আশিকুর রহমান সমী
লাবণ্যময়ী বাংলাদেশ আয়তনে অনেক ছোট হলেও এখানে রয়েছে পক্ষিকুলের এক অপূর্ব বৈচিত্র্য। সাত শতাধিক প্রজাতির পাখির দেখা মেলে আমাদের এ দেশে। যার মধ্যে শিকারি পাখিরা অন্যতম। আর শিকারি পাখিদের মধ্যে ঈগল জাতীয় পাখিরা অন্যতম এবং সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত কমছে এ পাখিদের সংখ্যা। আবাসস্থল নষ্ট, খাদ্য সংকট, জলাশয় ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট এর অন্যতম বড় কারণ।
আমাদের দেশে পাখিদের মধ্যে Accipitriformes বর্গের এবং Accipitridae পরিবারের ১৭ প্রজাতির ঈগলের সন্ধান পাওয়া গেছে। হাজার হাজার বছর ধরে পাখিদের মধ্যে ঈগলদের অবস্থান অনন্য। বলা হয় কিং অব বার্ডস বা পাখিদের রাজা। তাদের তীক্ষ্ণ চঞ্চু এবং পায়ের নখর তাদের দিয়েছে শক্তিশালী এক অবস্থান। এছাড়া বিভিন্ন দেশের শক্তি ও সামর্থ্যের প্রতীক ঈগল। বিভিন্ন দেশের জাতীয় পাখি ঈগল। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতীক হলো ‘বাল্ড ঈগল’। পৃথিবীর সব থেকে বড় ঈগলের নাম জায়েন্ট ফিলিপাইনস ঈগল। আর ছোট প্রজাতিটি হলো নিকোবার সার্পেন্ট ঈগল।
পৃথিবীতে ৬৮ প্রজাতির ঈগলের মধ্যে বাংলাদেশে পাওয়া ১৭ প্রজাতির ঈগল এটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ঈগল বা শিকারি পাখিদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিবেশ ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ছাড়াও অর্থনীতিতেও রয়েছে আমাদের দেশের ঈগলের জাতীয় পাখির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ঈগল খাদ্যশৃঙ্খলে সর্বোচ্চ স্তরের খাদক। খাদ্যশৃঙ্খলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তার গুরুত্ব অপরিসীম। মাছ, ব্যাঙ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ীসহ বিভিন্ন প্রাণী খেয়ে এরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে পরিবেশ ব্যবস্থাপনায়।
বিভিন্ন প্রজাতির সাপ খেয়ে এ পাখিরা সাপের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। আর ঈগলের সংখ্যা কমে গেলে বাড়ে বিভিন্ন সাপের সংখ্যা। এরা ফসলের খেতের ক্ষতিকর ইঁদুর খেয়ে ফসল রক্ষা করে। যার ফলে রক্ষা পায় কৃষকের কোটি কোটি টাকার ফসল। অসুস্থ মাছ খেয়ে জলাশয়কে এ পাখিরা রক্ষা করে মাছের মহামারীজনিত রোগ থেকে। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গেও এ পাখির রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। শক্তি, ধৈর্য আর সাহসের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত এ ঈগল।
আমাদের দেশে পাওয়া ঈগল প্রজাতির মধ্যে তিলা নাগ ঈগল, বহুরূপী শিকারে ঈগল, মেটে মাথা কুড়া ঈগল সারা দেশেই জলাভূমির আশপাশে সচরাচর দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে জলাশয় দূষণ এবং জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে এদের সংখ্যা আগের মতো আর নেই।
