যেমন জাহাঙ্গীরনগর চাই

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। রাতে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ও নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার স্বার্থে পুরো ক্যাম্পাস সিসিটিভির আওতায় আনতে হবে। সবাই যেন জরুরি সেবা সংস্থাগুলোর সহায়তা পায় সেই ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা জরুরি।

২০২৪ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এক বিশাল অধ্যায় হয়ে থাকবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের বুকে জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসে থাকা স্বৈরাচারী সরকারপ্রধান পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্বিতীয় জন্ম তথা দ্বিতীয় স্বাধীনতা লাভ করে।

তবে এ স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি। হাজারো আবু সাঈদ, আলিফ, মুগ্ধ, ইয়ামিনদের তাজা প্রাণের বিনিময়ে আসে এ স্বাধীনতা। সেই শত শত শহীদের নাম হয়তো মুখে বলা সম্ভব না, তবে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বিন্দুমাত্রও কমবে না। তারা শহীদ! তারা সব স্বীকৃতির ঊর্ধ্বে।

স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে মাসব্যাপী আন্দোলন চলেছে, আর আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি তা সম্ভব হয়েছে দেশের সচেতন ও বিবেকবান সব মানুষের সংগ্রামের জন্য। সারা দেশের এ আন্দোলনে শামিল হয়েছিল আমার প্রাণপ্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও।

আমাদের আন্দোলন যখন চলমান ছিল তখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইবোনদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। পড়ার টেবিল ছেড়ে শিক্ষার্থীরা, ক্লাসরুম ছেড়ে শিক্ষকরা, এমনকি বটতলার খাবার দোকানের কর্মচারীরাও শামিল হয়েছেন এ লড়াইয়ে। দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাজপথ দখলে নেয়, তারা ঠিকই জানত একদিন দেশ স্বাধীন হবেই। তবে এতে বাধা কিন্তু কম আসেনি। হায়েনার দল আন্দোলনে হামলা করেছে। শিশু, বৃদ্ধ এমনকি নারী শিক্ষার্থীদেরও ছাড় দেয়নি তারা। সরকারের পোষা পুলিশ ও গুণ্ডা বাহিনী আক্রমণ করে গেছে ধারাবাহিকভাবে। রক্তাক্ত করেছে পুরো দেশকে।

এরই ধারাবাহিকতায় আমার ক্যাম্পাস প্রশাসন এবং তৎকালীন মেরুদণ্ডহীন ভিসির পূর্ণ সমর্থনে ক্যাম্পাসে ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় আমাদের মিছিলে হামলা করে ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধু হলের সামনের সেই হামলায় আহত হই আমিসহ অনেক শিক্ষার্থী। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। হাসপাতালে থেকেই আমি খবর পাই, সেই রাতেই ভিসির বাসভবনে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের ওপর ইতিহাসের ভয়াবহতম নারকীয় আক্রমণ চালানো হয়। পুলিশ-প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতায় বাইরে থেকে ভাড়া করা গুণ্ডাসহ ছাত্রলীগ সশস্ত্র হামলা চালিয়ে আহত করে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে। হামলা-নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি নারী শিক্ষার্থীও।

এতেই উপাচার্য ক্ষান্ত হননি। ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকায়, আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়, হল ভ্যাকেন্ট করে দেয়। প্রশাসনের নিষ্ঠুরতায় আমরা হল ছাড়তে বাধ্য হলেও হাল ছাড়িনি। পালিয়ে পালিয়ে থাকি, তবু আন্দোলন করি। ভয় হয় এই বুঝি গুম হতে হয়, তবু আন্দোলন চলে। আমাদের সেই সংগ্রাম চলেই এবং অবশেষে ৫ আগস্ট হাজার প্রাণের রক্তস্নাত দেশকে আমরা স্বাধীন করতে সক্ষম হই।

এখন দেশ তো স্বাধীন হলো, এবার সংস্কারের পালা। এ সংস্কার কার্যক্রমে ক্যাম্পাস সংস্কারের বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ যা সামনে চলে আসে।

দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের এখন কিছু জিনিস নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। যেমন এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার সময় আমার মূল লক্ষ্য ছিল শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং এমন একটি ক্যাম্পাস গড়ে তোলা যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং প্রশাসন সবাই মিলেমিশে একটি সমৃদ্ধ শিক্ষাঙ্গন গড়ে তোলা যায়। এখন আমি যখন পেছনে ফিরে তাকাই এবং ভাবি কী ধরনের ক্যাম্পাস চাই, তখন আন্দোলনের ভূমিকা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে চোখের সামনে ভাসে...

