অভিমত

সংবিধানের সহায়তায় দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল

জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেরটেলসমান স্টিফটুং ২০১৮ সালের ২৩ মার্চ একনায়কতান্ত্রিক দেশের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের পাঁচটি দেশকে একনায়কতান্ত্রিক দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশ গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করছে না। শুধু ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলেই নয়, স্বাধীনতার পর থেকে

জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেরটেলসমান স্টিফটুং ২০১৮ সালের ২৩ মার্চ একনায়কতান্ত্রিক দেশের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের পাঁচটি দেশকে একনায়কতান্ত্রিক দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশ গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করছে না। শুধু ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলেই নয়, স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময় কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। সংবিধানের কতিপয় ধারা ও অনুচ্ছেদ ব্যবহার করেই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলে গণতন্ত্র ও জনগণের স্বার্থ সবসময় খর্ব হয়েছে। 

একনায়কতন্ত্র হচ্ছে এক ব্যক্তি বা এক দলের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা, সেখানে এক ব্যক্তি ও তার দলকে কেন্দ্র করে শাসনকাজ পরিচালিত হয়। একনায়কতান্ত্রিক শাসনে একক ব্যক্তি রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা এবং চরম ক্ষমতার উৎস, ক্ষমতা প্রয়োগে তাকে কেউ বাধা দিতে পারে না। রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। তার কাজকর্মের জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সবাই তার আদেশ-নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য থাকেন। ওই ব্যক্তির নেতৃত্বে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকে। একনায়ক তার পছন্দমতো উপদেষ্টাদের নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করে। তার সন্তুষ্টির ওপর অনুগত উপদেষ্টামণ্ডলীর কার্যকাল নির্ভর করে। 

একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যের প্রায় সব উপাদান সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিদ্যমান ছিল। শেখ হাসিনার হাত ধরেই ছিল সব ক্ষমতা, সব প্রতিষ্ঠানের ওপর একক কর্তৃত্ব। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেই তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, কখনই বিরোধী মতকে সহ্য করেননি। সবসময় তিনি বিরোধী মত দমন করতে তৎপর ছিলেন। তার ১৫ বছর ৭ মাসের শাসনামলে গণতন্ত্রচর্চার কোনো পরিবেশ ছিল না। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে পরিলক্ষিত হয়, এ দেশের প্রায় সব সরকারপ্রধানের মধ্যেই কমবেশি একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠার মনোভাব ছিল। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত বেশকিছু অনুচ্ছেদ ও ধারা একনায়কতান্ত্রিক শাসক জন্ম নেয়ার সুযোগ দিয়েছে। এসব অনুচ্ছেদ ও ধারায় প্রধানমন্ত্রীকে চূড়ান্তভাবে সর্বময় কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদসহ আরো কিছু ধারার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসন গড়ে উঠেছে। যদিও সংবিধানের ৭৷(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে। এছাড়া সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা, তার ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে বলা হলেও আজও দেশের মানুষ তার বাস্তবায়ন দেখেনি। 

বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতির একটি গণতন্ত্র। কিন্তু সংবিধান স্বীকৃত গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ সীমিত। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ‘‌কোনো নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন—তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।’ শেখ হাসিনার শাসনামলে তিনি এ অনুচ্ছেদকে ব্যবহার করে সংসদে তার ইচ্ছামতো সব বিল ও প্রস্তাব পাস করেছেন। যেহেতু আওয়ামী লীগের কোনো সংসদ সদস্য সংসদে দলের বাইরে কোনো কথা বলতে পারবেন না, সেহেতু পুরো সংসদ শেখ হাসিনার অঙ্গুলি হেলনিতে চলত। 

আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ—রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এ তিন বিভাগ পরস্পরের জবাবদিহি নিশ্চিত করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে, নির্বাহী বিভাগের সর্বময় কর্তা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী আইনসভার একক নিয়ন্ত্রক। ফলে নির্বাহী প্রধান শেখ হাসিনার ইচ্ছার বাইরে সংসদে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ ছিল না। 

সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে, হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকবে। অর্থাৎ বিচার বিভাগের নিম্নতম আদালতসমূহ ঊর্ধ্বতন আদালতের নির্দেশে চলবে। সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে, এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন। [তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কিনা এবং করিয়া থাকিলে কী পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সে সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।] অর্থাৎ কেবল প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত বাকি সব কাজ রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে। 

শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচার বিভাগে রাষ্ট্রপতি যেসব কাজ করেছেন তার সবই শেখ হাসিনার নির্দেশে করেছেন। রাষ্ট্রপতি আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক নিয়োগ দিলেও তাকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারেই করতে হয়েছে। এ থেকে বলা যায় যে, বাস্তবে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ হয়েছে শেখ হাসিনার ইচ্ছামাফিক। এজন্য বিচার বিভাগে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্রপতি পদে সবসময় শেখ হাসিনা তার একান্ত অনুগতদের বসাতেন। 

সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে আইন ও নির্বাহী বিভাগ সম্পূর্ণভাবে এবং বিচার বিভাগের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ শুধু প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তির কর্তৃত্ব রয়েছে। শেখ হাসিনা সংবিধানের এ সুবিধা কাজে লাগিয়েই দেড় দশকের বেশি সময় ধরে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু রাখতে সক্ষম হয়েছিল। 

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শুরু থেকেই এমন সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যা পরবর্তী সময়ে সংবিধানে স্থিত হয়েছে বলে মনে করেন লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী ফিরোজ আহমেদ। তার একটি লেখা অনুযায়ী, ‌সংবিধান প্রণীত হওয়ার আগ পর্যন্ত কেবল রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে রাষ্ট্রটি পরিচালিত হওয়ার সঙ্গে এর ভবিষ্যৎ নিয়তির একটা গুরুতর সম্পর্ক রয়েছে। আদতে সেই কয়েক মাসের ক্ষমতাচর্চার ধরনই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সমগ্র রাষ্ট্রক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ভিত্তি রচনা করে। সেদিক থেকে বলা যায়, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাচর্চার সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে আজও। এছাড়া সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত আইন প্রণয়নের সব ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল এককভাবে রাষ্ট্রপতির ওপর, যিনি আবার প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কোনো কিছু করতে পারতেন না। এভাবে গণপরিষদ কার্যত রাষ্ট্রপতির (এবং রাষ্ট্রপতি আইনত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই সব কাজ পরিচালনা করতেন) অধীনস্থ হলো এবং সরকারের জবাবদিহি চাওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান আর অবশিষ্ট থাকল না। এভাবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাসের শুরুতেই আমরা একদিকে দেখব ব্রিটিশ কায়দায় সংসদীয় সরকার গড়ে তোলার প্রকাশ্য ঘোষণা; আরেকদিকে ছিল চরম ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রকাশ্য তৎপরতা। গণপরিষদের সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় এবং সেই মত প্রকাশ মনমতো না হলে তা দলন। ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা পাওয়া ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় যে বিপ্লবাত্মক চরিত্র রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদের থাকার কথা ছিল, তা তো হয়নি; আওয়ামী লীগ নিজের আয়ত্তে থাকা গণপরিষদের কাছ থেকেও তার স্বাভাবিক কর্তৃত্বটুকু কেড়ে নিয়েছিল। 

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ব্যাপক অভ্যুত্থানে একনায়ক শাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। আর যেন কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা ফিরে না সে দাবি তুলেছেন সুশীল সমাজ, বিশিষ্টজন ও গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া ছাত্র-জনতা। দেশের বিদ্যমান সংবিধানে ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রতিফলন ঘটেছে। কাজেই ক্ষমতা যদি পুনর্বিন্যাস করতে হয়, তাহলে সংবিধান পুনর্বিন্যাস করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকতে পারে না। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় এটা থাকার কথাও নয়, বরং প্রধানমন্ত্রী অনেক শর্তের অধীনে থাকার কথা। তার কর্তৃত্ব বণ্টিত থাকা উচিত। দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে সংবিধান সংস্কার প্রয়োজন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যেহেতু সংসদে সংসদ সদস্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে সেহেতু এটি বাতিল করা উচিত। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা পুনর্বিন্যাস জরুরি। কোনো ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, সেটিও নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি। এছাড়া দলীয়প্রধান যিনি থাকবেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কিনা সেটিও এখন বিবেচনা করার সময় এসেছে। সংবিধানে কী কী পরিবর্তন আনা উচিত তার জন্য একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে এবং পরিবর্তনের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরে গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্রচর্চায় ও জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে।

আনিসুর রহমান: প্রতিবেদক, বণিক বার্তা

আরও