পরিযায়ী স্বভাবের বুটপা ঈগল বা কাটুয়া ঈগল সারা দেশের জলাভূমিকেন্দ্রিক মাঠ প্রান্তরে দেখা গেলেও এদের সংখ্যা বর্তমানে খুবই কম। কারণ আমাদের দেশে প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ মাঠ-প্রান্তরের সংখ্যা একেবারে কমে গেছে, যেখানে এই বুটপা ঈগল বিচরণ করত। পাশাপাশি শীতকালীন এই পরিযায়ী পাখিটি মানবসৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার কারণে আজ বিলুপ্তির হুমকির মুখে।
কালো ঈগল এবং পাহাড়ি শিকড়ে ঈগল, লালপেট বাংলাদেশের বিরল প্রজাতির ঈগল যাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন বনে দেখা মেলে। এর মধ্যে লালপেট ঈগল এবং পাহাড়ি শিকড়ে ঈগল বাংলাদেশের সংকটাপন্ন প্রজাতির ঈগল। পাহাড়গুলো ক্রমেই ঝুঁকির মুখে পড়ছে, পাহাড় কাটা, পাহাড়ি বন উজাড়, পাহাড়ের বড় বড় গাছ কেটে ফেলাসহ বিভিন্ন কারণে পাহাড়ি এই ঈগলগুলো হারাচ্ছে আবাসস্থল, খাদ্যের উৎস। তাই ক্রমেই এদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে ব্যাপকভাবে।
আমাদের দেশের একটি সংকটাপন্ন প্রজাতির ঈগল হলো এশীয় শাহি-ঈগল, যা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব-উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দেখা যায়। আমাদের দেশের পরিযায়ী পাখি সাধারণত জলাভূমি এবং খোলা প্রান্তরকেন্দ্রিক। তবে আগের মতো আর দেখা যায় না এই ঈগলের প্রজাতি।
দেশী গুটি ঈগল আইইউসিএনের তালিকায় একটি বিপন্ন প্রজাতির পাখি এবং বড় গুটি ঈগল, যা সংকটাপন্ন। ঈগলের এ প্রজাতিগুলো সারা দেশের বড় জলাশয়গুলোকে কেন্দ্র করে থাকত। পাশাপাশি নদীর বড় চর, প্লাবনভূমিতেও এদের দেখা মিলত। কিন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যা, জলাশয় দূষণ, নদীতে অধিক মাত্রায় জলযান, বালুমহলের বালি উত্তোলনের কারণে নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট এবং খাদ্য সংকটের কারণে আজ এই দুই প্রজাতির ঈগলের সংখ্যা অনেক বেশি কমে গেছে।
ধলা লেজ ঈগল বাংলাদেশে প্রাপ্ত সবচেয়ে বড় আকারের ঈগল। আমাদের দেশে এরা অতি বিরল পরিযায়ী পাখি। জলাভূমিকেন্দ্রিক হওয়ায় এর প্রধান খাদ্য মাছ। এছাড়া ছোট স্তন্যপায়ী ও জলচর পাখিও এরা মেরে খায়। নব্বইয়ের দশকে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল তিস্তার এক চর থেকে, এরপরে প্রায় বিশ বছর এর দেখা মেলেনি এ দেশে। সর্বশেষ কিছু বছর আগে তিস্তার চর এবং মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় এর দেখা মিলেছিল শীতকালে। জলাশয়ে মানুষসৃষ্ট ঝুঁকি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে এ পাখির সংখ্যা। পাশাপাশি মানুষের অসচেতনতা, মাছ ধরতে বিষটোপ ইত্যাদি ব্যবহার কমিয়েছে এ পাখি। পালসি কুড়া ঈগল বাংলাদেশের ঈগলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি, যা বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন এবং বাংলাদেশের বিপন্ন পাখির তালিকায়। উত্তর-পূর্বের হাওর, সুন্দরবন উত্তর এবং পদ্মা অববাহিকার বড় জলাভূমিকে কেন্দ্র করে এই পাখিটির দেখা মেলে। তবে জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়া, হাওরে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, গৃহপালিত হাঁসের চাষ, মাছ চাষ এ পাখিকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
