অভিমত

কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে উদ্যোক্তা উন্নয়ন কথোপকথন বনাম উপায় অনুসন্ধান

রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তি থেকে শুরু করে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের পাঠদান হয়ে পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানের পেশাদার বক্তা পর্যন্ত সবাই উচ্চস্বরে শুধু উদ্যোক্তার গুরুত্বের কথা বলছেন।

রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তি থেকে শুরু করে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের পাঠদান হয়ে পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানের পেশাদার বক্তা পর্যন্ত সবাই উচ্চস্বরে শুধু উদ্যোক্তার গুরুত্বের কথা বলছেন। আসলে প্রয়োজন এ গুরুত্বের বিষয়টিকে বাস্তবে রূপদান। ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’—এ কথা এখন অনেকটা আপ্তবাক্য বা বহুল উচ্চারিত স্লোগান হয়ে উঠেছে। আর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্রও এ কাজের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করছে এবং ব্যয়ের সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। কিন্তু এতকিছুর পরও গ্লোবাল অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের (জিইডিআই) হিসাব অনুযায়ী উদ্যোক্তা উন্নয়নের বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পর্যন্ত ১৩৭ দেশের মধ্যে ১৩৪।

তাহলে এর মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে উল্লিখিত বক্তৃতা, স্লোগান, অর্থ ব্যয় এসবের কিছুই বাস্তবে তেমন কোনো কাজে আসছে না। ফলে মার্ক্সের উল্লিখিত উক্তির মতো করে বলা প্রয়োজন যে আর মুখরোচক কথোপকথন নয়, প্রয়োজন এসব কথোপকথনের বাস্তব রূপান্তর সাধন। কারণ প্রায় অর্ধ কোটি তরুণকে, যার মধ্যে আবার অধিকাংশই লেখাপড়া জানা, বেকার রেখে একটি রাষ্ট্র ও সমাজকে যথাযথ মান ও মর্যাদা রক্ষা করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে উল্লিখিত বেকারদের জন্য যে পরিমাণে কাজের সুযোগ দরকার, বিদ্যমান ব্যবস্থায় তার অতি সামান্য অংশের জন্যও ‘চাকরি’র মাধ্যমে সহসা সেটি তৈরি করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় এক্ষেত্রে সর্বোত্তম কিংবা বলা চলে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে উদ্যোক্তা উন্নয়ন। শিশুকে পোলিও টিকা খাওয়ানোর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের একটি বিশেষ দিকে ব্যাপক কার্যকর সাফল্য অর্জিত হওয়ার ফলে বিষয়টি যেমন এখন অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বজনীন হয়ে উঠেছে, উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমকেও তেমনি স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বজনীন করে তুলতে হবে। আর সেটি কীভাবে করা সম্ভব অর্থাৎ কী করলে উদ্যোক্তা উন্নয়নের মতো বিপুল সম্ভাবনাময় ও অতিপ্রয়োজনীয় এ কাজকে বক্তৃতা, স্লোগান ও অর্থ অপচয়ের ফাঁদ থেকে উদ্ধার করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে, তা নিয়ে নিজের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার আলোকে এখানে খানিকটা আলোকপাত করা হলো।

