৪৫ টাকা কেজি দরে যে আলু খুচরা বাজারে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে, সেই আলু কৃষকের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে। বগুড়ার মহাস্থানে যে টমেটো বিক্রি হয় ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে, সেই টমেটো ঢাকা শহরের খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৮০ টাকা কেজি দরে। ঠাকুরগাঁওয়ে যে বেগুন বিক্রি হয় ১০ টাকা পাল্লায়, সেই বেগুন ঢাকা শহরে বিক্রি হয় ৩০ টাকা কেজি দরে। একদিকে কৃষক পণ্য বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না, অন্যদিকে ভোক্তাকে কৃষকের বিক্রয়মূল্যের ৮ থেকে ১০ গুণ দামে কৃষিপণ্য ক্রয় করতে হচ্ছে। এছাড়া পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি, অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া এবং মাঠ থেকে ফসল তোলার পর ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছতে নানা অপচয় কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার পথে বড় বাধা। পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে কৃষিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে উৎসাহ বোধ করছে না নতুন প্রজন্ম। বাপ-দাদার দীর্ঘদিনের পেশা পরিত্যাগ করে তারা নতুন পেশার দিকে ঝুঁকছে। কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে।
কৃষক ও ভোক্তার মাঝখানের মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। একজন কৃষক মধ্যস্বত্বভোগী বেপারিদের দ্বারা কতভাবে নিগৃহীত হন, নাজেহাল হন, বঞ্চনার শিকার হন এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তার জ্বলন্ত উদাহরণ কুষ্টিয়ার বিখ্যাত পেঁয়াজের হাট বাঁশগ্রাম। বাঁশগ্রাম কুষ্টিয়া জেলার একটি নামকরা পেঁয়াজের হাট। গত অক্টোবরে একজন কৃষক তার দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি করতে আসেন ওই হাটে। কৃষক তার তিনটি প্লাস্টিকের বস্তায় ১২০ কেজি পেঁয়াজ বাড়ি থেকে মেপে নিয়ে আসেন। কিন্তু বেপারি বলেন, বস্তাগুলো নাকি ভারী, তাই মোট ওজন থেকে তিন কেজি বাদ দিয়ে হিসাব করতে হবে। কৃষকের ছেলেরা একথা মানতে নারাজ। কারণ তারা জানে যে বস্তায় ১২০ কেজির বেশি পেঁয়াজ আছে। তিন কেজি বাদ মানে ২১০ টাকা কম দেয়ার ফন্দি। আর তিনটা প্লাস্টিকের বস্তার মোট ওজন ৫০০ গ্রামের বেশি হবে না। তবু বেপারি বলছেন, তিন কেজি কম না ধরলে টাকা দেয়া হবে না। এটাই নাকি তাদের নিয়ম। কিন্তু ছেলেরা কিছুতেই মানতে চায় না। কৃষক বৃদ্ধ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে তিনি আগেও পড়েছেন বহুবার। তাই তিনি বেপারির এই জুলুম, নির্যাতন মেনে নেন এবং ছেলেদের শান্ত হতে বলেন। এরই মধ্যে তাদের পেঁয়াজ বেপারি অন্য পেঁয়াজগুলোর সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেন। টাকা দেয়ার সময় বেপারি ইচ্ছে করে আরো ১০০ টাকা কম দেন কৃষককে। কারণ হিসাবে বলা হয়, পেঁয়াজের মান নাকি ভালো ছিল না। অথচ কৃষকের পেঁয়াজ ভালো মানের এবং নেয়ার আগে বেপারি বারবার যাচাই করে নিয়ে ছিলেন। কী দুর্ভাগ্য কৃষকের! কিন্তু করার কিছুই নেই। বাজার কমিটির কাছে নালিশ দিয়েও লাভ নেই। তারাও একই পথের পথিক। কৃষকের ছোট ছেলে তখন বাবাকে বলে, ‘আব্বা, সেই সকালের তে না খেয়ে পিয়েজ বেচতে আইছি। আর ওই বেপাড়ি শালা তোমার ১০০ টাকা মারি দিল। তুমি কিছুই কলে না। তুমি কও। আমি শালারে ঠাপা দিয়ে আসি।’ কৃষক বললেন, ‘নারে বাবা, ওদের গায়ে হাত দিলি আমারই বেশি মার খাতি হবিনি। চল যাই, ভেজাল না করে আমরা কয়ডা খেয়া নিই গে।’ কুষ্টিয়ার এই কৃষকের মতো বাংলার প্রতি প্রান্তে কোটি কোটি কৃষক আজ মধ্যস্বত্বভোগী বেপারিদের খেলার পুতুল। নির্মম নির্যাতনের শিকার। সবকিছু বুঝেও করার কিছু নেই তাদের। নাই প্রতিবাদ করার জন্য তাদের কোনো সংগঠন। বড় রাজনৈতিক দলের কৃষক সংগঠনগুলো এসব ব্যাপারে কিছুই করছে না। ফসলের মূল্য বেশি আর কম যা-ই হোক, কর্মঠ কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এর একটা প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন এমন এক বাজার, যেখানে কৃষক এই অতিলোভী মধ্যস্বত্বভোগীদের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাবেন। উৎপাদিত কৃষিপণ্য ভোক্তার কাছে সরাসরি ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারবেন।