২০২৪-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ ছিল না, এটি ছিল আমাদের আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম। বৈষম্যবিলোপের পাশাপাশি আমরা যারা ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করি, তাদের অধিকার, স্বাধীনতা এবং সুষ্ঠু পরিবেশে শিক্ষা লাভের সুযোগ নিশ্চিত করার জন্যও এ আন্দোলন হয়েছিল। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম নয়, এটি একটি মুক্তচিন্তার, সৃজনশীলতার এবং ন্যায়ের জাগরণ ক্ষেত্র।

সুতরাং এখন আমরা এমন একটি ক্যাম্পাস দেখতে চাই, যেখানে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ থাকবে। এখানে ছাত্রছাত্রীদের সৃষ্টিশীলতা, চিন্তাশক্তি এবং মুক্তভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব হবে শিক্ষার্থীদের মেধা ও প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে গবেষণা এবং জ্ঞানার্জনের অবাধ সুযোগ থাকবে।

ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। কেননা লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির প্রভাবে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা, মত প্রকাশ, মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা চাই, আমাদের ক্যাম্পাস হবে এমন একটি জায়গা, যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী নিজস্ব চিন্তাধারা প্রকাশ করতে পারবে কোনো দলীয় প্রভাব ছাড়া।

এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) গঠনতন্ত্র পুনর্গঠন করে কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মতামত ও সমস্যার কথা প্রশাসনের কাছে সহজে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এটি শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নেতৃত্ব তৈরি ও স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিতে জাকসু হতে পারে একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম।

প্রশাসনের দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের অবশ্যই ক্যাম্পাসে অবস্থান করে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো সরাসরি সমাধান করতে হবে। প্রশাসনের দায়িত্বরতরা ক্যাম্পাসের বাইরে থাকলে শিক্ষার্থীদের সমস্যার প্রকৃত ধারণা নেয়া কঠিন হয় এবং অনেক সময় সেগুলোর যথাযথ সমাধানও হয় না। প্রশাসন যদি ক্যাম্পাসে থাকে তাহলে সরাসরি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে।

আবাসিক হলগুলোয় কোনো ধরনের রাজনৈতিক ব্লক থাকা উচিত নয়। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের বিভাজন তৈরি করে না বরং শাসন ব্যবস্থায় একটি অন্যায় প্রভাব তৈরি করে। আমরা চাই, শিক্ষার পরিবেশ হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। রাতে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ও নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার স্বার্থে পুরো ক্যাম্পাস সিসিটিভির আওতায় আনতে হবে। সবাই যেন জরুরি সেবা সংস্থাগুলোর সহায়তা পায় সেই ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা জরুরি।

আবাসিক হল ও ক্যাম্পাস মাদকমুক্ত করতে প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদক গ্রহণ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নষ্ট করে। প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে মাদকের প্রবেশ ও ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকবে। এছাড়া থাকতে হবে কাউন্সেলিংয়ের পর্যাপ্ত সুবিধা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রকে অনিয়ম ও দুর্নীতি মুক্ত করে আধুনিকায়ন করাও জরুরি। পূর্ণাঙ্গ মেডিকেলের বাস্তব রূপদান কার্যকর করতে হবে।

গুণগত শিক্ষা হবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শক্তি। আমরা চাই, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে ক্যাম্পাস হোক গবেষণা ও জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্ক আরো নিবিড় করতে হবে। একাডেমিক সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস নিতে যান। পরীক্ষা অর্ডিন্যান্স অনুসারে, একজন শিক্ষক একটি কোর্সে কয়টি ক্লাস নেবেন তা নির্ধারিত থাকে। কিন্তু যারা বাইরে ক্লাস নেন বা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন তারা কোর্সের নির্ধারিত সংখ্যক ক্লাস না নিয়ে কোর্স শেষ করে দেন। ফলে ওই কোর্স সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভ সম্ভব হয় না। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি কর্মজীবনও হুমকিতে পড়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। আমাদের প্রত্যাশা, শিক্ষকরা যেন তাদের কোর্সের নির্ধারিত ক্লাসগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন সেসনজটহীনভাবে সমাপ্ত করতে ভূমিকা রাখেন এবং আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট সময় বরাদ্দ করেন, যাতে শিক্ষার মান উন্নত করা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি সুদূরপ্রসারী মাস্টারপ্ল্যান প্রয়োজন। সেই মাস্টারপ্ল্যানের অধীনে আমাদের ক্যাম্পাসের অবকাঠামো, গবেষণা কেন্দ্র, ল্যাবরেটরি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উন্নত করতে হবে। ক্যাম্পাসের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপারেও প্রশাসনকে ভূমিকা নিতে হবে।

সর্বোপরি দুর্নীতিমুক্ত একটি ক্যাম্পাস গড়তে হবে। দুর্নীতির কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্যাম্পাসের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সর্বশেষে আমার স্বপ্নের ক্যাম্পাস হবে নিরাপদ, মুক্ত এবং সমৃদ্ধ শিক্ষাঙ্গন, যেখানে সবার মেধা, সৃজনশীলতা এবং নৈতিকতার সমন্বয়ে একটি উন্নত সমাজ গড়ে উঠবে। ২০২৪ আন্দোলনের সম্মুখসারির একজন যোদ্ধা হিসেবে, দেশের ও দশের কল্যাণে এটিই আমাদের প্রত্যাশা। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।

আব্দুর রশিদ জিতু: আহ্বায়ক, গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও