দীর্ঘদিন ধরেই দেশে ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। চালের দামের ঊর্ধ্বমুখিতা এখনো বজায় আছে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনই বলছে, এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম (ব্রি-১৮ ও পাইজাম) কেজিপ্রতি খুচরায় ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেড়ে ৫৮ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিকন চাল (মিনিকেট ও নাজিরশাইল) কেজিপ্রতি ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারভেদে দাম এর চেয়েও বেশি।
চালের মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। যেভাবে প্রতিনিয়ত চালের দাম বাড়ছে এবং আমদানি ও মজুদ কমছে তাতে মানুষ ভবিষ্যতের কথা ভেবে রীতিমতো শঙ্কিত। বর্তমানে বাজারদরে যে অস্থিরতা চলমান এর প্রভাবে চালের দামও পুনরায় বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। চাল দেশের মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য, আর দ্বিতীয় গম। চাল ও গমের দাম সর্বস্তরের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা উচিত। বাস্তবতা হলো, চালের সরকারি মজুদ যদি পর্যাপ্ত না থাকে তাহলে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়বে। কেননা অসাধু ব্যবসায়ী ও অবৈধ মজুদদার কর্তৃক অতিমুনাফা অর্জনের লোভে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এরই মধ্যে চালের আমদানি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। গম আমদানিও কমছে। এছাড়া এ দুই পণ্যের সরকারি মজুদও ক্রমেই কমছে। বাজারে এ দুই পণ্যের দাম সর্বস্তরের মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আমদানি বাড়িয়ে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। সরকারকে মজুদ বাড়াতে হবে।
সরকারি গুদামে চালের মজুদ যত দ্রুত কমছে বাজারে চালের দাম তত দ্রুত বাড়ছে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতেও চাল আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। এর পরও দেশের প্রধান খাদ্যশস্যটি আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) জটিলতায় কমছে গম আমদানিও। বাজারে তাই খাদ্যপণ্য দুটির দাম ঊর্ধ্বমুখী। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ তথ্যানুসারে, গত রোববার খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৯৭৩ টন। এর মধ্যে চাল ৯ লাখ ৮ হাজার ৩৭ টন, গম সাড়ে চার লাখের কিছু বেশি ও ধান ৪ হাজার ৬১ টন। আগের তুলনায় ডলার সংকট কমলেও এখনো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আবার যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার কারণেও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে রাশিয়া থেকেও খাদ্যপণ্যটি আমদানি কমেছে।
এদিকে গত ২০ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চালের আমদানি শুল্ক কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও খুব বেশি সাড়া দেননি ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারেই চালের দাম বেশি। ফলে আমদানীকৃত চাল বর্তমানে দেশের বাজারে যে দাম তার চেয়েও বেশি দিয়ে কিনতে হবে ক্রেতাদের। তাই লোকসান হওয়ার আশঙ্কা থেকেই সাড়া দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।
অভিজ্ঞতা বলে, সরকারি গুদামে চালের মজুদ যখন বেশ কমে যায়, তখন বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাবে চালের দাম বাড়ে। প্রশ্ন হলো, খাদ্য অধিদপ্তর ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে বারবার ব্যর্থ হয় কেন? সরকার ধান ও চালের যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, ধান-চাল ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা সেই দামে খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে তা বিক্রি করতে রাজি হন না। কারণ বাজারে ধান-চালের দাম বেশি। বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো মূল্যে বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। আর এজন্য দ্রুত চাল আমদানির উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকারিভাবে বিতরণ বাড়ানোয় মজুদ কমছে। তাদের মতে, নিরাপত্তা মজুদ এবং সম্ভাব্য ঘাটতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় চাল আমদানি করা দরকার। বেসরকারি খাতকেও চাল আমদানি বাড়াতে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে আমন ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৬ আগস্ট থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দুই দফা বন্যা দেখা দেয়। এতে ৮ লাখ ৩৯ হাজার টন