শুধু কি ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা? ক্ষুদ্র কৃষিজমি, কৃষি শ্রমিকের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি, স্বল্প সুদে কৃষিঋণ না পাওয়া, কৃষিপণ্য সংরক্ষণের সুব্যবস্থার অভাব, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের অপ্রতুলতা এবং রফতানিতে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অন্যতম কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কৃষিজমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত হচ্ছে। এসব খণ্ড-বিখণ্ড জমিতে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। গত এক দশকে কৃষি শ্রমিকের মজুরি দুই থেকে তিন গুণ বাড়লেও সে হিসাবে বাড়েনি কৃষিপণ্যের দাম। তাই বর্তমানে কৃষি হয়ে উঠেছে একটি অলাভজনক পেশা। শস্য আবাদের মোট খরচের এক-তৃতীয়াংশের বেশি খরচ হয় মজুরিতে। সেই মজুরি কয়েক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের উৎপাদন খরচ। লাভ না হওয়ায় অধিক শস্য আবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক। হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা কমার কারণে বিভিন্ন শস্যের মোট উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি অনেকটাই গতিহীন। বেশকিছু শস্যে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক পর্যায়ে চলে এসেছে।
কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন হলেও কৃষকের আর্থসামজিক অবস্থার সে অনুপাতে উন্নয়ন হয়নি। গত কয়েক বছর কৃষক ফসলের লাভজনক দাম পাননি। তাই কৃষকের উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত করার জন্য কৃষিপণ্যের স্থায়ী মূল্য কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান (সিএসআরএল)। আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে। এসব দাবির মধ্যে ছিল ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের রক্ষায় ইউনিয়ন পর্যায়ে ধান ক্রয়, সুলভ মূল্যে কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে শস্য সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা, কৃষকের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করার জন্য স্থায়ী ‘কৃষিপণ্যের মূল্য কমিশন’ গঠন, ইউরিয়া সারসহ কৃষি উপকরণের দাম কমানো এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাসের জন্য বাজার পর্যায়ে কৃষকের প্রবেশাধিকার বাড়ানো। কৃষকের সেই দাবি আজও পূরণ হয়নি।
চাল ও আলুর দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও দেশের কোথাও ওই দামে বিক্রি হচ্ছে না পণ্য দুটি। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়ার কথা ভাবছে বর্তমান সরকার। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে দেশের ৬৪ জেলায় তৈরি হচ্ছে ‘কৃষকের বাজার’। এসব বাজারে কোনো ধরনের খাজনা ছাড়াই সরাসরি কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবেন কৃষক। এমনকি কৃষকের বাড়ি থেকে বাজারে পণ্য নিয়ে আসতে পরিবহন সহায়তা দেবে সরকার। এটি করা সম্ভব হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন কৃষক। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রথমে অস্থায়ী ভিত্তিতে এসব বাজার চালু হবে। এরপর হালকা অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। পরবর্তী সময়ে স্থায়ী রূপ পাবে এসব বাজার।