আমাদের দেশের নেপালি ঈগল শীতের পরিযায়ী পাখি। নেপালের হিমালয় অঞ্চলে প্রজনন করে এই পাখিটি তাই এ রকম নাম। তবে শীতের সময় নিচে নেমে আসে ও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে একে বড় জলাশয়/নদীর আশেপাশে খোলা প্রান্তর ও চরাঞ্চলে দেখা পাওয়া যায়, তবে সংখ্যায় বেশি নয়। তবে জলাশয় ভরাট, দূষণ, বড় চরগুলোর প্রকৃতিক পরিবেশ বিনষ্টের কারণে আজ হুমকির মুখে পাখিটি। White-bellied Sea Eagle যাকে বাংলায় ধলাপেট সিন্ধু ঈগল নামে ডাকা হয়।
ডানার ওপরের অংশ ধূসর এবং ডানার প্রশস্ত প্রান্ত কালো। তীক্ষ্ণ চঞ্চু কালো। এছাড়া লেজের প্রথম অর্ধাংশ কালো। বাকি দেহ সাদা। পা হলদে। উচ্চ স্বরে ডাকে, কিছুটা রাজহাঁসের মতো। একাকী অথবা জোড়াবদ্ধ হয়ে থাকে। আমাদের দেশের আবাসিক পাখি। দিবাচর স্বভাবের পাখিটিকে সমুদ্র উপকূল উড়ে বেড়াতে অথবা উঁচু গাছের ডালে বসে থাকতে দেখা যায়। সাধারণত সাপ, মাছ, পাখি ও কাঁকড়া খায়। শক্ত নখর দিয়ে শিকার ধরে খায়। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিলে প্রজনন করে। সাধারণত পুরনো বাসাকেই পুনরায় ব্যবহার করে। আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে দেখা মেলে এ পাখির।
খাটো-আঙুল সাপ ঈগল বাংলাদেশের শীতকালীন পরিযায়ী পাখি। নাম শুনেই বোঝা যায় এ পাখির প্রধান খাদ্য সাপ। এটি আমাদের দেশের বেশ বিরল পরিযায়ী শিকারি পাখি। চওড়া মাথা ও ভৌতিক চোখবিশিষ্ট বড় আকারের এই ছাইরঙা শিকারি পাখিটিকে আমাদের দেশের উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব, মধুপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে কালেভদ্রে দেখা মেলে। তবে অনেকদিন এর কোনো খোঁজ নেই এ দেশে। প্রাকৃতিক বনভূমি উজাড় ও খাদ্যের সংকট এ পাখির সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে।
বনেলির ঈগল আমাদের দেশের শীতের পরিযায়ী পাখি, তবে বহু বছর এর কোনো দেখা নেই। বেশ ক্ষিপ্র ও দুরন্ত এক শিকারি ঈগল হচ্ছে এই বনেলির ঈগল। এরা ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর সঙ্গে সুযোগ বুঝে অন্য পাখি শিকার করে খায়, এমনকি অন্য শিকারি পাখিদেরও শিকার করে খায়। উত্তর-পূর্বের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে এ পাখির দেখা মিলেছিল অনেক আগে।
বনেলি ঈগলের মতো আরো একটি পরিযায়ী ঈগল আমাদের টাউনি ঈগল বা তামাটে ঈগল, যার হদিসও বহু বছর ধরে আমাদের দেশে নেই। তবে একে উত্তর-পূর্বে এবং শালবনে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল বলে রেকর্ড আছে।
আমাদের দেশের আইইউসিএন ২০১৫-এর তালিকা অনুযায়ী ১৭ প্রজাতির ঈগলের মধ্যে সাত প্রজাতির ঈগল ঝুঁকির লাল তালিকায় ২০১৫ সালে। এর মধ্যে সাদা লেজ ঈগলের এসেসমেন্ট নেই। ২০২৪ সালে এসে হদিস নেই অনেক লিস্ট কনসার্ন প্রজাতির। যার ফলে বিপন্ন আজ অনেক প্রজাতিই।
একটু চিন্তা করে দেখুন তো আগের মতো কি দেখতে পান ঈগলের প্রজাতিগুলোকে। কিংবা আগের মতো জলজ বা প্রাকৃতিক পরিবেশ। আগের মতো কি সুস্থ আছে জলাভূমিগুলো। উত্তরে যদি না আসে তাহলে আপনাকে মানতেই হবে, আমাদের দেশের ঈগল জাতীয় পাখির সবগুলো প্রজাতি আজ হুমকির সম্মুখীন।
আশিকুর রহমান সমী
বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, লেখক ও গবেষক