প্রথমেই দেখা দরকার, এত প্রচার-প্রচারণা সত্ত্বেও উদ্যোক্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে এতদিনেও পোলিও টিকার মতো না হোক তার কাছাকাছি পর্যায়ের কোনো দৃষ্টান্তযোগ্য কার্যকর অগ্রগতি অর্জিত হতে পারল না কেন, সে বিষয়টিতে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে একটি বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়া প্রয়োজন যে বাংলাদেশ এখনো মূলত একটি কৃষিনির্ভর দেশ। অংকের হিসাবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এর যে অবদান, এ খাতের সঙ্গে বৃহত্তর জনগণের সংশ্লিষ্টতা ও নির্ভরতা দুইই তার চেয়ে অনেক বেশি। দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকে যতটা সহজে ও সাবলীলভাবে বোঝে, কৃষিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড তাদের কাছে ততটাই অপরিচিত, অবোধগম্য ও অস্বাচ্ছ্যন্দময়। এ অবস্থায় একজন কৃষক, কেরানি কিংবা শিক্ষকের শিক্ষিত সন্তানকে যখন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়, তৎক্ষণাৎ এক ধরনের অপরিচয়ের ভীতি ও আশঙ্কা তাকে কাবু করে বসে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তাবৃত্তি তার জন্য যত লাভজনক ও সম্ভাবনাময়ই হোক না কেন, বিষয়টিতে সে সাবলীলভাবে সাড়া দিতে চায় না। এ অবস্থায় পেশাগত অপরিচয়ের এ দূরত্বকে দূর করার জন্য প্রথমেই উদ্যোক্তাবৃত্তির ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে এমন কিছু কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যা দেখে অন্যরা সাহসী ও উৎসাহী হবে। সেক্ষেত্রে দেশের বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ও ভৌত অবকাঠামো পরিস্থিতি ও বিরাজমান আর্থসামাজিক বাস্তবতায় কী ধরনের দৃষ্টান্তের কথা ভাবা যায় তা নিয়ে এখানে খানিকটা আলোকপাত করা হলো।

দেশে বর্তমানে মোট ১৭০টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশতেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সংক্রান্ত বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে, যেমন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই), সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, রোবোটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি। এসব বিষয়ের আওতায় তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি হাতে-কলমের শিক্ষাটি সমান বা তার চেয়েও অধিক জরুরি। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি সুবিধা ও দক্ষ শিক্ষক না থাকার কারণে এসব বিষয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই হাতে-কলমের শিক্ষায় ব্যাপক হারে পিছিয়ে পড়ছেন এবং পাস করার পর উপযুক্ত কোনো কাজ জোগাড় করতে না পেরে চরম হতাশায় ভুগছেন। এ অবস্থায় একটি অভিন্ন প্রস্তাবের আওতায় দুটি লক্ষ্যকে একসঙ্গে অর্জনের নিমিত্তে নিম্নের প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হলো, যার একটি শিক্ষার্থীর দক্ষতা উন্নয়নসংক্রান্ত এবং অন্যটি আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিমূলক। প্রস্তাবটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে তা দেশের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে একটি অনুকরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারবে বলে আশা করা যায়।

দেশে বেসরকারি খাতে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো আইটি ফার্ম বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তদুপরি রাষ্ট্র খাতের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আওতায় রয়েছে বৃহৎ পরিসরের আইটি বিভাগ। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানগুলোর খুব অল্পসংখ্যকের সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যকর ও নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় প্রস্তাব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের আইসিটি-সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের জন্য এক বছরের ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক করে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সেখানে সেটি নিশ্চিত করুক। এটি করতে পারলে তা শুধু শিক্ষার্থীর দক্ষতা বৃদ্ধিতেই সহায়ক হবে না, তাদের জন্য কাজ খুঁজে পেতে বিশেষত নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতেও বিশেষভাবে সহায়ক হবে। কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই ইন্টার্নদের গ্রহণ করতে চায় না। এ অবস্থায় সরকার যদি দ্রুত একটি ‘আইসিটি ইন্টার্নশিপ নীতিমালা’ তৈরি করে সেটির অনুসরণ সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক করে দেয়, তাহলে এক্ষেত্রে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়। আর ওই নীতিমালার আওতায় বেসরকারি আইটি ফার্মগুলোর জন্য এ মর্মে একটি স্বতন্ত্র বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে যে তারা যেমন রাষ্ট্রীয় সহায়তায় উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন, তারাও তেমনি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে নতুনদের হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলবেন।

