বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় সাত হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি, যা মোট উৎপাদনের ২৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সার্বক্ষণিক উৎপাদন ও ব্যয় সাশ্রয়ের জন্যই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কয়লাভিত্তিক মেগা প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিনিয়োগ করা হয় বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী ঋণের অর্থে। এসব কেন্দ্র নির্মাণের আগে জ্বালানি ও প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। নির্মাণকাজ শেষে যখন এসব কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায় তখন দেখা দেয় জ্বালানি ও আর্থিক সংকটসহ নানা জটিলতা। এসব সংকটের কারণে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না এসব কেন্দ্রে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। জাপানি ঋণে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে কয়লাভিত্তিক সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। শুধু এ কেন্দ্রই নয়, দেশে বৃহৎ যেসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে, তার সব কয়টি বছরের কোনো না কোনো সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কখনো জ্বালানি সংকট, কখনো মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ, আবার কখনো অর্থ নিয়ে টানাপড়েন। সবসময় চালু রাখা ছাড়া বিপুল অংক ব্যয়ে নির্মিত বেজলোড বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে কোনো অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এসব জটিলতা নিরসনে সরকারকে এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়বে অদূরভবিষ্যতে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে বিদ্যুৎ খাতের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত এবং সংকট সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া দরকার।
একটা সময়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল না। এখন সক্ষমতা হয়েছে কিন্তু গ্যাস, কয়লা ও আর্থিক সংকটে উৎপাদন সক্ষমতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। জ্বালানি ও বৈদেশিক মুদ্রা নিশ্চিত না করেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। বর্তমানে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু জ্বালানির অভাবে উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে প্রতি বছর অলস বসিয়ে রেখে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বাবদ গুনতে হচ্ছে জরিমানা। খরচের চাপ সামলাতে ভোক্তা পর্যায়ে দফায় দফায় বেড়েছে বিদ্যুতের দাম এবং দায় বেড়েছে সরকারের। আর অপ্রয়োজনীয় সক্ষমতা বাড়িয়ে ডেকে আনা হয়েছে দেশের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি। এ খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের নামে দায়মুক্তি আইন পাসের মাধ্যমে বিনষ্ট করা হয়েছে বিদ্যুতের প্রতিযোগিতার বাজার। ফলে মুনাফা লুফে নিয়েছে দেশের মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। আর জনবিমুখ ও আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতির কারণে এখন ঝুঁকিতে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। বর্তমান সরকারকে উৎপাদন সক্ষমতা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিশ্চিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দ্রুত সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা না গেলে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকট আরো তীব্র হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সঙ্গে অর্থনীতির নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। সঠিক পরিকল্পনা ও জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে দেশের মানুষ এর সুফল পেত। অর্থনীতি সচল হতো এবং মানুষের জীবনমান বাড়ত।
বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সক্ষমতা রয়েছে তার সিংহভাগই উৎপাদন করতে পারছে না। শুধু গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ১২ হাজার ৩৮৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে চালানো যায় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। গ্যাস সংকটের কারণে বাকি সক্ষমতা ব্যবহার করা যায় না। অন্যদিকে জ্বালানি তেলভিত্তিক ছয় হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলেও উচ্চ মূল্য ও জ্বালানি সংকটে সেগুলোও দেড়-দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি ব্যবহার করা হয় না। আবার কয়লা সংকটের কারণে শুধু মাতারবাড়ী নয়, অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও জ্বালানি সংকটে রয়েছে। বর্তমানে বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি বৃহৎ সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট উৎপাদনে নেই।
আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের নানামুখী ঝুঁকি থাকে। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি, উৎপাদন ও দাম নিয়ে কারসাজিসহ বিভিন্ন কারণে জ্বালানির বাজার সারা বছরই দোদুল্যমান থাকে। মাঝে মাঝেই দাম বেড়ে রেকর্ড করে। ফলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিশেষজ্ঞরা আমদানিনির্ভর এলএনজি ও কয়লার ওপর অতিনির্ভরতার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ ছিল, নবায়নযোগ্য ও দেশীয় জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, এলএনজি, জ্বালানি তেল, কয়লা প্রভৃতির বাজার অস্থিতিশীল। এর দাম দ্রুত ওঠানামা করে। এছাড়া এলএনজির দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে যায়, যা সার্বিক মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব রাখে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিবৃদ্ধি ও শিল্পায়নের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর পেছনে রয়েছে সাশ্রয়ী মূল্যের গ্যাসের সরবরাহ। স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান আসায় স্বল্প মূল্যে শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে এটি প্রদান করা গেছে। এতে স্বল্প মূল্যে পণ্য উৎপাদন করা গেছে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
সার্বিক সক্ষমতা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, গ্যাস ও কয়লার আমদানিনির্ভরতা উচ্চাভিলাষী ও বাস্তবতাবিমুখ পরিকল্পনা। আমরা এখনো প্রাথমিক জ্বালানির বিষয়টি নিয়ে একটা পরিপূর্ণ সমাধানে আসতে পারিনি। অথচ এর সমাধানও রয়েছে। গোষ্ঠী স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রাধান্য দিতে গিয়ে জ্বালানি খাতকে ঝুঁকিতে ফেলছি। অথচ এর খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের জনগণকে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে জ্বালানি নিশ্চিতে দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। একই সঙ্গে আমদানিনির্ভর এ মহাপরিকল্পনা সংশোধনপূর্বক দেশীয় উৎসনির্ভর করা প্রয়োজন।