা ভাবতে শুরু করেছিল এত এত অর্থ সবই জনগণের। সাধারণ জনতার
মধ্যে বিষয়টি একটি ঐক্যানুভূতি তৈরি করে দিয়েছিল। সরকারের বিরুদ্ধে
জনরোষ তৈরিতে সহায়তা করেছিল।
অন্যদিকে শাসক আওয়ামী লীগ ১৬ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের
মধ্য দিয়ে ক্ষমতার যত বড় পরিসরই তৈরি করুক
দলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রকৃত নেতাকর্মীদের প্রচণ্ড সংকটে ছিল। তাদের সোনালি সময় ছিল। নানা সুযোগ
ও সুবিধায় তারা ভরপুর ছিল। এ সময়ে তারা অনেক অনেক লোককে একত্রিত
করেছিল যারা প্রকৃত অর্থে আওয়ামী মতাদর্শের অনুসারী ছিল না। তারা শুধু সুযোগের সদ্ব্যবহার
করতে এসেছিল। দলের প্রকৃত নিবেদিতপ্রাণ তৃণমূল নেতাকর্মীদের সরিয়ে
দিয়ে আওয়ামী লীগ এ সুযোগসন্ধানীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। এ লোকেরা কখনই দলের
স্বার্থে কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল না। এ হাইব্রিড ও সুযোগসন্ধানী
নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী।
তাছাড়া যখন কোটা সংস্কারের আন্দোলন গতি পেতে শুরু করেছিল, তখন
শাসক দলের আইনপ্রণেতারা (সংসদ সদস্যরা) যারা সরকারের গ্রামীণ শক্তি কাঠামোর ভিত্তি
ছিল, একে একে তাদের নির্বাচনী এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিল। বিশ্বাস করা হয় যে স্থানীয় সংসদ সদস্যরা
মাঠ থেকে পালানোর পরিবর্তে তাদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করলে তারা পরিস্থিতি বাস্তবতার
নিরিখে সামাল দিতে পারতেন।
আওয়ামী লীগের আরেকটি ভুল ছিল, তারা ছাত্রদের
নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকে বিরোধী দলগুলোর অন্যান্য আন্দোলনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা তো বৈধই। তাহলে দোষারোপ নির্ভর পরিবেশ তৈরি করে কী লাভ। তারা সেটা করল
এবং তারা বুঝতে ব্যর্থ হলো যে, এ আন্দোলন প্রতিটি
দিক থেকে অন্য যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের চেয়ে আলাদা ছিল। এ ধরনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির
কারণে শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন মন্ত্রী আন্দোলনরত ছাত্রদের উদ্দেশে অত্যন্ত
অপমানজনক মন্তব্য করেছেন, যা শুধু আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল। পতনকেই ত্বরান্বিত
করেছিল।
শেষ দিকে আমরা সরাসরি বলতে পারি, শেখ হাসিনার
পতন রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে নথিভুক্ত হবে। কারণ বারবার ইতিহাস তাদের শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু তারা শিক্ষা নেয়নি। সম্ভবত
নাটক ‘গ্যালিলিও’ থেকে কিছু লাইন আমাদের সবাইকে একটি গুরুত্বপূর্ণ
শিক্ষা দিতে পারে। যখন গ্যালিলিও শাসক শ্রেণীর সঙ্গে পুনর্মিলনের
জন্য ফিরে আসেন, তখন তার শিষ্যরা চিৎকার করে বলেন, ‘যে জাতির সাহসী সন্তান নেই, তার জন্য ধিক্কার।’ উত্তরে
গ্যালিলিও বলেন, ‘একটি জাতি, যার জন্য একটি বীর সন্তান প্রয়োজন হয়, সেটিই একটি দুঃখী জাতি।’
এ পর্যায়ে এসে এখন আর পেছনে তাকানোর কোনো
মানে নেই। এখানে দাঁড়িয়ে আমাদের দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ করণীয়
সম্পর্কে ভাবতে হবে।
এটা সত্য যে, আমাদের দেশ এখন অনেক সমস্যায়
জর্জরিত। তাই আমাদের সব সমস্যা দূর করার
জন্য চেষ্টা করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি যে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস, যিনি আন্তর্জাতিক
খ্যাতি ও সমর্থন নিয়ে এসেছেন, তার যোগ্য নেতৃত্বে রাষ্ট্র পুনর্গঠন
এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণের এ কঠিন কাজে সফল হবেন।
ড. আমানুর আমান: লেখক ও গবেষক