উল্লেখ্য ভারতের বেঙ্গালুরু কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি অনেকটা এ প্রক্রিয়াতেই ওই দেশ দুটির বিশ্বখ্যাত আইটি পল্লী হয়ে উঠেছে। উপযুক্ত সুযোগ পেলে এ দেশের মেধাবী, প্রতিভাবান ও সৃজনশীল তরুণদের পক্ষেও নিজ দেশের মাটিতে সিলিকন ভ্যালির মতো করে ‘বাংলাকন’ বা ‘বাংলা ভ্যালি’ গড়ে তোলা সম্ভব। আর তেমনটি করা গেলে সেটিই এ দেশে উদ্যোক্তাবৃত্তির বাঁকবদলের নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করি। বিষয়টির প্রতি আইসিটি মন্ত্রণালয় বিশেষ দৃষ্টি দিলে একসঙ্গে তিনটি কাজ হয়ে যায়: এক. আইসিটি খাতের বিকাশ; দুই. নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং তিন. নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তবে এর আওতাধীন উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমকে সফল করে তুলতে হলে এর সঙ্গে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), এসএমই ফাউন্ডেশন এবং ব্যাংকগুলোকেও যুক্ত করতে হবে যাতে ওই সম্ভাবনাময় তরুণদের তারা আনুষঙ্গিক বিনিয়োগ সহায়তা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

আইসিটি খাতের মতো অনুরূপ বিনিয়োগ ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন সম্ভাবনা রয়েছে দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গুচ্ছভিত্তিক শিল্পগুলোতেও। তবে সেখানে নতুন করে যেটি দরকার তা হচ্ছে, ওইসব পণ্যের মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে, নকশার আধুনিকায়ন লাগবে, মোড়কজাত ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করতে হবে এবং একসঙ্গে অনেক পণ্য উৎপাদনের সামর্থ্য বাড়াতে হবে। এ কাজগুলো করা গেলে খুব সহজেই এসব পণ্যের মধ্য থেকে আরো বহুসংখ্যক নতুন পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি করা সম্ভব হবে। তবে ওই শিল্পগুচ্ছগুলোর কোন কোন পণ্যকে নতুন রফতানি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা ও প্রবণতাগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাইপূর্বক তা নির্ধারণ করতে হবে। আর এ কাজে উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং তাদের সহায়তা করতে পারে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো। তবে রফতানি তথ্য সংরক্ষণ ও সংকলন বিষয়ে ইপিবির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে অদক্ষতা ও অস্বচ্ছতার যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ কাজে তাদের আরো সতর্ক ও সচেতন হওয়া উচিত হবে বলে মনে করি।

এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে অর্ধকোটি বেকারের বৃহদংশই শিক্ষিত তরুণ। এদের মধ্যে আইসিটি খাতের তরুণদের উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কীভাবে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে ওপরে আলোকপাত করা হলো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ প্রক্রিয়ায় বাদবাকিদের কীভাবে পাওয়া যাবে? এক্ষেত্রে প্রস্তাব হচ্ছে, সারা দেশে অবস্থিত সব কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সেখান থেকে সদ্যোত্তীর্ণদের উদ্যোক্তাবৃত্তিতে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে বিসিক ও এসএমই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। এ দুই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পূর্ণাঙ্গ তথ্যসংবলিত ‘বিনিয়োগ নির্দেশিকা’ তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছতে হবে, যাতে তারা এটি সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। অন্যদিকে ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতিও এ মর্মে আবেদন রাখতে হবে যে তারা যেন তাদের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোক্তা হিসেবে পেশাগত জীবন বেছে নেয়ার পরামর্শ দেন এবং পাঠ্যাতিরিক্ত (এক্সট্রাকারিকুলার) কার্যক্রমের আওতায় এ বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন ও তাদের উৎসাহ জোগান। উল্লিখিত দুই প্রতিষ্ঠানের মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়গুলোকে অবশ্যই স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে বিষয়টি নিবিড়ভাবে তত্ত্বাবধান ও পরিধারণ করতে হবে।

