ষাটের দশকে অর্থনীতির নতুন একটি দিক হিসেবে সৃজনশীল অর্থনীতি আলোচনায় এল। এটিকে অর্থনীতির একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলো। ২০০১ সালে এ বিষয়ে আস্ত একটি বই লিখে ফেললেন জন হকিন্স। বইয়ের নাম ‘দি ক্রিয়েটিভ ইকোনমি: হাউ পিপল মেক মানি ফ্রম আইডিয়াস’। বইয়ের শিরোনাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে অর্থনীতির এ শাখার নাম ‘ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’। সহজ বাংলা করলে বলা যায় ‘সৃজনশীল অর্থনীতি’। অর্থাৎ, মানুষের সৃজনশীল কাজকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তা-ই সৃজনশীল অর্থনীতি নামে পরিচিত। কালের পরিক্রমায় সারা বিশ্বে সৃজনশীল অর্থনীতির বাজার বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্য সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা জন নিউবিগিন একটি প্রবন্ধে লেখেন, ‘বলা হয়ে থাকে যে ২০ শতকের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ছিল জ্বালানি তেল। আর ২১ শতকের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হলো সৃজনশীলতা।’ তিনি আরো লেখেন, ‘জ্বালানি তেলে দখল বিংশ শতাব্দীজুড়ে ভূরাজনীতির নির্ণায়ক ছিল। আর সৃজনশীলতার প্রসার ও তার যথাযথ সংরক্ষণে নেয়া নীতিগুলোই হবে একুশ শতকে সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক।’ তাই সৃজনশীলতা ও সৃজনশীল অর্থনীতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকা বর্তমানে বিশ্বের যেকোনো দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সৃজনশীল অর্থনীতি বিষয়ে পর্যাপ্ত জানাশোনা ও প্রয়োজনীয় কাঠামো এখনো তৈরি হয়নি। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো এ বিষয়ে গত শতক থেকেই গবেষণা শুরু করে দিয়েছে। তারা সৃজনশীলতা ও সৃজনশীল অর্থনীতির সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। সৃজনশীল অর্থনীতিকে কীভাবে আরো বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে তারা তখন থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছে।
১৯৯৪ সালে অস্ট্রেলীয় সরকার ‘ক্রিয়েটিভ নেশন’ নামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিল। তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন নবনির্বাচিত লেবার পার্টি সৃজনশীলতার সংজ্ঞা ও ব্রিটিশ অর্থনীতিতে এর সরাসরি প্রভাব যাচাই করার জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ‘কালচার, মিডিয়া অ্যান্ড স্পোর্ট’ নামে একটি নতুন ডিপার্টমেন্ট খুলেছিল। এ ডিপার্টমেন্ট থেকে ১৯৯৮ সালে ‘ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ—ম্যাপিং ডকুমেন্ট ১৯৯৮’ নামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়। এতে সৃজনশীল কাজ হিসেবে ১৩টি বিষয়কে তালিকাভুক্ত করা হয়। বিষয়গুলো হলো বিজ্ঞাপন, স্থাপত্য, শিল্প ও পুরাকীর্তির বাজার, কারুশিল্প, পারফর্মিং আর্টস, প্রকাশনা, সফটওয়্যার, টেলিভিশন ও রেডিও। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছিল যে এসব খাতে ব্যক্তিগত সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও প্রতিভা দেখানোর সুযোগ আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ উৎপাদনের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ আছে। সেই থেকে শুরু। তার পর থেকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সৃজনশীল অর্থনীতির আকার বাড়ানো নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করছে এবং তার প্রসার ও সংরক্ষণে নীতি নির্ধারণ করছে। ফলে বর্তমানে সৃজনশীল অর্থনীতির বৈশ্বিক আকার দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। জি২০ ইনসাইটসের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জিডিপির ১০ শতাংশ আসবে সৃজনশীল অর্থনীতি থেকে। এ সময়ের মধ্যে সৃজনশীল খাতে ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে দেলোয়েত। ফোর্বসে ১৬ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। জাতিসংঘের জরিপ অনুসারে বর্তমানে সৃজনশীল খাত থেকে সারা বিশ্বে প্রতি বছর আয় হয় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বের পাঁচ কোটি মানুষ সৃজনশীল কাজে জড়িত। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক কর্মীই নারী। বর্তমানে আয়ের দিক থেকে সৃজনশীল অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত টেলিভিশন ও ভিজ্যুয়াল আর্টস (দৃশ্যকলা)। আর কর্মসংস্থানের দিক থেকে সবচেয়ে বড় খাত হলো ভিজ্যুয়াল আর্টস ও মিউজিক। ২০২০ সালের এক জরিপ অনুসারে, সে বছর যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও সংস্কৃতি খাতে কর্মী সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ। তাদের বেতনের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। আর সৃজনশীল খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ছিল ৮৭ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে সৃজনশীল পণ্য ও সেবা রফতানি করে আয় হয়েছিল ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। পলিসি সার্কেলের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০২ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সৃজনশীল খাতে কর্মী সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এদের মধ্যে