আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিশ্বের কাছে প্রশংসনীয় একটি বিষয় ছিল বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার। কিন্তু এমন উচ্চ মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দেখাতে অনেকগুলো প্রতারণামূলক কায়দাকানুন অনুসরণ করত সরকার, যা অর্থনীতির প্রকৃত গতিশীলতা ও সুস্বাস্থ্যের প্রতিফলন ছিল না। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ঘোষণা করেছে যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গত অর্থবছরের ৫ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৪ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। আগের পূর্বাভাসে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হওয়ার কথা বলেছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অনেকে এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা খোঁজার চেষ্টা করছেন। ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের ধ্বংসযজ্ঞ ও গত চার মাসের টালমাটাল পরিবর্তনগুলোর পর জিডিপি প্রবৃদ্ধি একেবারে ঋণাত্মক হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। তাই আমি মনে করি, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নতুন এসব পূর্বাভাস অনেকটাই আশাপ্রদ বিধায় সমর্থনযোগ্য। বিগত শাসনামলে যেসব কায়দাকানুন অবলম্বন করে মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো হতো সেগুলো বক্ষ্যমাণ কলামে আমি ব্যাখ্যা করছি।
তাত্ত্বিকভাবে জিডিপি হলো: (ভোগ ব্যয় + বিনিয়োগ ব্যয় + সরকারি ব্যয় + রফতানি আয় -আমদানি ব্যয়)। বিনিয়োগ ব্যয় দেশের সঞ্চিত পুঁজি থেকে হয়েছে নাকি বৈদেশিক ঋণের অর্থে হয়েছে সেটা এক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়, উভয় ক্ষেত্রেই জিডিপি বাড়ার ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য হয় না। তেমনিভাবে সরকারি ব্যয় সরকারি রাজস্বের অর্থায়নে হয়েছে নাকি দেশীয় অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বৈদেশিক ঋণের অর্থায়নে হয়েছে সেটাও জিডিপিতে সরকারি ব্যয়ের অবদান নির্ধারণে তারতম্য সৃষ্টি করে না। শেখ হাসিনার সরকার সাড়ে পনেরো বছর ধরে যেনতেনভাবে অজস্র অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ করে বিনিয়োগ ব্যয় ও সরকারি ব্যয় বাড়ানোর নীতি বাস্তবায়ন করে দেশের জিডিপি কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর ব্যবস্থা করায় আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রতি বছর উচ্চস্তরে দেখানো যাচ্ছিল, যা মোটেও টেকসই প্রবৃদ্ধি ছিল না। বৈদেশিক ঋণ নেয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ব্যয় এক দশক ধরে জিডিপির অনুপাত হিসেবে ২৩-২৪ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু বিশেষত সরকারি খাতে অজস্র ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থ ব্যয় করায় জিডিপি বেড়ে গেছে। সরকারি রাজস্ব আহরণ এ দেশে কমতে কমতে জিডিপির ৮ শতাংশে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থে প্রতি বছর সরকারি ব্যয় বাড়ানোয় জিডিপি দ্রুত বেড়ে গেছে। ঋণ বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় বাড়ালে তা জিডিপিকে বাড়িয়ে দেয়, সরকারি ঋণ বাড়লে জিডিপি কমে না।
মোট জিডিপিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় মাথাপিছু জিডিপি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যখন পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন তখন থেকেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) ‘ডাটা ডক্টরিং’-এর কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিলেন। তার নির্দেশে ওই সময় থেকে ‘ডাটা ডক্টরিং’-এর সহায়তায় মোট জিডিপিকে বাড়িয়ে দেখানো এবং মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো বিবিএসের খাসলতে পরিণত হয়েছিল। তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে এমন ‘বানোয়াট (ম্যানুফ্যাকচারড)’ তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে প্রতি বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখিয়েছে সংস্থাটি। এক দশক ধরে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে কাহিনী প্রচার করে শেখ হাসিনার সরকার দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিল তার সিংহভাগই ছিল ভুয়া ও ভিত্তিহীন। এটা অনেকেরই জানা নেই যে মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ ধারণা। এর সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো—এটা একটা গড়, যা স্বল্পসংখ্যক ধনী ও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নমধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক অবস্থানের দরিদ্র জনগণের আয়বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে আড়াল করে ফেলে। এর অর্থ একজন কোটিপতির আয়ের সঙ্গে একজন ভিক্ষুকের শূন্য আয়ের গড় করলেও ওই ভিক্ষুকের মাথাপিছু আয় ৫০ লাখ টাকা হয়ে যাবে। মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয়বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের কয়েক হাজার উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে। যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য-পরিমাপক জিনি সহগ, যা ১৯৭৩ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩৬, সেটা বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে পর্বতপ্রমাণ শূন্য দশমিক ৪৯৯-এ পৌঁছে গিয়েছিল। কোনো দেশের জিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৫ হলে সে দেশকে ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ’ বলা হয়। অতএব নিঃসন্দেহে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের’ দেশে পরিণত হয়েছে। বিশেষত অজস্র ঋণ করে এভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর কৌশল পুরো জাতিকে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সাগরে নিমজ্জিত করেছে। ওই ঋণের সিংহভাগই স্রেফ পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে লুণ্ঠিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছিল পুঁজি পাচার। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি দাবি করেছে যে ২০০৯-২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে পনেরো বছর ধরে দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি বাড়ানোর বানোয়াট গল্প সাজিয়ে দেশটাকে লুটেপুটে খেয়েছে। যদিও এর সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এ পুঁজি লুণ্ঠনের কেন্দ্রে শেখ হাসিনা পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পুত্র সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দু হাতে টাকা বানাতে হবে’। অতিসম্প্রতি শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রিমান্ডে স্বীকার করেছেন, এস আলম গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি লুট করেছে তার অর্ধেক দিতে হয়েছে সজীব ওয়াজেদ জয় ও টিউলিপ সিদ্দিককে! সালমান নিজেও তার মালিকানাধীন বেক্সিমকোর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি।
আরেকটি বিষয় হলো, শেখ হাসিনার শাসনামলে কৃত্রিমভাবে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন রফতানি আয়ের প্রকৃত অবস্থাটা দেখাতে শুরু করেছে, তখন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রফতানি আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে কমে গেছে। উপরন্তু এখন যখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় পুঁজি লুণ্ঠন অনেকখানি কমে গেছে, তাই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ব্যয় এবং সরকারি ব্যয় চলতি অর্থবছর অনেকখানি কমে যাবে। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও কমে যাবে। একই সঙ্গে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, তৈরি পোশাক শিল্পের উৎপাদন সংকট, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সংসদ সদস্য-নেতাকর্মী, হাসিনার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাংচুর এবং সামগ্রিক উৎপাদন বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ বা ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে আশার কথা হলো অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যাংক খাত ও সামগ্রিক অর্থনীতিকে আবার সুষ্ঠু পথে ফিরিয়ে আনার জন্য যথোপযুক্ত নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। অধ্যাপক ইউনূসের ভাবমূর্তির কারণে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হতে চলেছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে কয়েক বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দেবে। একই সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশীরা যেভাবে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণের জোয়ার সৃষ্টি করেছেন তা অব্যাহত থাকলে অর্থনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করবেই। সবচেয়ে বড় কথা, বর্তমান সরকার দুর্নীতিমুক্ত ও দেশপ্রেমিক। তাই আগামী অর্থবছরে দেশ আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির মহাসড়কে উঠবে।
ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি; একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়