কৃষি বিপণন অধিপ্তরের কথা, সবজিসহ কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে কঠোর হচ্ছে সরকার। সরকার উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করে বাজারে নিরাপদ কৃষিপণ্য বিক্রির বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে। সিন্ডিকেট ভেঙে পাইকারি ও খুচরা দামের মধ্যে পার্থক্য কমাতে পারলে বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে নিত্যপণ্যের দামও কমবে এবং কৃষকও লাভবান হবেন। এজন্য রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারিভাবে কৃষকের বাজার গড়ে তোলা দরকার। এতে লাভের অংশ কৃষকের পকেটে যাবে এবং উৎপাদনও বাড়বে। পাশাপাশি আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ১ থেকে ২ শতাংশ সুদে কৃষককে ঋণ সুবিধা দিলে তারা আরো উৎসাহিত হবেন এবং আমদানি নির্ভরতাও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
গত পাঁচ দশকে জনসংখ্যা বেড়ে সাড়ে সাত কোটি থেকে ১৭ কোটি হয়েছে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে কমেছে কৃষিজমি। তার পরও কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সবজি, ফল, ভুট্টা ও আলু উৎপাদনে ঘটেছে এক নীরব বিপ্লব। দুঃখের বিষয়, এ বিপ্লবের সম্মুখসারির যারা যোদ্ধা, তারা আজ উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। সরকার তাদের স্বার্থে কৃষিপণ্যের মূল্য বেঁধে দেয়ার ও কৃষকের বাজার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়েছে। উদ্যোগটিকে আমরা অভিনন্দন জানাই এবং সফলতা কামনা করি।
বাজারে দুই ধরনের কৃষিপণ্য রয়েছে। একটি কৃষক দেশে উৎপাদন করেন। অন্যটি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। দেশে উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা পর্যায়ের মূল্যের খুবই কম অংশ পান কৃষক এবং বেশি অংশ যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। সঠিক ও সময়োপযোগী পরিকল্পনার অভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। দেশের জনসংখ্যার চাহিদা অনুযায়ী কী পরিমাণ কৃষিপণ্য প্রয়োজন, তা আগে থেকে নির্ধারণ করে কৃষি মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে ভোক্তাদের অধিকার আদায়ের মনিটরিং ব্যবস্থা আরো জোরদার ও গতিশীল করতে হবে। এছাড়া উৎপাদনের ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে কৃষিপণ্য আমদানিও বন্ধ রাখতে হবে।
দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে ঢাকায় ভোক্তা পর্যায়ে কৃষিপণ্য আসতে স্থানভেদে পাঁচ থেকে ছয়টি হাতবদল হয়। দেখা গেছে এই হাতবদলের কারণে মুলার দাম ২০ গুণ, লাউয়ের দাম তিন গুণ এবং অন্যান্য সবজির দাম আট থেকে দশ গুণ বৃদ্ধি পায়। হাতবদল ছাড়াও আরো রয়েছে খাজনা, স্থান ভাড়া, শ্রমিক খরচ, পরিবহন খরচ, পথে পথে পুলিশ, পৌরসভা ও বিভিন্ন সংগঠনের চাঁদাবাজি, অতিরিক্ত ভাড়া ইত্যাদি। তাই কৃষকের বাজার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাটের সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। শুধু সড়কপথে নয়, ট্রেন ও নৌ-পরিবহনযোগে স্বল্প ভাড়ায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় পচনশীল কৃষিপণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারসংলগ্ন স্থানে স্বল্প ভাড়ায় কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য গুদাম/হিমাগার স্থাপন করতে হবে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা কৃষকদের বিশ্রাম ও স্বল্প ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থাও করতে হবে কৃষকের বাজারে। এছাড়া কৃষকের বাজারে আসা কৃষিপণ্য যাতে বিষমুক্ত ও নিরাপদ থাকে, সে ব্যাপারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে নিরাপদ পণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও বাজারজাত-সংক্রান্ত ব্যাপারে কৃষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
নিতাই চন্দ্র রায়: সাবেক মহাব্যবস্থাক (কৃষি)
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লি.