এর বাইরে উদ্যোক্তাবৃত্তিতে আগ্রহী অন্য সবার জন্যও ওই দুই প্রতিষ্ঠানের উৎসাহ ও সহযোগিতাদান কার্যক্রম সমান গুরুত্বের সঙ্গে অব্যাহত রাখতে হবে। আর ওই সমুদয় কার্যক্রমের সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সব ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোর ঋণ কার্যক্রমও নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে হবে। সিএমএসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক যে নির্দেশ দেয়া আছে, সেটির অধিকতর কার্যকারিতার জন্য বিসিক ও এসএমই ফাউন্ডেশন কর্তৃক ব্যাংকগুলোর মাঠ পর্যায়ের শাখা কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় বাড়াতে হবে।

তবে মানতেই হবে যে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে উল্লিখিত দুই প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সেক্ষেত্রে এ ঘাটতি পূরণে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বিসিক ও এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘সিএমএসএমই ঋণ পরিধারণ ও সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। ওই কমিটি নিয়মিতভাবে এ খাতের ঋণ বিতরণ ও আদায় পরিস্থিতি এবং এক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যাদি পর্যালোচনা করে সংশোধনমূলক ব্যবস্থাদি সুপারিশ করবে।

কাগজ-কলমে দেশে বেকারের সংখ্যা অর্ধ কোটির চেয়েও অনেক কম বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরির কাজটি সর্বাধিক বর্তায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। কিন্তু বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা বস্তুতই বেকার সৃষ্টির এক উর্বর ক্ষেত্র। কোনো যুক্তি ছাড়াই দেশে এখন ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যাদের অধিকাংশের মূল কাজ হচ্ছে তরুণদের শিক্ষার সনদ জোগানো। যে মানের শিক্ষা গ্রহণ করে এসব সনদ নিয়ে তারা বের হচ্ছে, সে মানের শিক্ষা দিয়ে আর যা-ই হোক কাজ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এ অবস্থায় ওই তরুণদের যদি উল্লিখিত মানহীন শিক্ষার পথে ধাবিত না করে এইচএসসি পাসের পর পরই উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করা যেত, তাহলে দেশে একটি বড় কাজ হতো বলে মনে করি।

অন্যদিকে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, ৫৩টি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হন, তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে চাকরি খুঁজে পাওয়া। কিন্তু অত বিরাট সংখ্যক চাকরি কি দেশে আছে? নেই। সেক্ষেত্রে এ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি তাদের শিক্ষার্থীদের চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উৎসাহ দেন, তাহলে উদ্যোক্তা উন্নয়নের কাজটি অনেকখানি এগিয়ে যায়। এ বিষয়ে বিসিক ও এসএমই ফাউন্ডেশন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজটিকে কীভাবে আরো কার্যকর উপায়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেসব নিয়ে ভাবতে পারেন। কৃষি খাতে প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোক্তাবৃত্তির যে সুযোগ রয়েছে, দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা সে জায়গাটিও দক্ষতার সঙ্গে পূরণ করতে পারেন। তবে অন্যান্য শাখার স্নাতকরাও সেটি করতে পারেন।

সব মিলিয়ে মূল কথা হচ্ছে, দেশের চলমান বেকারত্ব পরিস্থিতি মোকাবেলায় এ মুহূর্তে উদ্যোক্তা উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই—শিল্প, কৃষি, আইটি, সেবা ইত্যাদি যে খাতেই হোক না কেন। আর সে কাজে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এমন হতে হবে যে এর মধ্য দিয়ে দেশে যেন একটি দৃষ্টি আকর্ষণকারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে এবং ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মেধাবী তরুণরা এখানে এমন এক সৃজনশীল অর্থনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলবেন, যেখানে উদ্যোক্তারা হবেন মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। তারা এখানে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী, বাজার সিন্ডিকেটের সদস্য কিংবা অন্য কোনো মাত্রার দুর্নীতিবাজ হবেন না। হবেন ব্যবসা, সমাজ ও অর্থনীতিকে নেতৃত্বদানকারী সব ব্যক্তি, যাদের মানুষ শুধু শ্রদ্ধাই করবে না, তারা অন্যদের জন্য অনুসরণীয়ও হয়ে থাকবেন।

আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়

আরও