চালের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে আগামী বোরো উত্তোলনের আগ পর্যন্ত চালের বাজার অস্থিতিশীল থাকতে পারে। এ অস্থিতিশীলতা কাটাতেই জরুরি ভিত্তিতে আমদানি বাড়াতে হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে খুব একটা উৎসাহিত হচ্ছেন না। তাদের মতে, আমদানি করা চালের দাম বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি হবে। এ কারণেই সরকার শুল্ক তুলে দেয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমদানি উৎসাহিত করার পাশাপাশি বাজারে নজরদারিও বাড়াতে হবে। এর কারণ আমাদের বাজারের চরিত্র কারো অজানা নয়। পাশাপাশি ওএমএস, ট্রাক সেলসহ অন্যান্য প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে।
সরকারি মজুদ কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেন, দাম বাড়িয়ে দেন অতিমুনাফা অর্জনে। চালের দাম বাড়লে ক্ষতিকর প্রভাব নিম্নবিত্তের ওপর যেমন পড়ে, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধারণা করা যাচ্ছে, চালের দাম বাড়লে এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটবে।
সরকারি হিসাবে চাল আমদানি এখন শূন্য। খাদ্য ও দানাদারজাতীয় খাদ্যপণ্য আমদানি করা হলেও গত দুই বছরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোনো চাল আমদানি করা হয়নি বলে খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যে উঠে এসেছে। চলতি বছরে আমদানি না করায় সরকারি গুদামগুলোকে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ওপরই পুরোপুরি নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না খাদ্য মন্ত্রণালয়। এসব কারণে একদিকে চালের সরবরাহ কম, আবার চালের সরকারি মজুদ কমেছে। ফলে চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারি মজুদ বাড়াতে হবে এবং মজুদ বাড়াতে এখনই আমদানিসহ কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে একটি বৈশ্বিক প্রবণতাও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ভারতসহ চাল রফতানিকারক দেশগুলো যদি দেখে আমাদের দেশে চালের ঘাটতি আছে, তখন তারাও দাম বাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা গেছে, বাংলাদেশের চালের চাহিদা বাড়লেই রফতানিকারক দেশগুলো দাম বাড়িয়ে দেয়। তাদের প্রবণতা হলো বিশ্ববাজারে চালের দাম নির্ধারণে বাংলাদেশকে ‘ডিটারমাইনিং ফ্যাক্টর’ হিসেবে বিবেচনা করা। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও মজুদের সঠিক তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত আমদানি যেমন কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, আবার চাহিদা অনুযায়ী জোগান না থাকলে ভোক্তাকে বেশি দামে চাল কিনতে হবে। বাজার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সরকারকে ত্বরিত এবং সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। উৎপাদনের দিকে দৃষ্টি রেখে আমদানির দ্বার যেমন উন্মুক্ত রাখতে হবে, তেমনি বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে। অনেক সময় সঠিক তথ্যের ঘাটতি থাকে বিধায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ‘ফ্যাক্ট চেকের’ মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন, আমদানি-রফতানি, অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে চালের দাম ইত্যাদি বিষয়ে ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমে’ সক্রিয়ভাবে কাজ করে যেতে হবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমদানি করে সাময়িকভাবে খাদ্যের মজুদ বাড়ানোর চিন্তা যেমন করা দরকার, তেমনি ভবিষ্যৎ খাদ্য উৎপাদন আরো বাড়ানোর দিকেও মনোযোগ দেয়া দরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের দুটি সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। প্রথমটা হলো কৃষিজমি দ্রুত কমে যাওয়া। দ্বিতীয়টা কৃষকের উৎসাহজনক মূল্য না পাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তো রয়েছেই। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা, সরকারি মজুদ বৃদ্ধি ও কৃষক-ভোক্তা উভয়কে সন্তুষ্ট রাখতে সমন্বিত পরিকল্পনার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় আরো জোরদার করা দরকার।
নিয়মিত বাজার নজরদারির পাশাপাশি এলসি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনও জরুরি। সরকারি গুদামে চালের মজুদ সামাজিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতার রক্ষাকবচ। গোডাউনে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল রাখার একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আছে। সরকারের কাছে চাল আছে, এ তথ্যই বাজারকে স্থিতিশীল রাখে।