আছে শিল্পী, লেখক ও পারফরমার। ২০০১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে স্বনির্ভর সংগীতজ্ঞ ও লেখকের সংখ্যা বেড়েছে যথাক্রমে ৪৫ ও ২০ শতাংশ। দেশটিতে অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বনির্ভর কর্মীর তুলনায় স্বনির্ভর শিল্পীর সংখ্যা প্রায় চার গুণ বেশি। ২০২১ সালের মে পর্যন্ত হিসাব অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে স্বনির্ভর শিল্পী, লেখক ও পারফরমারের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজারের বেশি। ২০২০ সালের মে মাসের তুলনায় এ সংখ্যা ৭ শতাংশ বেশি ছিল। সৃজনশীল অর্থনীতির পরিধি বাড়াতে ইউরোপও পিছিয়ে নেই। ২০১৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘ক্রিয়েটিভ ইউরোপ’ নামে একটি প্রোগ্রাম চালু করে। সে সময় এর জন্য ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ বরাদ্দ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে এ পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সে অনুসারে, সৃজনশীল খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় বিনিয়োগ করার জন্য ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। সে সময়েই এসব খাতে ১ কোটি ২০ লাখ কর্মী নিয়োজিত ছিল। বর্তমানে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে পাঁচটি প্রধান সংস্থা সৃজনশীল ৪০০টি ব্র্যান্ড ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছে। সৃজনশীল অর্থনীতির বিশ্ববাজারে তাদের হিস্যা ৭০ শতাংশেরও বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে সারা বিশ্বের প্রায় তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া তাদের আদিবাসীদের শিল্প ও সংস্কৃতির প্রসারের জন্য ‘ইনডিজেনাস ভিজ্যুয়াল আর্টস ইন্ডাস্ট্রি সাপোর্ট প্রোগ্রাম’ নামে একটি কর্মসূচির অধীনে আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিল্পী, শিল্প সংস্থা ও শিল্প কেন্দ্রের জন্য ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সরকারের পাশাপাশি ‘অ্যাবরিজিনাল আর্ট অ্যাসোসিয়েশন অব অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থাও দেশটির আদিবাসী শিল্প ও সংস্কৃতির বাজার সম্প্রসারণে কাজ করছে। এভাবে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের ফলে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী শিল্পের বাজার বার্ষিক প্রায় ১৫ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। সুইডেন সৃজনশীল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য ‘কালচারাল কো-অপারেশন মডেল’ নামে একটি উদ্যোগ নিয়েছে। এ মডেলের অধীনে সুইডেন সরকার ২০১৬ সালে সৃজনশীল খাতের জন্য ২২ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছিল।
ওপরের উদাহরণগুলো দেয়া হলো সৃজনশীল অর্থনীতির ব্যাপারে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অবস্থান ও কর্মসূচি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য। এ রকম আরো দৃষ্টান্ত আছে। সে তুলনায় সৃজনশীল অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশের এখনো কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। সৃজনশীল খাতগুলোর প্রসারের মাধ্যমে সৃজনশীল অর্থনীতির বিশ্ববাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে নেই কোনো উল্লেখযোগ্য তহবিল। সৃজনশীল অর্থনীতিতে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা দ্বিমুখী। অর্থাৎ সরকার ও সাধারণ নাগরিক উভয় দিক থেকেই সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে এক ধরনের অনীহা আছে। এ অবস্থা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। ঠিক যে কারণে আমাদের এ ভূখণ্ডে ব্যবসায়ীর সংখ্যা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় কম, একই কারণে সৃজনশীল কাজের প্রতি আমাদের আগ্রহ কম। বাংলাদেশের নাগরিকরা কৈশোর থেকেই এক ধরনের স্টেরিওটাইপ মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। অধিকাংশ নাগরিকই ছোটকাল থেকে নির্দিষ্ট কিছু ছকের মধ্যেই তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করতে অভ্যস্ত। এর কারণও আছে। পরিবার ও সমাজ তাদেরকে সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত করে না। আবার সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো যথাযথ নীতি তৈরি হয়নি। তাই বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে কোনো ব্যবসাসফল কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী কিংবা সংগীতজ্ঞ নেই। কারুশিল্পীদের কথা তো বাদই দিলাম। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন যে কোনো সন্তান একটু ভিন্ন কিছু করতে চাইলে অভিভাবকরা বলেন, ‘সৃজনশীলতার ভাত নেই’। তাদের কথা মিথ্যা নয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য যথাযথ পরিবেশ তৈরি হয়নি। সরকারিভাবে কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তা একেবারেই অকিঞ্চিৎ। বেসরকারিভাবে কিছু কাজ হচ্ছে। তবে সেগুলো এখনো একেবারেই প্রাথমিক অবস্থায় আছে।
অচিরেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে না পারলে আমরা বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব। সে বিপর্যয় কাটাতে হলে এখনই সচেতন হতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক